স্কুলদিন
বালিকা, তোমার স্কুলদিন হালোটের পথ ধরে চলে যায়। কাগজসাদা স্কার্ফ ওড়ে ঘুড়িছেঁড়া উদ্দাম হাওয়ায়।
বাতাসের কবলে আজ তুমি; বাতাসের কবলে আজ অপরিণত স্তনের লাজুক সম্ভ্রম।
সহপাঠীর অজস্র দৃষ্টিব্যূহ ভেঙে সবুজ ক্ষেতের আলে তুমি এক টিয়েরঙ পরি অথবা
সফেদ পারাবত হয়ে ওড়ো; তোমার ওড়ার পদ্ধতি অভ্যাস করে অসংখ্য তিলরঙ ডানার চিল।
তোমার স্কুলদিন টেন্স, অ্যালজেব্রা-আতঙ্কিত; গরিব পিতার ঘরে প্রেমচিঠি লুকানোর গুপ্ত সিন্দুক খুঁজে হয়রান—
কাক্সিক্ষত বাসনায় কল্পিত; তরুণ শিক্ষকের স্ন্দুরী গৃহিণী, বয়স্কা শিক্ষিকার লাজুক পুত্রবধূ, স্কুলের প্রধান ফটক
থেকে বাড়ি অব্দি জীবনের ভোমরা হাতে দাঁড়ানো অসংখ্য যুবকের শিশ্নতোষ অলীক ফ্যান্টাসি—কামনার জল।
তোমার স্কুলদিন স্বপ্নপুষ্পকরথে চড়ে আসা প্রার্থিত পুরুষে কল্পবিভোর—অগণন অনাম্নী নক্ষত্র-আগুনে মিট মিট জ্বলে…
নাগলিঙ্গম
ফুটেছ অদ্ভুত ফুল—নাগলিঙ্গম। এই অরণ্য-আড়ালে থোকা থোকা ফুটে আছ সহস্র স্বয়ম্ভূ তারা—নীলাভ
অন্ধকারে জ্বেলেছ রূপাগুন—দেহদীর্ণ পুষ্পের প্রদীপ।
এই বিহ্বল বসন্তের দুপুরে ছড়িয়েছ ধুপ-ঘ্রাণ—বনময়—;তপোবন-বালিকার কোলে ছিনিয়ে আনা
সরস্বতীর বীণা—কস্তুরীতাড়িত হরিণচঞ্চল হাতে উদারা, মুদারা, তারা…ঝরছে শিবের ফুল—
স্বেচ্ছা-সন্ন্যাস নেওয়া রহস্য-রমণী পুরোনো আটায় রুটি বেলা রেখে পেতে আছে কামনা-আঁচল—
কুষ্ঠিনির্দেশ মেনে কুড়াচ্ছে পাপ ও পুনর্জন্ম। তোমার প্রহরায় রত অনন্ত, বাসুকী, পদ্মা— মাথায়
মণি আর মুক্তাওয়ালা সাপ…
রহস্যকুসুম,হরিৎ-পালক পাখিদের দেশে তোমার কিংবদন্তি শোনা যায়।
হৈমন্তিক
পূর্ব হেমন্ত
গভীর অরণ্যফেরত মাছরাঙা হেমন্তের চিঠি নিয়ে এসেছিল আমাদের গায়ে আর সুমিষ্ট আখের ক্ষেত
ধরে যেতে যেতে অনুবাদ করেছিল কূলবতী নদীর ভাষা। একদিন জনে জনে তার সঙ্গীতপ্রিয়তার কথা
রটে গেল বলে ঝিঁঝিঁদের পাড়ায় বসেছিল ঠুমরি খেয়ালের আসর আর ফাটাফাটি চেহারার মেয়ে—
যে কোমর দুলিয়েছিল ভরতনাট্যমে,তার খয়েরি রুমালের ঘ্রাণ ঈর্ষাকাতর কিছু রাতফুল চুরি করে নিয়ে
স্বনামে ছড়িয়েছিল ভোরের হাওয়ায়।
উত্তর হেমন্ত
সন্দেহে ঝাপসা হলো সব। যেন অদূরের তালবন-প্রান্তরে চেয়ে আছি, অতিমৈথুনক্লান্ত দুটি চোখ!
রাংতা গোধূলির আলোয় সোনার মাছি হয়ে ওড়ে ধুলো আর বালি— নবাগত পরিযায়ী পাখিটিকে
দেখে অনুবাদক মাছরাঙা ভাবি…কোদাল-কোপানো মেঘে ছেয়ে গেলে পুরোটা আকাশ, আমাদের
কূলবতী নদী পৃথুল অজগর সাজে।
হঠাৎ চমকে উঠি— কে জানে, কার রুমালের ঘ্রাণ চুরি করে নিয়ে এল ছাতিমের ফুল!
নিশাচর আলোর শহর
শহরময় নিশাচর আলোর টহল। এ দেয়াল ভেঙে আসে না চাঁদের অভিবাদন— ক্ষীণপ্রভা তারার দ্যুতি।
কোলাহল ঘুমোতে গ্যাছে— সে খুব নিদ্রাতুর কিনা! ঘুমঘুমচোখ-ট্রাক শব্দসন্ত্রাস নিয়ে এলে নৈঃশব্দ্যও
থাকে না আর। তারও খুব প্রাণের ভয়। জনহীন শহরের মোড়— যেন কোনো জাদুকরের মেলে ধরা
হাতের তালু— রহস্যপুরী!
কমলারঙ, নিশাচর আলোর শহর— শুনশান— চারিধার— শুধু গলির ভিতরে কতিপয় শিশ্নতোষ
রমণীর উৎসাহী চোখ— বাঘিনীর চোখের মতো জ্বলে…
প্রশ্ন
খুব ভোরে প্রতিদিনকার মতো আজও তুমি একরাশ ফুল নিয়ে মণ্ডপে যাচ্ছিলে, আমি ভাবলাম,
সারা রাত ধরে তুমি একমুঠো নক্ষত্র কুড়িয়ে এনেছ। সাধারণত, এত ভোরে পশ্চিমের ব্যালকনিতে গিয়ে
দাঁড়ানো হয় না আজকাল। দাঁড়ালে, গৌরীদের পোড়ো বাড়িটা বুকের ওপর সারা দিন ভর করে থাকে।
ঘাটের মসজিদে ফজরের আজান শেষ হলে, দত্ত বাড়ির বেণু কাকুর রেওয়াজ শুরু হয়। আর, ভোরের প্রশান্ত
বাতাসে উড়তে শুরু করে হলুদ প্রজাপতির মতো অসংখ্য এস্রাজ। কিছুদিন হলো তিনি সঙ্গীতে মনোনিবেশ করেছেন।
তোমার প্রার্থনা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকি। তুমি মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে আসার পথে তরল
অন্ধকারে একটা প্রশ্নের নৌকা ভাসিয়ে দাও। আর জানতে চাও— প্রতিদিন সকালে তোমার স্বপ্ন দেখে আমার
ঘুম ভাঙে কি না—
আষাঢ়ের পঙ্ক্তিমালা
শেষ বিকেলের রোদ নিস্তরঙ্গ হলে তুমি বিছানায় যাও এবং আর সবাকার মতো তোমারও রয়েছে
এক নিজস্ব চিল, যাকে আকাশে ওড়াতে তোমার সামান্য সময় নিতে হয়।
নদীতে ভাসমান নৌকোটাকে পুরোটা দেখা যাচ্ছিল না বলে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে দেখলে বাড়ির
পেছনের রাধাচূড়া গাছটি কবে কবে যেন বড় হয়ে গেছে— গত আষাঢ়ে যার চারা লাগাতে গিয়ে
কালিদাস আওড়াচ্ছিলে। আর সেদিন বিশুদ্ধ বর্ষায় ভেজা তোমার কুমারী শরীর দেখে যে কাঠবিড়ালীটি
সঙ্গমলিপ্সু হয়েছিল তাকে আজ মতিদের বিড়ালে খেয়েছে।
আর আজই ধূলোমলিন গোধুলির প্রাক্কালে যে চিলটি ওড়ালে, সে-ও বিরুদ্ধ বাতাস কেটে কেটে একদিন
ঠিকই মেঘেদের কাছে পৌঁছোবে। আর জ্যৈষ্ঠের মরা চাঁদ পুনরায় রজঃস্বলা হলে তোমার হাতে পৌঁছে
দেবে একটি হাতচিঠি। অথচ লাটাইয়ের প্রতি তোমার সীমাহীন বৈরাগ্য দেখে অবাক হতে হয়।
আসছে আষাঢ়ে তুমি কোন ছুতোয় বৃষ্টিতে ভিজবে?
সুদীর্ঘ শীতরাত্রি
তারপর সুদীর্ঘ শীতরাত্রি এলে প্রাচীন মন্দির থেকে উড়ে আসে ঘণ্টার আওয়াজ। আমরা যারা নবীন শিকারী,
পাললিক বাতাসে চড়ে আসা এই সব শব্দ শুনে ভাবি একঝাঁক ধাবমান চিতা।
তারও অনেক পরে যখন ঠান্ডা মুখের মতো একখ- চাঁদ নিঃশব্দতার পুকুরে নিঃসঙ্গ সাঁতার কাটতে শুরু করে
তখন কোনো এক শিকারসঙ্গীর ঠোঁটে জ্বলে ওঠে আগুন এবং পালমল ধোঁয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস
নিতে নিতে আমরাও বুনতে শুরু করি গল্পের চারা।
আজ, এইখানে যে হরিণীটি বধ হবে, শুনেছি পূর্বজন্মেও সে মরেছিল একই নিয়মে।
অথচ তারও ছিল কিছু স্বপ্ন— প্রেম— ছিল রিরংসা…
আমাদের অজস্র আষাঢ়ে গল্প সেই সব হরিণীদের উদ্দেশে উড়ে যেতে থাকে
জন্ম
অনির্ণিত অন্ধকার থেকে উড়ে আসা গুচ্ছ গুচ্ছ আলোর ফুলকি, তোমরাই প্রিয় বাল্যবন্ধু আমার—
দিয়েছিলে অনন্ত আগুন-সান্নিধ্যের রাত— যদিও জানতাম, তোমরা কেউ ছিলে না খসে পড়া তারা—
এমনকি তারাদের খুব কাছের আত্মীয় কোনো— তবু মুঠো ভরে তোমাদের কুড়াতে চেয়েছি;
আর সুগন্ধি গাবের ফুল— যাকে চৈতি বকুল বলে ডাকি— শেষ বসন্তের রাতে তারও পেছনে ছুটেছি বহুবার—
কেননা শিস বাজানো দোয়েলের মতো চৈতি বকুলের ঘ্রাণ আমার আবাল্য বন্ধু—
যদি কখনো প্রত্যাশা পূরণের পুণ্য প্রহর ফিরে পাই— জেনে রেখো, প্রিয় পিতামহের
কাছ থেকে তোমাদের মতো জোনাক-জন্ম চেয়ে নেব…
প্রতিতুলনা
মাছরাঙা, কনিষ্ঠ আঙুলের মতো কঞ্চিতে বসে টলটলে জলের পুকুরে প্রতিবিম্ব আঁকছে,
আর তার চোখের সরোবরে সাঁতরাচ্ছে আঁশটে স্বপ্নের কতগুলো মাছ
তুমি, গায়ে গোধুলি-চাদর জড়িয়ে রূপালি আয়নায় আত্মপ্রতিকৃতি আঁকছ,
আর তোমার চোখের চৌরাস্তা বরাবর হেঁটে আসছে নোনা স্বপ্নের শিব
আমি, তুমি-বিষয়ক শব্দাবলি নিয়ে তোমার বিমূর্ত মুখাবয়ব আঁকছি,
আর আমার চোখের চা-চামচ উপচে পড়ে যাচ্ছে ঘিয়ে-রঙ-রোদে তোমার চুলের নস্টালজিক দ্রবণ
পড়ে যাচ্ছে …
কীর্তন
‘হায় হায় ওরে…ওপারেতে শিমুল গাছটির ঝিকমিক করে লতা
হায় হায় ওরে…সকল লতা বয়ে গেছে কৃষ্ণ গেছে কোথা?’
খোল করতাল বাজে। দূর হতে আসে মগ্ন কীর্তন। ওখানে ব্যাকুল বৃন্দাবন— ওখানে বিষণ্ন মাথুর—
. কেমনে বঞ্চিবোঁ রে বারিষা চারি মাষ।
. এ ভর যৌবনে কাহ্ন করিলে নিরাস
এমনি প্রহর গুনে বেড়ে যায় সংক্রান্তির রাত। বেড়ে যায় রাধার বেদন। দূরারোগ্য বিরহে ভরে
চন্দ্রগ্রস্ত রাতের পেয়ালা। আসছে বরষার মাস। কণ্টকময় স্মৃতির আষাঢ়। চতুর কৃষ্ণের
ফাঁদে মূর্ছা যায় সরলিনী রাধা— কোথায় নিষ্ঠুর কালা, প্রাণের কানাই? কথকের সাথে সাথে
দুচোখের জল ঢালে অষ্টসখী-শ্রোতা। —ওখানে ব্যাকুল বৃন্দাবন —ওখানে বিষণœ মাথুর —
. কাহ্নাঞিঁ মোরে আণিয়া দে।
. আলো পরাণের বড়ায়ি।
. কাহ্নাঞিঁ মোকে আণিয়া দে।
বড়ায়ি রে! নন্দের নন্দনেরে ডেকে আন— বিধুর ব্রজধামে…
—ওই দূরে খোল করতাল বাজে
—ওই দূরে খোল করতাল কাঁদে।
রাগ-রাত্রি
সরোদ আনো, আনো এসরাজ— হোক মেঘমল্লার; তিলককামোদ— ভীমপলশ্রীময় রাতের ভাসান।
গলা ছাড়ো মরাল-মন্থরে। অথবা চটুল চঞ্চল—
‘বাজে মোরী পায়লিয়াঁ প্রেম,
বাজে মোরী পায়লিয়াঁ,
ঝনন ঝনন ঝননননননননন বাজে বিছুবা।’
উত্তাল তরঙ্গ আনো, সাজিয়ে ফেলো জলতরঙ্গ— সপ্ত জলাধার; ছড়ি আনো। জ্বালাও বেলোয়ারি—
জ্যোৎস্না-মাদক। হাত রাখো সুরবাহার— সুকণ্ঠী দিলরুবায়। ঘুঙুর-মন্দ্রে নাচো বিনোদ চরণ,
বিভোর হাওয়ায় ওড়ো স্বর্ণ-ঝালর, গান গাও কোমল কোকিল—
‘খাজা মোহীয়ুদ্দিন চিশ্তী পীরান পীর,
দূরসে আয়া হুঁ শরণ তিহারে।’
মেঘে মেঘে ঘনায় প্রহর— রাগের রজনী। অঝোর বৃষ্টি নামে, ছলকে ওঠে সিঁদুর-বিজলি,
‘বিজরী চমকে মেহা বরসে।
পবন চলত মা রুমঝুম
রুমঝুম।’