মেরু অঞ্চলের তুষারে গড়া স্থাপত্য
দারুণ মেহনতে জড়ো করেছি বিরাট আকারের বিত্ত
সুরভীর সাথে সমন্বিত করে অনামিকায় পরেছি মহর্ঘ পাথর,
ঠুমরির মেঘজলে সারা দিনমান সিক্ত করেছি চিত্ত—
গাঙ্গচিল চরা চোরাবালির চরে মিস্ত্রি দিয়ে বানিয়েছি ঘর;
তারপরও জমেছে হরেক ঋতুতে নানা বর্ণের ঋণ
শ্যাংরি-লা অতিক্রম করে হেঁটে গেছি তিব্বতের সীমান্তে,
শ্যাসেইলের শুশুক ভাসা সৈকতে দিয়েছ দুর্দান্ত দিন—
ঘুরেছি বালির মন্দিরে—খুঁজে পাইনি তেমন কিছু দিনান্তে।
মাঝে মাঝে তিমি মাছের বিপন্ন আর্তগীতে জাগিয়েছ ছলনা
শিরিন নেক্টারের বিন্দু বিন্দু স্বপ্নে ভরা মৌচাকের মতো প্রগাঢ় ঋণ,
কোথায় তোমার সাকিন—কিবা পথের নিশানা
তুমি তো কিছু বলনা—
পান করেছি দ্রাক্ষার নির্যাস—স্মৃতির তসবি জপে জপে হয়েছি প্রবীণ।
মাঝে মাঝে চশমা চোখে খুঁটিয়ে দেখেছি ঋণের সাফ কাবালা
ড্রাগসের দহনে দগ্ধ হয়েছি—ইনসোমনিয়ায় বিদীর্ণ হয়েছে শরীর,
হাওলাতের বীজ সুদে আসলে হয়েছে মহিরূহ—
ছড়িয়েছে ডালপালা,
ডুবুরির লেবাস পরে জলতলে ঘুরেছি—প্রবাল ছুঁয়ে বয়েছে নোনা নীর।
শিখেছি কৌশল—খুঁজেছি পথ
কিনেছি লক্ষ্মীর ভাঁড়, তারপরও হয়নি পরিশোধ,
দিয়েছ বাইসন-চরা প্রান্তরের হাওয়া
দেহমনে জড়িয়েছ সিগ্ধতা অপার—
কাঁচের পুকুরে গোল্ডফিসের মতো আমার ভেতরে
জ্বলেছে সোনালি বোধ,
কর্কট রোগের মতো বেড়েছে প্রলোভন—
স্পৃহাকে করতে পারিনি পরিহার।
সিনাইয়ের হরিদ্রাভ ওয়েসিসে খাঁটিয়েছি তাঁবু
গালিচায় গড়েছি বৈঠকি পরিবেশ,
স্বর্গ থেকে উড়ে আসা দেবদূত—
লোহিত সাগরে ছড়িয়েছে আলোর সম্পাত,
নির্জনতায় কেটেছে প্রহর —
আসেনি কেউ —দেখিনি কোথাও কোনো কুটুমখেশ,
মেরু অঞ্চলের তুষারে গড়া স্থাপত্য যেন না ধসে—
পেশ করি এ মোনাজাত।
সুরাইয়া নক্ষত্রের উষ্ণীষ
চা-পুছিতে লেমন-জিনজারের ফ্লেভারঅলা তপ্ত পানীয় তৈরি করে
ফায়ারপ্লেসের উষ্ণ আঁচে সৌরভে দগ্ধ হতে গিয়ে আজ সন্ধ্যায়,
কেন জানি কাঠের খুঁটিতে ছিদ্র খোঁড়া ঘুনপোকার গুঞ্জনের আখরে—
মনে হয়—বিজয়ী হতে পারিনি এ জীবনে কোনো প্রতিযোগিতায়।
এ খেদের দূর্বা-ঘাস গজায় আমার করোটিতে
যেন জাবর কাটে ছাগল,
আঙিনায় বেরিয়ে আসি—নাসারন্দ্রে অপ্রাপ্তির ঝাঁঝালো নস্যি গুঁজে
দ্রাক্ষার লতানো সবুজে রোদের রূপচাঁদা আঁশে শোভিত হয় অবতল,
দেখি—বিবরে প্যাঁচা এক চোখ ঘুরিয়ে বৃহস্পতির যমজ চাঁদ খুঁজে।
ভেষজের বিশুষ্ক প্রসূন সিরামিকের পাইপে জ্বালিয়ে করি আজ স্মোক—
কাশফুল খচিত পাড়ে পদচিহ্ণ ফেলে সাঁতরে অতিক্রম করেছি তিতাস,
স্নায়ু—পাথর ছড়ানো বালুকার উদ্যানে ক্যক্টাসের কুঁড়িতে হয় উৎসুক,
শুনি—মহাস্থানগড়ের স্তূপে অঙ্কিত শ্রমণের প্রার্থনা পতাকার নিঃশ্বাস।
চন্দ্রকীর্তির বচন বুঝিবা—
ক্যারাভানে দুশামবে পাড়ি দিয়ে তাঁবু ফেলে তাসখন্দে,
পুরানো শতাব্দী তিমি মাছের দীর্ঘশ্বাসে
অগাধ জলধিতে ফোয়ারা হয়ে উতলায়—
ঘরবৈঠকি আমি—সিল্করুটে শুনি উটের গলায় ঘন্টাধ্বনি
বিচলিত হই দূরের দ্বন্দ্বে,
এ সফর পরিক্রমায় স্রোতস্বিনী অযুত—
মশকে জল ভরে পাল তুলে দাঁড় বায়।
পর্যটনে পরিশ্রান্ত হয়ে প্রাগ-তিবলিসি রুটে
যাত্রাবিরতীতে থেমেছি বাকুতে,
খিবার কেল্লায় জ্বলেছে আকাশ প্রদীপ
খুঁজে পাইনি গন্তব্যের সুনির্দিষ্ট হদিস—
স্মৃতির ধারাপাতে বজ্র-বিগ্রহের স্বর্ণালি সরিসৃপ
ভবিষ্যতের বস্ত্র বোনা হয়েছে বর্তমানের মাকুতে,
পেয়েছি আকাশ—মেঘের শুভ্র শেরওয়ানি
শিরপ্যাচে সুরাইয়া নক্ষত্রের উষ্ণীষ।
নগরীর তবকমোড়া রঙ্গমঞ্চে
চলে এসো নগরীর তবকমোড়া রঙ্গমঞ্চে
ঝাড়বাতির রুশনি শিঞ্জনে জরিময়,
কাফতানে ঝলসাবে রোদের রেণুকা…সহিষ্ণু…সরোজ…সাণী—
মাঝে মাঝে ভাবি তোমার দুটি অসফল পরিণয়,
কাছাকাছি আসলে—
ম্যাজিক মাশরুমে ভরে ওঠবে আমার স্যাঁতসেতে অরণ্যানী।
উপস্থাপনায় সুনাম আছে কিন্তু দুর্নিবার
বুঝলে…খাস রুশি ঘরানার ব্যালে,
মেয়ে তোমার ভালোবাসে ব্রাজিলের সকার—
জোগাড় করেছি আর্কাইভের আলোকচিত্র,
চর্মগোলকের পেছনে নিত্য দৌড়ান পেলে।
বয়োবৃদ্ধ গ্রিনকো গাছটির কথা চেয়েছো জানতে—
বুসান নগরীর বেওমেওসা মন্দিরের চত্বরে
দাঁড়িয়ে আছে গেলো পাঁচ শত বৎসর,
আমি ভালোবাসি শীবের সংগীত ধান ভানতে—
ছায়াতলে অন্ধ শ্রমণ এক বেঁধেছিল কুঁড়েঘর।
মজে আছ তুমি তান্ত্রিকের নকশাময় গীতে
না হয় তৈরি করে নিয়ে আসবো
তিব্বতি ধাঁচের মেডিটেশন ম্যান্ডেলা,
জানি তো বিপন্ন হও নিঃসঙ্গতার হীমেল শীতে—
বিরতীতে ঝাড়ের তলায় জমে উঠবে—
আমাদের চাপান-উতোর…দগ্ধদিল দাবাখেলা।
সপ্তাহের দিনপঞ্জি
শনিবারের সন্ধ্যাবেলা নভোচারী হই আমি
ভেসে বেড়াই রশ্মির রওশন চৌকি ঝংকৃত নীলিমায়,
রোববারে যোদ্ধা হতে বাসনা হয়—
প্রতিরোধ গড়ে তুলি স্নায়ূ-দুর্গের পরিখায়;
সোমবারে পোষা মৌমাছির কল্লোলিত কনসার্টে
সংগ্রহ করি স্বপ্ন-মধুরিম নেকটার,
মঙ্গলবারে তীব্র নির্লিপ্তিতে পালন করি সংযম ব্রত—
শর্করা ও সোম করি পরিহার;
বুধবারে সংগ্রহ করি জোৎস্না নিবিড় চিত্র
সাজিয়ে তুলি নিজস্ব বুটিক,
মেতে ওঠি বৃহষ্পতিবারে জ্যোতিষ শাস্ত্রের ধাঁধায়
নক্ষত্রে খুঁজি সৌভাগ্যের প্রতীক;
শুক্রবারেও ব্যস্থ থাকি হামেহাল
ডুবুরির ধড়াচূড়া পরে সমুদ্রতলে খুঁজি হরিৎ প্রবাল,
সপ্তাহ জুড়ে করোটিতে নীড় বাঁধে অক্ষম এক আরশোলা
নদীজলে ভেসে বেড়ায় স্পর্শ-প্রয়াসী ছলে তোমার গনডোলা,
জোটে না সময়—পাই না অবসর
পারি না হতে তোমার প্রেমিক,
সংবেদনশীল নই আমি—
অভিযোগ যথার্থ—আমাকে শতধিক।
নৌকায় ভোরবেলা
ঊর্ণনাভে মোছে মুখের জলসিক্ত আর্দ্রতা
মেয়েটি ঘুমচোখে দেখে—আকাশে ফোটে উঠছে
আলোর অরুণিম আভায় বর্ণের বিধুর বসন্ত,
নিশিরাতের নৌভ্রমণে যাদুবলে যেন বদলে গেছে
তার দিনযাপনের প্রথা,
হাওয়ায় ভাসে জরির ছেড়া রিবন—
রূপালি ধারাপাতের ধূসরিমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে দিগন্ত;
দাঁড়ের তুমুল টানে শব্দ ওঠে ছল ছল…ছলাৎ ছল…
ভোরের মধুরিম আবেশে আধভাসা পাতায় হাঁটে পদ্মপিপি,
মৃদু কেকায় শিহরিত হয় নীলাভ উৎপল—
বিজুরিতে উড়ে আকাশে স্বর্ণালি সর্প,
আধফোটা কলিতে ভ্রমরের বোবাকান্নায়—
নারী হয়ে ওঠা কিশোরীর বুঝি-বা পাঁজর ফেটে যায়,
বৈঠার দাপটে তার সঙ্গীর পেশীতে ছলকে দর্প
বিস্ফোরিত হয় বাজ,
নিঝুম প্রভাতে—
কারও মুখগহ্বর থেকে বের হয় না কোনো আওয়াজ;
বিলের স্বচ্ছতোয়া জলে আস্তে-ধীরে ডুবে যাচ্ছে
বর্ষণ-স্নাত আকাশ,
আধচেনা পুরুষের সঙ্গে ভাসছে কোথায়?
মুখখানি দেখতে দেখতে হাতআয়নায়—
বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।