নাগরিক
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দরজা দুটো
পাশাপাশি বসে দু’জোড়া জুতো।
প্রতিদিন প্রতিরাতে
প্রতিক্ষণ প্রতিপ্রাতে
জুতোরাই গল্প করে—বেশ ভালো আছি!
দুঃখ আছে বুকে তবু মুখে হাসি।
জুতোরা প্রভুরা—করমোশালায়
পা-দের পরিচয় হয়নি;
একই ময়দানে যৌথচোখ—
কখনো হয়না সামনা-সামনি।
মাটির আঁচল ছোঁব
মায়ের কথা খুউব… মনে পড়ছে। মাটির কথাও। বাবার মাঠের ধান কেমন আছে? খুব ইচ্ছে করছে তাও জানতে। দাদীর তইতইগুলো; সারা দিন কানের কাছে প্যাকপ্যাক করে। নানীর হাতের চুড়িদুটো; নানা মরার পর কেমন যেন রংচটা হয়ে গেছে! পীরো চাচা মরলো—মনা কবরে গেল—আলি হাসানের টুকটুকে মেয়েটাও নাকি চলে গেছে জম্মের মতো! কাউকে দেখতে পেলাম না।
মা আমি তোমার কাছে থাকবো—আর মাটির ঘরে শোবো। আমার আর কোনো চাওয়া নেই। আমি কৃষকের ছেলে মা—মাটি জল কাদা ছাড়া কীভাবে বাঁচি?
বাবা; তুমি মন খারাপ করলে নাকি? তুমি মাটিতে বীজ দাও—আমি এসে মমতার মই দিবো।
কাঠবাদাম
কাঠবাদামের পাতা
তোমার চ্যাপ্টা বুক—
আমাকে প্রশ্রয় দেয়।
অথচ নদী ভরাটের মতো
তুমি চিরকাল বেদখল—
দুর্বৃত্তের হাতে!
কুকুরামী
ভেতরে একটি লোভের লেজ নড়ে ওঠে
কুকুরের মতো ঘুরঘুর করি;
প্রভুভক্তের মতো কতো নিটোল আচরণ
সময়ের গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে যায়—
পেটে যেন ঘি জমা আলসেমি ভাব।
ভুলে যাই—
কোনো কিছু পেতে
প্রথমে আমরা কতোটা কুকুর হয়ে উঠি!
দুর্ভাগ্য; কুকুর হতে হতে একটা সময়
আমাদের নিজস্ব লেজই হারিয়ে যায়!
রাতের গান
কিছু পিঁপড়ের পা; বয়ে নেয় কষ্টের সারি,
চিৎ শুয়ে রাজপথ ছুটছে বাড়ি।
আকাশের মেঘ নিয়ে বুক পকেটে—
বেদনার ধোঁয়া ছেড়ে যায় রকেটে;
ফুটপাত শুয়ে আছে টোকাই এর বুকে
বেওয়ারিশ কুকুরের নাকগুলো শুকে।
পোড় খাওয়া জীবনের গলি পেরিয়ে
জীবনের কাছ থেকে যায় বেরিয়ে;
সিগারেট শুষে নেয় ঠোঁটের জ্বালা—
পা দিয়ে রমনা করি ফালা ফালা।
মড়কপর্ব
ওই তো চলে গেল মিছিল
কুয়াশা; গণতন্ত্র
ফিরছে লাশ; রক্ত
সংসদ ভবন।
ছুটছি তো ছুটছি—
হোঁচট লেগে
উল্টে গেল জাতির কপাল!
এখন ঘাড়ে মরা কুত্তার লাশ
শিয়ালের মড়কপর্ব শেষ হলে
আবার কুড়াবো—
আখের ক্ষেত; কুষ্ঠাবন
পড়শীর উনুনে বুনন হচ্ছে
জাহাজপাড়া; পোশাকখানা
এভাবে—
ছিনালিপনা শুরু হলে
হব নটির দালাল!
এত হাসছিস কেন?
সরকারি মাগির মতো
ভাল্লাগে না!
নেকড়ে তাড়িত সময়
প্রলয়ঝড় আর অনাবৃষ্টির এক প্রবলরাতে আমার জন্ম। জন্মপূর্ব খরার দাগ এখনো শুকোয়নি। দগদগে ঘায়ের মতো ভাতের থালে—মাছির প্রকোপ গভীরভাবে দৃশ্যমান। পরের বছর ঘাড়ের উপর যমের মতো চেপে বসে মহামারী দুর্ভিক্ষ। ক্রমেই একটি বিষণ্ন সময়ের পেটে নিরন্তর নির্মিত হচ্ছিল—আমার বেড়ে ওঠা। সামগ্রিক অস্তিত্বের মধ্যে যেন আত্মিক শক্তি সংকট। হামাগুড়ি দিয়ে আর কতদূর চোখ যায় নিজস্ব বলয়ে?
কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দ দিয়ে তৈরি করি—কবিতার শহর। কুড়িয়ে পাওয়া শব্দের আলো আর বাতাসের ব্যঞ্জনাতে দারুণ বিষাদের ছাপ। নগরীর সাথে নিজের সত্তার অচ্ছেদ্যরূপে আত্বিকতার এক মরমী সম্পর্ক নিয়ে—গুলিয়ে ফেলি আত্মার অহম। সত্যি এক ভয়ংকর চিন্তা আমাদের প্লটহীন জীবনের গল্প। যার উদ্ভব নৈরাশ্য ও বিচ্যুতির জরাক্রান্ত বুদ্বুদ থেকে কেড়ে নেয়—আদিম শক্তির মাইনে।
শ্রম-শিবিরে ঢুকে পড়েছে সংকীর্ণ বিজনেস প্যারেন্টস। দয়ালু সুরে যারা গেয়ে যায় স্বার্থের গান। মৌলিক মসলা জোগাতে—যাদের কেড়ে নেয় শরীরের সংগ্রাম। পুঁজিময় সংশ্লেষ থেকে বেড়িয়ে পড়ে—সচেতন এক স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ। সময়ের তীর থেকে ছুটে যাক কিছু পিস্তলের শব্দ আর ঈগলের পাখনাবিন্যাসী ঠোঁট। আমি কোনো মৃৎ শিল্পের কারিগর নই; নই আমি কোনো কাঠমিস্ত্রী। আমি এক রক্তবিদ্রোহী ও জন্মবিপ্লবী ভগ্ন সমাজের—মানসিক শ্রমের ঘাম!
এখন আগুনমাখা শতাব্দীর ভিতর দিয়ে—বিশ্বাসহীনতার দৌড়ে দূরন্ত কুকুর যখন খানিকটা এগিয়ে—তখন মানুষ হবার ইচ্ছা নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে—দু’পা পিছিয়ে আছি। জানি ব্যাঙের কোরাস শুধু কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে ফলে। একটা মারমুখী সামাজিক বিপ্লবের জাগরণ যদিও তড়িৎ নয়—কিন্তু বঞ্চিত মানুষের ধ্বনিতে একটা আসন্ন আলোকিত—নান্দনিক মুক্তির চৌরাস্তায় পৌঁছে দেখি— উচ্চকিত সৌন্দর্য-সংবেদ।
গল্পের বুনন বাড়ছে
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বলে—যে গল্পের বুনন বাড়ছে
আমরা সবাই আলাদা আলাদা আগুন
পোড়া পোড়া সম্পর্ক নিয়ে—আমাদের ঝলসে যাওয়া মুহূর্ত
ফ্রেমে বাঁধাই করি সুকুমার অভিনয়।
এবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় নামা যায়—
কারণ মানুষকে আমার বার বার মনে হয়
মাছেরই প্রতিবেশী।
না হলে আমাদের প্রথম আশ্রয়—জল হবে কেন?
চলো জন্মের নাড়ি কেটে—আমরা হয়ে উঠি বিজ্ঞাপনের মডেল;
আমাদের হিংসার চারাগাছ বড় হলে
নিশ্চিত কোনো ছায়াদের হুড়োহুড়ি থাকবে না—
প্রতিশ্রুতির আঙিনায়।
তুমুল নিঃশ্বাস বিক্রির হাটে পায়চারী করছি—
এখন আমরা উৎপাদনের চেয়ে বাণিজ্যে সিদ্ধহস্ত!
পায়রা
চোখের সামনে কচি চারা বেড়ে ওঠে
. আর…
বয়েস বাড়ে অপেক্ষার;
দেখি—ডিম ফুটে বের হওয়া পায়রার
. লোম ওঠে
খাদ্য খোটে
তুমুল মোমের ঠোঁটে।
খুলে রাখি দ্বার।
ভিটামিন
ছায়ার ছবি ছুঁয়ে
শুয়ে আছে সরব শরীর।
ভেঙচিকাটা চামচে অজল উৎসব
খুঁড়তে খুঁড়তে নেমে যাচ্ছি।
বোধ আর ব্যব”েছদ জমা রাখা যায়;
ধানছোঁলা ঢেঁকির দাঁতে।
আমরা ক’দিন কেলিয়ে কেলিয়ে কান্না শিখব—
আমাদের ভিটামিনের বড় অভাব!
কবি পরিচিতি:
পলিয়ার ওয়াহিদ
জন্ম: ২৬ ফাল্গুন, ১৩৯১ বাংলা
জন্মস্থান: মনোহরনগর, পাঁজিয়া, কেশবপুর, যশোর।প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
পৃথিবী পাপের পালকি (২০১৫)
সিদ্ধ ধানের ওম (২০১৬)
হাওয়া আবৃত্তি (২০১৬)