মহাসনদ
গভীর রাতে বাবা ঘুমানোর পর দেখি মা কাঁদে। মায়ের কান্নায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। বেদনা গাঢ় হয়ে অন্ধকারও কাঁদে জীবনের কাছে ঋণে পড়ে রয় জীবিত স্বজন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার শরীরে পদে পদে স্মৃতিসৌধ, ভগ্নাবশেষ, পেশীগুলো ক্লান্ত মিনার। এক হাতে চোখ মুছে ও অন্য হাতে আমাকে বুকের ওপর চেপে ধরে মা একবার রুগ্ন গ্রহের দিকে তাকিয়েছিলেন। সেই রাত থেকে আমি মায়ের জন্য আলাদা ঘর বানানোর স্বপ্ন দেখি। একটি চড়ুই পাখি প্রতিদিন আমাকে একটি করে খড় এনে দিত, আর বলতো- দ্যাখো, একদিন তোমার ওই গাছের ডালে ঘর হবে। কিন্তু সেই খড় আমি হারিয়ে ফেলেছি। আজও আমার মায়ের কোনো ঘর নেই। দেয়াল আঁচড়ে আমি একটি ঘর আঁকি। বালুতে আঙুল ঘুরিয়ে ঘর আঁকি। ছাই কাগজ রক্ত পাথরে ঘর আঁকি। সকালের সাদা রুটিতে ঘর আঁকি। মসজিদের গম্বুজ, লেকের জলের ওপর বাসি রোদে, পৃথিবীর সব সাদা পৃষ্ঠায় ঘর আঁকি। সেই ঘরে জানালা আঁকি, জানালায় আঁকি মায়ের মিছিল দুখি মুখ। গভীর রাতে বাবা ঘুমানোর পর মায়ের কান্নার শব্দে আমি ঘুমের ভেতর স্বপ্নেও নড়েচড়ে উঠি।
নেংটা
ইদানিং পোশাকের প্রতি আমার অনীহা। ঘুমঘরে নেংটা হয়ে শুয়ে এক মিহিন অন্তিম শোভায় জাগাই হৃদয়ের সহজ সময়। একটি আলোরেখা চিকন হয়ে এসে বুকের হাড় হয়ে শুয়ে থাকে। ঢাকায় যখন সন্ধ্যা নামে, এই বিষণ্নতা ঠাণ্ডা চর্বির মতো অন্তরে বসে যায়। যেন সারা অস্তিত্ব জুড়ে পাহাড়ের ভার, গম্ভীর, মৌন সে পাহাড়ের দিকে এক রুগ্ন মানুষের, দাসের, নির্বীর্যের দণ্ড নিয়ে তাকিয়ে আছি।
ইদানিং চারপাশে শুধু সন্ত্রাসের শব্দগন্ধ, রিমরিম ছায়াবীথি। ইদানিং নেঙটা হয়ে থাকতে ভালোবাসি, জননাঙ্গের চুলে হাত বুলাই, হাত উঁচু করে বগল দেখি, কনুই ভাঁজ করে পেশীর উচ্চতা দেখি, ঊরুর নীল শিরাগুলোর ফুলা দেখি, নাকভর্তি দম নিয়ে বুক উঁচু করে শ্বাস ছাড়ি। আমি হাওয়ার মতো, হালকা। এই শরীরকে আবৃত করতে নেই, শরীর নিজে থেকেই পবিত্র, যথেষ্ট অবমিশ্রিত, পরিত্যক্ত, অমাবস্যার ন্যায্য দশা, পর্যাপ্ত দুঃখের শাঁস। ইদানিং নেংটা এই অন্তঃশীল শরীর। বারান্দায় ঝুলে আছে নির্বোধ আন্ডারওয়্যার।
প্রতিদ্বন্দ্বী
মানুষ একদিন তার নিজ বিজ্ঞানের দিকে ফিরে যাবে-ডানাবাহিত রোদে শালিকের সতীর্থরা- গলায় ঢেউ নিয়ে খেলে উড়ে যায়-অন্য পাখিদের থেকে ওরা বেশি সূর্যের দাঁড়িয়েছে কাছে। তাকে ঘেঁষে-আবার গোত্তা মেরে নিচে নেমে-ছুঁয়ে-সবুজের বুকে ধরা শস্যের দিকে সরে হিমের ঋতু আর রাগে। আমার চিবুক অবধি একটি ছায়া নিয়ে আসে সেখানে অভ্যূদয় আছে। আমি জানুভরে নিজেকে তুলে নিলাম-মুগ্ধ জীবদের সাথে-প্রতি অংশতে প্রতি অংশের বেদনা ভাগ করে। তবু মানুষ, অনেকটাই সৌখিন-কিছুটা মূর্খ, যে যার মনোযোগে বা যুতে নিজ নিজ নিষ্ঠা নিয়ে দাঁড়ায়। মানুষের প্রণয়ের থেকে অধিক কোন আশ্বাস নেই-সেই প্রথম মূল কিংবা জ্ঞানে-তারা উঠে আসে দুই হাজার সৌরবর্ষ থেকে। মানুষের রক্ত থেকে প্রাচীন কোনো স্রোত নেই। মানুষ একদিন পৃথিবীর ত্রুটির ভেতর নিজের স্বরের চেয়ে অধিক শান্ত হয়ে যাবে-আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই-প্রত্যেকে তার আয়ু থেকে এসে প্রতি অঙ্গের সায় নেবে।
কুকুর ভালো কুকুর খারাপ
আমি কুকুর ভয় পাই
এ কথা তারা জেনে গিয়েছিল
অন্য লোকজন মিলে একদিন আমাকে সেই রাস্তা দিয়ে
কথা বলতে বলতে নিয়ে গিয়েছিল
যে বাসায় খোলা কুকুর ছিল আর ভয়ানক ডাকতো।
প্রথম বুলেটের শব্দে বিচলিত পাখির মতো
পিঁপড়ার চিৎকারে বিব্রত কবরমৃতের মতো
বুকের মাটিতে কোদালের উপুর্যপরি কোপে
নিজের হৃৎপিণ্ড আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে
দেয়াল ঘেঁষে গেছিলাম
মনের রাজহাসঁগুলো স্তম্ভিত ডেকে উঠেছে।
কৌতুক করে হাসতে হাসতে লোকগুলো রিকশায়
উঠে গেছিলো, ঘাসের কাছ থেকে
তরুণ গাভীটিকে ডেকে এনে বলেছিল:
এমন কথা- হা হা কি হাস্যকর!
অথচ আমার বুকের কাছে নতজানু রাইফেল
আমার মুঠোর তলে লজ্জিত যেকোনো ঐশ্বর্য।
আদিম অমাবস্যা
দেহ নেই তো দেয়াল নেই
পথ নেই তো পৃথিবী নেই
অণুতে অণুতে ক্ষরণ
বুকে গর্ত কুরে বীজ লাগায় এইসব সন্ধ্যার লক্ষণ,
যখন সব পাই তখন ভরাসন্ধ্যা ব্যাধির বিন্যাস
যখন সব হারাই তখন প্রেম থেকে পার্টি-পলিটিক্স
শুধু সূচনাতে ভরে আছে সমগ্র অন্ধবৃত্ত
মানুষ আমূল বিদ্ধ এমন আদিম অমাবস্যায়
শোচনীয় বোবা স্বপ্নদুখে
ক্রমাগত দাহ হয়
রক্তলাঞ্ছিত সময়ের চোরাস্রোতে
শূন্য ঘরে ফিরে আসে অভিমানী
উদ্বাস্তু আহত জীবনে তুমুল,
কোজাগরীর আলো দেখে
ভাঙে নত বেদনার আর্তপতনে
দেহ নেই তো দেয়াল নেই
পথ নেই তো পৃথিবী নেই
মানুষ সূর্যবীজ, পৃথিবীর হা মুখে ভরে রাখে অবিরল ক্ষরণ জনন।