সকালের রোদে
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল খুঁটে খুঁটে একমুঠো বুনোফুল এনেছি
প্রথম সকালে তোমাকে দেব বলে—সুঘ্রাণে সুখবতী ঢেউ করে
বুকে নেবো বেহিসেবি মাতাল পদ্মার মতো-কূল-কিনারা ভাসিয়ে
মেঘলাশ্রাবণী বৃষ্টিচুম্বন বেঁধে নাও ঠোঁটের আঁচলে
হাতে বোনা তাঁতের লাল শাড়িতে সাজাবো তোমাকে
মৃত্তিকা অলঙ্কার আলো বুনে দেবে শরীরে তোমার
রঙধনু আভা ছড়িয়ে পড়বে তোমার ঢেউআঁকা শরীরীভাঁজে
পথের রেখারা নতুন পথ হয়ে কবিতার মতো ভালোবেসে
শিরা ধমণিতে লিখে দেবে মাত্রাহীন অবাধ্য সাহসী প্রেমের কবিতা
হাওর-বাওড় সবুজ ফসলের মাঠ থেকে এনেছি
সরল কৃষকের মরমি বুক
নদীতিকা মধুকণ্ঠ সুধাসঙ্গীত লালনের মতো দিনরাত সাধনায়
পাহাড়ের আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধার মতো বিস্ময় দুচোখ
তিমিরে খুঁজেছে শুধুই তোমাকে
লালমাটি গ্রীবায় মগ্নতার অগ্নিতে মাতাল মৌতাত
রৌদ্দুর হয়ে আছড়ে পড়ে পাগলা ঢেউয়ের কূলভাঙা সুখের সর্বনাশে
রূপশ্রী তোমার লাবণ্য সর্বস্ব পেতে চাই-পাতাকপির মতো তুমি
নিঃস্ব হও প্রেমে—পলিমাটি বুকে লেখা হবে সবুজ কবিতা
মধুরিমা কণ্ঠভাঁজ ঢেউ খেলে যাবে রাত্রির বুকে
সুখের সাম্পানে ভেসে যাবে খোঁপার পুষ্পপাপড়ি
ভোরের স্নানশেষে হেসে ওঠে এ এক নতুন সকাল যেনো মুগ্ধকবিতা
সহস্র রজনির সযত্ন পাণ্ডলিপি হয়ে যাবে একদিন
সবুজ ফসলের গল্প লিখে দাও বিরানভূমিতে
প্রবল প্রপাত ভাঙুক নেশাতুর আবেগীকণ্ঠ
কুয়াশার মতো ভিজে ভিজে নামুক তোমার নিঃশ্বাস-কম্পন
মুগ্ধতায় মধ্যরাত বিলীন হয়ে চাই নতুন প্রাণ সকালের রোদে
বাউলের মাটিতে কবিতার কৃষক
(কবি সৈয়দ আবদুস সাদিক শ্রদ্ধাভাজনেষু)
আপনি কী অদ্ভুতভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে
তাঁর যৌবনা বাগান থেকে বুক ভরে নিচ্ছেন ফুলের ঘ্রাণ
আর কবিতার ভেতর থেকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছেন
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের দিকে—অনেক প্রশ্ন নিয়ে নিজেকে ভাঙছেন
প্রমত্ত পদ্মার ঢেউয়ের মতো-
আপনি কী অদ্ভুতভাবে তন্ন তন্ন করে হেঁটে বেড়াচ্ছেন
লালনের মাজার—কাঙালের ঘরবাড়ি-গগনের মনের মানুষের সুরে
মশাররফের ভিটেতে কী খোঁজেন সাধকের মতো
মেঘ বিজলী বাদল উপেক্ষা করে তবুও বসবাস আপনার
আলো ঝলমলে এ নগর ফেলে বাউলের মাটিতে কবিতার কৃষক
কবি কতো সহজেই ভালোবেসে থেকে যায় মরমী মাটির সাথে
বিবণ্র্ জীবন কতো সহজেই সবুজ পাতার গল্প হয়ে যায়
তোমার দুচোখে বাংলাদেশ
তোমার দুচোখ চোখের আগুন ঢালে শাসকের চোখে
দুচোখে দেখেছি সাহসী মিছিল যৌবনের অসহ্য রোদ্দুর
দুচোখে তোমার সমুদ্র-কাঁপা সাহসী রক্তাক্ত শ্লোগান
দেখেছি দুচোখে তোমার স্বপ্ন মাতাল পদ্মা-মেঘনাঢেউ
তোমার দুচোখে দেখেছি কপালে তিলক কাহ্নপাপদ
হাজার বছর সংস্কৃতির সুধাস্রোত পরানের একতারা
দেখেছি দুচোখে বেদনার কালোমেঘ মীরজাফরী রঙ
মসনদ হারানো নবাবের করুণ মৃত্যু বাংলার সূর্যপতন
তোমার দুচোখে দেখেছি কষ্টের লাভা ভিনদেশি
শকুনেরা কেড়ে নেয় আমার মাটির সোনালী ফসল
লালসার চাবুকে থেতলে খায় উর্বরতার সব গান
তোমার দুচোখে অপমানে রক্তআগুন বিষাক্ত ফণা
তোমার দুচোখে দেখেছি রক্ত সোপানে আরোহী বীর
বিপ্লবী বাঘা যতীন সূর্যসেন—দুচোখে অগ্নিকা তোমার
বীরসেনানী প্রীতিলতা—নতুন বারুদ মুক্তির কবিতা
পদ্মা মেঘনা যমুনা নদীতিকা দেশ সবুজ ফসলের ঘ্রাণ
তোমার দুচোখে দেখেছি হাওর-বাওড়—লালন সাঁই
পীরমুর্শিদী হাছন রাজা রাত্রিজাগা মরমীপরানগীতি
বিষাদ-সিন্ধুর দুঃখগাথা—হায় হোসেন! হায় হোসেন!
দেখেছি কষ্টের নদী সীতার বেদনা দুচোখে তোমার
তোমার দুচোখে দেখেছি জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথ
নদী ও সমুদ্রের মতো বহমান জীবনের কবি
দুচোখে তোমার কাজী নজরুল জাহান্নামের আগুনে বসে
কবিতায় বানায় কামান বারুদ—কাঁপে ব্রিটিশ-সিংহাসন
তোমার দুচোখে দেখেছি মরণ যন্ত্রণা—অধিকার হরণের
মাতৃ-বোল কেড়ে নেয়ার গোখরা দংশন মৃত্যুলেখা
তোমার দুচোখে দেখেছি বুলেটবিদ্ধ রক্তগঙ্গা
নক্ষত্র হয়ে জ্বলে বরকত জব্বার দুচোখে তোমার
তোমার দুচোখে মৃত্যুপুরি কবরআন্ধার ঘুমহীন নয় মাস
রক্ত কান্না লাশে ভাসে দেশ—যৌবনা নদীরা ধর্ষিতা মা
তোমার দুচোখে সমুদ্রের অধিক সমুদ্র তৃষ্ণা স্বাধীনসনদ
বাংলাদেশ —মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান
পুরনো যৌবন
এই নদীতিকা দেশে
তুমি নদীর স্রোতের মতো অসাধারণ এক লাবণ্যসঙ্গীত
সবুজের অরণ্য নিজেকে হারিয়ে তোমাকে দেখে
মুগ্ধতার নিশুতি অতলে সমর্পিতা নারীর মতো
এই বাউলের দেশে
তুমি এক দারুণ মনবৌষ্ঠুমি একতারাতে বাজাও অন্তর
কৃষ্ণের বাঁশি সেখানে পুরনো যৌবন
মনের ঘর ভেঙে তুমি নিয়ে যাও মনের মন্দিরে
পথে পথে আঁকা এই দেশে
তুমি অদ্ভুত এক আল্পনা যৌবনা রঙধনু মেঘলা আকাশ
গভীর আবেগে তৃষ্ণায় কাঁদে ভোরের কম্পিত ঠোঁট
তোমার সুন্দরে যেনো একান্নবতী পরিবার পৃথিবীর উঠোন
অসহায় সুখ
এক অদ্ভুত জীবন নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা কথার চাবুকে
ক্ষতবিক্ষত যেনো ব্রিজঘাটের পাথরের কালো বুক সহস্র বছর
জেগে থাকে—সারা শরীরে বিষাক্ত শিরা যেনো কুণ্ডুলি পাকানো
বয়সী সর্পশরীর—তবুও মানুষ বাঁচে অচিন পথের একতারা
সমুদ্র কী সমুদ্রের বুকে আছড়ে মুগ্ধতার বিলিন সুখে নাকি
সমুদ্র নিজেই চাবুক পেটায় সমুদ্রকে ঢেউফণা মাতাল চাবুকে
রহস্যের অন্তরগভীরে দেখেনি কখনো কেউ লাবণ্যের আড়ালে
কতোটা ভয়ঙ্কর গোখরার দংশন থাকে—যৌবনা নীলবেদনা
সৌন্দর্যের মহাকাব্য হয়ে ওঠে যৌবন বাতিল করে দেয়া
নিশিজাগা বেহিসেবী সন্ন্যাসী কবির—অদ্ভুত জীবন মানুষের
গোলাপ পাপড়িকেইে ভালোবাসে—বুনোফুল কে পরে খোঁপায়
যে মেঘ প্রবল প্রতাপে ভাঙে ঘর বাড়ি শরীরের অলিগলি
বুনোঝড় হয়ে যে সূর্যকে ডোবায় ভয়ার্ত অন্ধকার ঘূর্ণিপাকে
পৃথিবীর তাবৎ অভিশাপ শুধুই তার জন্য—বৃষ্টি হয়ে যখন সে
অঝোর ধারায় কাঁদে অবোধ শিশুর মতো—গভীর বেদনা
চোখের আঁচলে বন্দি হয়ে যায় তখন মুগ্ধতার দারুণ কবিতা
মানুষের কীসে সুখ কীসে আনন্দ কিসে বেদনা মানুষেরই অচেনা
কথার চাবুকে অসহায় সুখ হাসে সংসারে মানুষের অদ্ভুত জীবন
তোমার নগর থেকে চলে যাবো
তোমার নগর থেকে চলে যাবো—দহনের খেলা
নীরবতার অগ্নিতে ঘরপোড়া নিঃস্বতার মতো
আমি চলে যাবো—এ নিয়ে কোনো অভিমান নেই
রাজপ্রাসাদের গল্প ছেড়ে চলে যাবো—লাবণ্যের
সব কবিতা ডিলিট করে দিয়ে চলে যাবো
আমার এসব নিয়ে কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই
যেখানে গহীন নদী চেনে না আমাকে
যেখানে দুপুরের রোদ চেনে না আমাকে
যেখানে অন্তরতৃষ্ণা গোলাপের গল্প জানে না
আমার জন্যে যে নগরে কারো কোনো প্রতীক্ষা নেই
আমি চলে যাবো দুঃখনদীর অতল সঙ্গীতে
কারো বেণিতে এ নিয়ে গেঁথে রেখে যাবো না
কষ্টের কবিতা লাল শাপলা কলমিফুল চোখের সমুদ্র
আমি চলে যাবো সন্ধ্যাপাখির মতো অচিন অন্ধকারে
তোমার নগর থেকে চলে যাবো—গড়াই নদীটি
যেভাবে হারিয়ে গেছে আপন বেদনা বুকে বেঁধে
যেভাবে মৃত্তিকা সড়ক ঢেকে গেছে কংক্রিট পাথরে
আমিও হারিয়ে যাবো অবহেলায় ধুলোবালিতে
ডুবে থাকা সাধের বুকের বোতামের মতো—
নগর ছেড়ে চলে যাবো
এখানে কে কাকে মনে রাখে
কে কার জন্যে পোড়ে মনের চিতায়
অপেক্ষার কী মূল্য আছে বিরান ভূমির দীর্ঘশ্বাসে
দুঃখঘাসে একদিন চলে যাবো
ঘুণপোকার মতো আমার দুচোখ খেয়ে যাবে
লাল পিপীলিকার সারি—যেখানে তোমার লাবণ্য
কবিতার দারুণ উৎসব দুপুরের রোদ ছিল
সব রেখে আমি চলে যাবো
আমি কিছুতেই চাই না কষ্টের শিরোনামে কেউ আমার জন্যে
খোঁপা করুক মেঘবতী চুলে
অনিচ্ছার আগুনে জেগে থাকুক নিদ্রাহীন নিশুতি রাত
রোদ ভেঙে বৃদ্ধের গল্প হয়ে ওঠা গণিতিআবেগ
পলেস্তারা খসা পুরনো প্রাচীরের মতো পেছনে ফেরার
ডাহুকীবন্ধন সব সুন্দরে বন্দি রেখে আমি চলে যাবো
একাকী একতারা সুরে দূর গহনে নদীপথ ভেঙে
জীবনহীন জীবনকিনার ঘেঁষে
কোনো অভিমান নয়
কোনো অভিযোগ নয়
ক্ষোভের আগুনও নয়
কেউ যাকে বোঝেনি—তুমিও বোঝোনি
রাজপ্রাসাদের শ্বেতপাথরে থাকে না বেদনার কোনো রঙ