আরাধ্য বৃক্ষটির থানে
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি
আদিবাসীদের আরাধ্য বৃক্ষটির থানে,
নিকানো চাতালে পা ছড়িয়ে বসা যায় দুদণ্ড,
জুড়ায় শরীর-মন—
বাতাসবাহিত ভেষজের সুরভিত অনুপানে,
ক্রিস্টালে বর্ণালি ছড়ায়—পড়ে থাকা পাথরখণ্ড;
বুসানের বেওমেওসা মন্দির—
ভাবি—ঝ্যান ঘরানার শ্রমণদের কথা,
প্রকৃতির সাথে প্রগাঢ় সম্পর্ক তাঁদের
মেডিটেশনের মৌন প্রথা;
মুদে আসে চোখ দুটি
শরীরে হাঁটাচলা করে পতঙ্গ এক,
ধ্যানের নিবিড় প্রকরণে হলো কী ত্রুটি…
ভাবি বারেক,
অনুভব করি কিছু একটা জড়িয়ে যাচ্ছে দেহ
সূক্ষ সুতোর মসলিন পরশে কে যেন ছড়াচ্ছে স্নেহ..
অবশেষে মেলি চোখ—
সামান্য দূরে…
তন্তুর অন্তর্জালে বসে মাকড়শা এক…উৎসুক,
চোখের আরশিতে তার যায় দেখা—
ঊর্ণনাভে জড়ানো মুমূর্ষ মানুষ..
পড়ে আছে একা,
পারিনা ছড়াতে এ ববিনের বন্ধন
বাউরি বাতাস বয়ে আনে
হানি সাকোলের সুরভিত চন্দন।
গোল্ডেনডেইল শহরের রহস্যময় কটেজ
গোল্ডেনডেইলের ম্যাগনোলিয়া কুঞ্জে ঘেরা বাড়িটি দারুণ রহস্যময়
কাঠের কটেজের চৌকাঠে নীল ময়ূরীর চঞ্চুতে আঁকা লিপস্টিকের রেখা,
তোরণের নাম ফলকে রোমান হরফে খোদিত ‘গল্পে হয়েছে পরিচয়’
এদিকে আসি আমি হামেশা—খোঁজ নেই—তবে পাইনি কারও দেখা।
মহল্লায় হাঁটি আমি—শুনি তোরণে ঝুলন্ত উইন্ড চাইমে বাজছে জলতরঙ্গ
কারপোর্চের ভিনটেজ গাড়িটির চেসিস জং ধরে হয়েছে খয়েরি,
ডাকবাক্সে চিঠির তোড়া দেখে মনে হয় এখানে বাস করে কেউ নিঃসঙ্গ
বার্ড ফিডারের দখলি নিয়েছে সোনালি অরিওল—কাকলি ছড়ায় সে বৈরী।
ভরদুপুরে একদিন সাতপাঁচ ভেবে কাঠের গেট খুলে ঢুকে পড়ি আঙিনাতে
ভেতরে গ্রামফোনের এলপি রেকর্ডে বাজছে স্যাল্টিক গানের সপ্তসুর,
মোরাম বিছানো পথে ছড়ানো পাপড়ি—ঝরেছে কুসুম শিশির ভেজা প্রাতে
উতরোল হয় মিউজিক—বুঝিবা জিপসি নারীদের নৃত্যে মেতেছে নুপূর।
পার্লারে আর্ম-চেয়ারে বসে প্রয়াত বৃদ্ধ এক—হাতে ধরা তার ধাতব পিস্তল
টেবিলে আধ খাওয়া পাউরুটি…জলপাই…পানপাত্রের প্রেক্ষিতে স্থিরচিত্র,
দেয়াল ঘড়িটি বাজছে টিকটিকিয়ে—বয়ে যাচ্ছে সময়ের পল অনুপল
ছড়ানো যুদ্ধের কেতাবাদি…মলাটের ছবিতে পাশাপাশি বসে শত্রু ও মিত্র।
পাশের কামরায় নারী এক—মেঝের মরক্কো গালিচায় উবু হয়ে বসে
এক গুচ্ছ গোলাপে জড়াচ্ছে কাগজ—যেন শিশুটির গায়ে মুড়ছে কম্বল,
সুচারু গ্রীবায় প্যাচানো সরিসৃপ…কালো মখমলের চোকারটি পড়ছে খসে
আরশির প্রতিফলনে তাকায় সে—চোখে তার গলন্ত মোম হয়ে ঝরে জল।
পর্দা সরিয়ে আগ বাড়লে হাত তুলে থামায়—দেখি তার ডান করতল
এ বাড়িতে আসতে আমি চাইনি কখনো—এ গৃহ নয় আমার গন্তব্য,
নিরাবরণ বাহুতে উল্কি করে আঁকা প্যাপিরাসের প্রতীকে বিচিত্র ছল
দেখি তার হস্তরেখার গোলকধাঁধায় মিস্রি-লিপিতে লেখা আমার ভবিতব্য।
মেঘের কিংখাবে
স্টিম ইঞ্জিনের ঝিকঝিক বাষ্পের ভেতর—
ছেড়ে এ শহর—
আসা যেতে পারে
নাইরোবি কিংবা গ্রীষ্মময় আর্দ্র নাইজেরিয়ায়,
ম্যোপল পাতার বর্ণাঢ্য আগুনে পোড়ে চার্চ
দূরের মানুষ—কাছে এসে হয়েছ কি অসহায়?
কাঠের ক্রুশে সওয়ার হয়ে পোড়ে দেখো যিশু,
ওজু সেরে কারা তাঁবুতে জায়নামাজ বিছায়
তটে পাল তোলা পাইরেট বোট নিয়ে ভাসে মোগাদিসু।
নয় সহিষ্ণু স্থীর—
সফর নৃত্য বিশেষ—ব্যাপক…অধীর,
কত্থকের এ মুদ্রায় কখনো ঘর কখনো-বা পথ—
নৌকায় হয়েছো পার লিমপোপো নদী,
ধরেছ রাতের রেলগাড়ি—
আকাশগঙ্গার পাড়ে নেমেছে কাশফুলের শুভ্র শরৎ;
ঝরছে অতি ধীরে ম্যোপোল বিরিক্ষের রঙিন পত্রালি,
ভাটি বেলায় ভরেছে গোলা
কাটা শস্যে থোকা থোকা স্বর্ণালি,
রোডম্যাপ হাতে নাও—কদম সামনে বাড়াও…
জীবনে যার যতি হলো জোহানেসবার্গে—
মাকড়শার জালে লেগে থাকা শিশিরে
সুর বেজে ছিলো অতি নিচু মার্গে,
বাঁধেনি যে জেসমিনের কুঞ্জে জোনাক জ্বলা ঘর,
বেওবাব গাছের ছায়ায় খুড়েনি কেউ তার কবর;
আরো কিছু দূর কি যাবে?
দেখো—তার মিথুন নিক্কন মৃদুহাসি—
নীহারিকা হয়ে আঁকা মেঘের কিংখাবে।