কবিতার কথা
আমার খুব বেশি লেখা হয়ে ওঠে না। জীবন আর জীবিকার এই পরবাসে গুছিয়ে লেখার আগে পড়ার গুরুত্ব বেশি মনে করি। তাই যা বলতে চাই, তা লিখতে ভাবি প্রচুর। আমার লেখা কবিতাগুলো বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রিয় হয়েছে নিজের কাছে। এক সময় ভেবেছি, না, এই কবিতাটি আমার প্রিয়। আবার বদলেছি মত, মন।
এখানে সংযুক্ত পাঁচটি কবিতা, ২০২১ সালেই লেখা। প্রথম কবিতাটি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। আজ যদি আমাদের করোনাকাল অতিক্রম করতে না হতো, তাহলে আমাদের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হতো ভিন্ন আঙ্গিকে। মানুষের সকল আনন্দযজ্ঞ তার জন্মমাটির সঙ্গে। যারা নিজ ভূমি ছেড়ে আসেন, তারা সবসময়ই একটি অপূর্ণতা লালন করেন বুকের দুপাশে। আমার প্রথম কবিতাটি আমার স্বদেশকে নিবেদিত, খুব সহজ সরল ভাষায়।
দ্বিতীয় কবিতাটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন নিয়ে লেখা। আমি বিশ্বাস করি, একজন মুজিব জন্ম না নিলে আজ আমার অবস্থান এখানে হতো না। তিনি আমাদের একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি রাষ্ট্র দিয়ে গিয়েছেন। তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা শেষ হওয়ার নয়। এই কবিতায় সেই ঋণ সামান্য হলেও শোধ করতে চেয়েছি।
তৃতীয় কবিতাটি মানবিক প্রেম ও প্রজন্মকে নিয়ে লেখা। আসলে একজন কবি কী প্রেক্ষাপটে একটি কবিতা লেখেন, এর ব্যাখ্যা করা যায় কি! হয়তো যায়, অথবা যায় না। আমি যে চিন্তনে একটি কবিতা লিখি, একজন পাঠক হয়তো অন্য রূপকল্প চোখে নিয়ে তা পড়েন। তাই কবিতার মাঝে যে বাণী, তা আপামর মানুষের কাজে লাগতে পারে বিভিন্নভাবে। আমার এই কবিতায় আমি মূলত জীবনের স্বপ্ন ও বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছি।
আমার চতুর্থ কবিতাটি পহেলা বৈশাখকে ঘিরে লেখা। মানুষ নতুন নৃত্যে মাতুক। সাজুক, নতুন উদ্যমে। কঠিন এই সময়ের দেয়াল ভেদ করে জাগ্রত হোক নব উদ্যম। বলেছি, ‘একটি নতুন নৃত্যনিয়ম লিখবে বলে, আকাশ খুলে দেয় অন্য আঙিনা।’ এর সবই আমার কল্পনা মাত্র! এটা ভেবেই বিচলিত হই মাঝে মাঝে, আহা! মানুষের সকল সৃজনশীল ভাবনা যদি বাস্তবতার পরশ পেতো!
আমার পঞ্চম কবিতাটি ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে লেখা। এটি একটি সরল প্রেমের কবিতা। অনেক ব্যক্তিগত আবেগ ও সত্য লুকিয়ে আছে এই কবিতায়। আর মানুষের টলমল স্মৃতি যেখানে ভেসে থাকে, তা তো খুব প্রিয় হয়েই পড়ে! আমি প্রেমকে আরাধনা বলেই বিশ্বাস করেছি সেই কৈশোর থেকে। এখনো ফুল হাতে নিয়ে, পাখির পালক কুড়িয়ে নিয়ে যখন তন্ময় হয়ে থাকি, তখনো মনে পড়ে, স্রষ্টা তার প্রেমের প্রকাশ ঘটানোর জন্যেই এই নান্দনিক জগৎ-সংসার সৃষ্টি করেছিলেন!
সুবর্ণপ্রভাত হে বাংলাদেশ
পঞ্চাশটি গোলাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।পঞ্চাশটি
প্রজাপতি আকাশে উড়িয়ে দিতে দিতে বলব-
তোমরা বাংলাদেশে যাও।রঙিন ছায়া ওড়াও সেই মাঠে,
যেখানে মিশে আছে আমার শৈশব।
পঞ্চাশটি বৃক্ষ রোপণ করতে চাইবো সেই মাটিতে,
যেখানে শহিদের রক্ত মিশে আছে। যেখানে পাখিদের
গান শোনে জেগে উঠতেন আমার মা,
. আর ফজরের নামাজান্তে বলতেন একটি
. সুখী স্বদেশ দাও প্রভু!
আমার আনন্দযজ্ঞ মানেই আমার মাতৃভূমি।
আমার নদী,লালমাটির টিলার উপর বেড়ে উঠা
লিচু গাছ। গাছে ঝুলে থাকা কাঁটাল।
যেখানে আকাশই আমার সহচরি হয়ে সাথে সাথে
ঘুরে, আর দেখায় এক একটি নতুন সকাল। #
সবুজ সত্যের মতো
পাতাগুলো নদীতে ভাসে।ফুলগুলো পাপড়ি ছড়ায়
মানুষেরা হাট থেকে ফিরে।পাখিগুলো উচ্চস্বরে গায়
একজন মা প্রতিদিন থাকেন পথচেয়ে,প্রতিটি দুপুরে
একজন চিত্রকর ছবি আঁকেন,বাংলার সমস্ত শরীরে
তার হাতের রঙ লাল আর সবুজ সত্যের মতো
প্রজন্মকে জানায় পিতার ইতিহাসের পাতা,সতত
জাগে চাঁদ, জাগে ভোর, একক শক্তির শিয়রে
এই দেশ এগিয়ে যাবেই, সকল শিকল ছিন্ন করে
একটি আঙুল তুলে যিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম’
দেখি আজও তারায় ও ভূমিতে,সেই মুজিবের নাম!
ভাদ্রের অদূরে জমে থাকে যে বিদ্যুৎ
শ্রাবণ পেরিয়ে এলেই আমরা দেখা পাই শরতের
যৌবনের পরতে পরতে জমা থাকে যে শুভ্র উল্লাস
শান্তির আহ্বানে তা একদিন শিউলীমালা হয়েই
শোভা পায় কিশোরীর বেণীতে।একগুচ্ছ জুঁই
হাতে নিয়ে কবি দাঁড়িয়ে থাকেন তার অপেক্ষায়-
যে একদিন এগিয়ে নিয়ে যাবে এই কালের কলম।
জমে থাকা বিদ্যুতের অদূরেই বেড়ে ওঠে ভাদ্রের
বসতি। কেউ সেই বসতির পাশেই বানায় ঘর-
বিগত বর্ষায় যাদের ঘর ভেঙে গিয়েছিল ঝড়ে,
তারা অন্যের ছাউনীর দিকে তাকিয়ে বাঁচার আশ্রয়
খোঁজে।ঋতুর বুক থেকেই মানুষ ধার করে কিছু উষ্ণতা।
নতুন এই নৃত্যকথা
দমকা হাওয়া মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেয়।বাড়িয়ে দেয়
এগিয়ে যাওয়ার সাহস। আর এই যে পাতাগুলো
আমাদের সামনে পড়ে থাকে, তারা যৌথ ভালোবাসা
. পায় মাটি থেকে, মন থেকে।
আমি ভালোবাসার গল্প লিখতে যখন নতুন খাতা
খুলে বসি, তখন একটি নতুন ঢেউ আমাদের
দুয়ার ছুঁয়ে যায়। একটি নতুন নৃত্যনিয়ম
লিখবে বলে, আকাশ খুলে দেয় অন্য আঙিনা।
আমি সেই আঙিনার উচ্চতাকে মানুষের হৃদয় ভেবে
লিপিবদ্ধ করতে থাকি বৈশাখের নতুন কীর্তন।
পাপড়িরাঙা চিঠি
গোলাপের পাপড়ি ছড়াতে ছড়াতেই একদিন বদলে
দিয়েছিলে চিঠির রঙ। খাম খুললেই যে পাপড়ি ও
পরাগ গড়িয়ে পড়তো আমার হাত থেকে
আমি তা কুড়িয়ে নিতে নিতেই আবার তাকাতাম
আকাশের দিকে। ওই আকাশ দিয়েই উড়োজাহাজ
অতিক্রম করে দেশের পর দেশ, চিত্রের পর চিত্র।
ওই আকাশ পেরিয়েই চিঠিগুলো আমার কাছে আসে
ওই বিশুদ্ধ বাতাস ডিঙিয়েই আসে অক্ষরগুলো,
আমি পড়তাম-মেঘের বিন্যাসে লেখা প্রেমের আখ্যান।
মানুষ স্পর্শকে ভালোবাসে। মানুষ ছুঁয়ে দেখতে দেখতেই
শিখে সমান্তরাল মৃত্তিকায় হাঁটার কৌশল।আর সুন্দরতম
রঙ ও রেখার স্বপ্ন আঁকতে আঁকতে বলে ওঠে
আমার সকল যাপিত আরাধনা তো
. তোমার জন্যেই হে পৃথিবী!