ওমর আলী লেন
আমার কান্নার সুর কোনোদিন শুনবে না তুমি
কোনোদিন জানবে না কখন কোথায়
. কিভাবে হারিয়ে গেছি
দূর থেকে শুধু দেখে যাব আমি তখনো তোমাকে
তুমি ঝুলন্ত মেঘের দেশে ভেসে ভেসে
চাঁদের ঝুমকো কানে হেসে হেসে উড়ে যাবে দূরে
আমার বুকের হাড় ভেঙে ভেঙে হবে চুরমার
তবু তুমি তাকাবে না এইখানে
যেইখানে পুড়ে পুড়ে আমি হবো অনন্ত অঙ্গার।
জানি, তুমি ভুলে যাবে আমাদের চন্দ্রলাগা রাত
আমাদের ভ্রমণসমগ্র
তোমার মনের কোণে ভাসবে না আর
এইসব বাঁকাপথ, হুডতোলা রিকশায় ছুটে যাওয়া
আর তৃষ্ণার নহর—প্রেমিক ওমর আলী লেন।
উলুবনে মুক্তা
ভুল রমণীর হাতে তুমি তুলে দিলে বাঁকা চাঁদ
কানের দুলের মতো মনে হলো ঝুলন্ত মেঘও
তুমি তারে চেয়েছিলে হৃদয়ের নিবিড় বন্দরে
অথচ তার মনের কোণে ছিল অন্য কোনো নাম।
প্রেমে নয়, কামে নয়, অন্য কোনো মিথ্যা অহঙ্কারে
যারা দূরে চলে যায়, তারা যায় দূরে চিরদিন।
হিসাবী নারীকে কেউ পারে না ফেরাতে!
লাল-কালো চেক শার্ট
তোমার হাতের ছোঁয়া লাগা সেই লাল-কালো শার্ট
শুক্রবার এলে পরে যাই কাঁটাবনে।
চোখে চোখে খুঁজি ফিরি তোমাকে ভিষণ
লাল-কালো চেককাটা সেই শার্ট পরে।
কোনো এক জুনে সেই শার্ট দিয়েছিলে ভালোবেসে
আজ সেই সব বুঝি স্মৃতি হয়ে গেলো
কত দ্রুত উড়ে গেলো ঘোরলাগা রাত-দিনগুলো!
বহুদিন পর ফের এলো সেই শুক্রবার
ফের দেখা তুমি আমি। মুখোমুখি। তারপর তুমি
ছুঁয়ে দিলে শার্ট। যেন ছুঁয়ে দিলে রক্তাক্ত হৃদয়।
যেন আমি গনগনে সূর্য, তুমি টলটলে দিঘি…
আমি যেন মুহূর্তেই উড়ে উড়ে পুড়ে পুড়ে ছাই
যেন অনন্ত রাত্রির নিকষ চাদর দুলে দুলে
ডুবে যাচ্ছিল অনন্তে!
তোমার চুলের ঘ্রান ভেসে এলো চিত্রল হাওয়ায়!
পাহাড়-সমুদ্র-আমাদের প্রেম
আমাদের কখনোই আর কথা হবে না, দেখাও
তুমি ঝরনার মতো বয়ে যাবে সমুদ্রের দিকে
পেছনে স্তব্ধ পাহাড় রযে যাবে, পেছনে অতীত
তুমি তারে ভুলে যাবে, তুমি তারে হানবে আঘাত
অনন্ত পথের শেষে কিছু নেই জেনে
কেউ কি যায় না নিরুদ্দেশে? ফের কি আসে না ফিরে
আকাশে উড়তে শিখে কোন পাখি ভুলে গেছে নীড়?
এইসব প্রশ্ন আজ বারবার কেন জাগে মনে?
মনেরে বলেছি: ওরে মন,
পৃথিবীটা চিরকাল গতিশীল,
কষ্টেরা হৃদয়ে হানা দেবে লাল ডাকাতের মতো!
অথচ পাহাড় নয়, তুমি আজ সমুদ্রে বিলীন!
তৃষাতুর বাউল
আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট, জল দেখে কেঁপে উঠবেই
তুমি কেন হতে গেলে অতল-শীতল লাল দিঘি?
কেন আর
ক্ষণে ক্ষণে দোষ দাও, দেখাও কপট অনুরাগ!
আমি তো ভুলেছি পথ, চলেছি একেলা নিরুদ্দেশে
যদি ফিরে আসি তবে, চিনিও না আমারে তখন
ফিরায়ে দিও আবার, দিও না দাঁড়াতে আঙিনায়।
অতীতের সব স্মৃতি মুছে দিও কান্নার আড়ালে।
হতে কি পেরেছি বলো তোমার গোপন নাকচাবি?
চেয়েছি তো চিরকাল হতে শুধু তোমার নূপুর
পায়ে পায়ে কত ভোর চুমু খেয়ে গেছি বারবার
ভুলেও কখনো তুমি তাকালে না পথের কিনারে
কত না আবেগ বুকে নিয়ে তাকিয়েছি ওই চোখে
আহা চোখ! আহা তুমি কত শত মানুষ দেখলে।
দেখলে না শুধু এই তৃষাতুর বাউলের ঠোঁট!
না-কবিতা
জলের প্রচ্ছদ তবু টলটলে সন্ধ্যারে জানায়:
উপেক্ষার তালিকায় রাখো ওই রোদের বিলাপ
গণিতে বিতৃষ্ণা যার, সেও খোঁজে নিরাপদ রাত
তিনভাগ মানবহৃদয়, একভাগ শ্রাবণের নদী
ভরানদী ঘৃণা নিয়ে চাঁদের সাম্পান
একবার ভাসালে দক্ষিণে
মনসার ক্রোধ বাড়ে; ঝড় ওঠে সমুদ্রে ভীষণ।
উন্মাদ সময় তবু মানুষের কাছে
প্রিয় কোনো বেদনার বার্তা নিয়ে আসে।
পায়ে পায়ে পথ
আমি পদাতিক পায়ে পায়ে মাপি পথের ভূগোল
শত সূর্যের আগুন জ্বলে দুই চোখে
পায়ের ছন্দে কাঁপন ধরে চেনা পৃথিবীর বুকে
আমি নির্বিকার। নীল মেঘ দেখে দেখে
মনে হয় নক্ষত্রের আগে আগে ছুটে যাচ্ছে কেউ-
তার চরণের ধ্বনি শুনি বসে হাওয়ার কার্নিশে!
যারা মাইল-মাইল রাত্রি পাড়ি দেই
সেসব যাত্রীকে ডেকে আনি
আর হৃদয়েরে বলি:
উড়ে যারে দূরে যারে উড়ে উড়ে পথের ওপারে!
আমাদের ঘুম
আমাদের ঘুম গেছে স্বেচ্ছানির্বাসনে।
রাতগুলো হলুদনদীর স্রোত অথবা শ্মশান
তবে কার বিস্ময়ের নাম লালসন্ধ্যা মেঘনদী?
আকাশে উড়ন্ত মাছ গেয়ে চলে ধ্রুপদীসঙ্গীত
অথচ এখানে জেগে থাকে
একজোড়া হাঙরের হাস্যোজ্জ্বল চোখ
তারপর পার হয়ে চলে গেলে মাইল-মাইল রাত
কাচের জোনাকি কেন গেয়ে ওঠে মৃতদের গান?
চলো আজ পাঠ করি আকাশের বিগত যৌবন
বিবর্ণ প্রচ্ছদে আর কত এঁকে যাবে প্রেমের গজল?
বাঁশি তবে পুড়ে যায় নিরন্নের ক্ষুধার আগুনে
এইসব পথশিশু, ক্ষুধার্ত মানুষ
হয়ে যায় সিনেমার পর্দাজুড়ে নিখুঁত মডেল।
আমাদের ঘুম গেলে স্বেচ্ছানির্বাসনে
দ্যাখো, বণিকের চোখে দ্যাখো ধূর্ত কর্পোরেট হাসি!
সুর
লেগেছে সুরগ্রহণ বধির ও অন্ধ গ্রহলোকে
থেমে যাক প্রজাপতি আর লাল মাছিদের গান
পড়ন্ত রাতের দেহে নক্ষত্র পুড়ুক
মেঘ শিকারীর চোখে নামুক পোয়াতি আসমান।
ঘুমন্ত নগরী যদি জেগে ওঠে পুলিশি গর্জনে
ফেসবুক-টুইটারে রাত চমকাবে-
চোর ভেবে কবিকেও নির্বোধ প্রহরী ধমকাবে!
কে বেশি নিশাচর
নগরীর রাস্তাজুড়ে এই মধ্যরাতে জেগে আছে
কয়েকটি নিশাচর নিরীহ কুকুর
আর কারা জেগে থাকে?
কাওরান বাজার যেন যৌবনবতী হয়।
বলুন তো এই মধ্যরাতে
কুকুরের মতো কেন ঘেউ ঘেউ করে বেকুব পুলিশ!
হেমন্তের শালিক
যখন লেগেছে মাঠে কামরাঙা বিকেলের হাওয়ার পরশ-
বয়স্ক নদীরা কেন তবে ফিরে পেতে চায় হারানো যৌবন?
এমন প্রশ্নের ভয়ে চুপচাপ শুয়ে-শুয়ে দেখি
মগজে জেগেছে চাঁদ- হেমন্তের সোনামুখী কামুক সন্ধ্যায়!
হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া দুপুরের গান করো যদি ফকির বাউল
বুড়ো সূর্যকে ক্ষেপাও কেন? বিহঙ্গ-বিহঙ্গ কাল পার হয়ে
অনন্ত আন্ধারে আঁকা রক্ত-রক্ত লাল জবা মেঘের সন্ত্রাসে
হেমন্তের বেলা শেষে ফিরে এসো ডানাভাঙা বিরহী শালিক!
আবহমান
আকাশে ফুটেছে ফুল আলেয়ার নামে
নেমেছে প্রেমের চাঁদ মেঘেদের খামে।
মেঘে-মেঘে রটে গেলে প্রণয় খবর
তারাদের গ্রামে ছোটে প্রেমিকপ্রবর।
হৃদয়ে হৃদয় বাজে নূপুরে-নূপুর
বৃষ্টিভেজা মন খোঁজে ঝুলন্ত দুপুর।
প্রেমিক পুরুষ গেলে প্রেমিকার পানে
চতুর রাধিকা ছোটে শুয়োরের টানে।
রাত যত বাড়ে তত প্রেমিকের মনে
কতশত শঙ্কা জাগে ক্ষণে-প্রতিক্ষণে
সুদূরে প্রেয়সী গেছে হলো বহুদিন
বুকের পাঁজরে তাই ব্যথা চিনচিন।
লাইলীকে খুঁজে-খুঁজে মজনু যখন
ঘুরছিল পথে পথে আঁধারে তখন।
পাহাড়ের বুক চিরে উঠলো আওয়াজ
ভালোবাসি-ভালোবাসি ভুলে লোকলাজ।
লখিন্দর উঠে আসে বেহুলার পানে
চতুর বালিকা ছোটে শুয়োরের টানে।
রূপকথা-উপকথা লোককথা শুনে
পথ কাটে প্রেমিকের দিন গুনে গুনে।
ফাগুনে আগুন ফুল ফোটে যার মনে
তারে খুঁজে ফিরে যায় কোকিলেরা বনে।
পাখিরাও ভুলে যায় নিজেদের গান
হরিণীস্বভাব নারী করে আনচান।
বৈষ্ণবীও পথ ভোলে বাউলের গানে
চতুর রমণী ছোটে শুয়োরের টানে।
প্রেমিক কবির পুঁজি কেবল হৃদয়
তাই দিয়ে প্রেমিকার কী বা আর হয়!
তাই কাঁদে প্রেমিকেরা হারিয়ে সে প্রেম
রাধা হারা বৃন্দাবনে কাঁদে একা শ্যাম।
জুলেখারে ফিরে পায় ইউসুফ-প্রাণে
চতুর গোপিনী ছোটে শুয়োরের টানে।