নেকড়েটা ভেতরেই আছে
Protct yourself from your own thoughts Rumi
১.
ভেতরের খরস্রোতা নদীকে ডরাই
ঝোঁপের আড়ালে থাকা নেকড়েটা নিয়ে যত ভয়
. নেকড়েটা ভেতরেই আছে
. ভেতরেই আছে নেকড়েটা
. নেকড়েটা আছে ভেতরেই
নিজেকে সুরক্ষা দাও তার কাছ থেকে।
ঝোঁপের আড়াল থেকে উঁকি দেবে,
দেখে নেবে কতটা সতর্ক তুমি খেয়াল হারালে
খেয়ে ফেলবে সে
নেকড়েটা ক্ষুধার্ত, লোলুপ
নেকড়াটা ছল ধরা জানে
দৃশ্যত গোলাপ ফুল অগণিত ফুটে আছে, যেন
ব্যাবিলনে ঝুলন্ত উদ্যান
ধরতে গেলেই হবে লোমশ শরীর
নেকড়েটা ভেতরেই থাকে আমৃত্যু ঘাপটি মেরে
ঝোঁপের আড়ালে
দেখে নিও, নয়তো সে তোমাকেই দেখে নেবে
হয়ো না পাগলা ঘোড়া, ঝড়ের বাতাস
আত্মঘাতী সুখমুগ্ধ মেফিস্টোফিলিস
ফস্টাস, ফস্টাস, নেকড়েটা ভেতরেই আছে
সুযোগ খুঁজে সে, আততায়ী অন্ধকারে গর্জে ওঠে
তখন তোমার মাঠে ছড়ায় না আমলকিরোদ
‘মিস্টার ক্যুর্জ ইজ অ্যা রিনাউন্ড ম্যান’
০২.
তাকে তুমি সাথে নিয়ে চলো, কেন বলো?
টঙকার টঙকার
লালনীল বেদনার রাত
. অভিশম্পাত
বিলাসী বাসনা ভোলো, সংযত হও—
নেকড়েটা ভেতরেই আছে
স্বেচ্ছাচার তাকে আরো শক্তিধর করে
সে এগোয়, ড্রাকুলার পায়ে—
নিরন্তর গোপনে এগোয়
দৃশ্য ও অদৃশ্যের মাঝে
নেকড়েটা ভেতরেই থাকে
০৩.
হারতে এসেছো, তার দুর্নিবার হাতে
এসেছে কি বেকুব শিকার হতে?
দুর্গম পর্বত, ঝোঁপঝাড়, পাথরের গুহা
কালোপর্দা ভেদ করে তীক্ষ্ম-দৃষ্টি তোমার দিকেই
ঝলসানো চোখ, যেন
আগুন থেকেই তার জন্ম হয়েছিল!
সে বড় নাছোড়
সহজেই তার সাথে পারবে না
সহজেই পারবে না তার সাথে
নিজেকে সুরক্ষা দাও, দৃঢ় হও, নির্মোহ হও
চারপাশে গড়ে তোলো দুর্ভেদ্য দেয়াল
যেন না আসতে পারে টপকে, মাড়িয়ে।
ওথেলো, ওথেলো
কাকে তুমি হত্যা করে ফেলো!
নেকড়ের চেয়ে বেশি হিংস্র সেই নেকড়েটা ভেতরেই আছে
জোগান হয়ো না তার ক্ষুধ-পিপাসার
০৪.
সে শত্রু ভোগাবে চিরকাল
যদি না ইস্পাত হতে পারো।
শৈশবে যখন খেলাচ্ছলে ইট দিয়ে
মেরেছিলে ঢোঁড়াসাপ, তখনো সে ভেতরেই ছিল
তাকে দেখতে পাওনি—
জোনাকিরা মরে গেছে কাচের বোতলে
সে তোমার ভেতরেই ছিল, দেখতে পাওনি—
সে এক দুরূহ, বড় নির্দয় সীমার
অগ্নিপিণ্ড
ঘৃণা, লোভ, হিংসা, ক্রোধ তাকে করে পরাক্রমশালী, তার
ধারালো দাঁতের ফাঁকে রক্ত লেগে আছে
জঙ্গলের ঝোঁপঝাড়ে রয়েছে লুকিয়ে সাবলীল
পিতৃহন্তারক, আস্তিনের সাপ
ঈদিপাস ঈদিপাস নেকড়েটা ভেতরেই আছে
০৫.
রোদে রেখো, অন্ধকারে রেখো না নিজেকে
ব্যস্ত থেকো, অবসন্ন রেখো না নিজেকে—
কুয়াশার জাল ছিঁড়ো, গতিময় হও
তোমার ছায়ার পরে স্বর্ণসর্প হেঁটে যায় ক্রমে
অগ্নিত্রোস্ত্র পাঠ করো, পরিশুদ্ধ পবন বাসনা
ছেড়ো না, ছেড়ো না
তুমিও নাছোড় হয়ে লেগে থাকো সুরক্ষিত হতে
যদিও সম্পূর্ণ মুক্ত হতে কেউ পারেনি কখনো, তবু
অন্তত একটি খাড়া দেয়ালতো গড়তে পারবে—
ধরায় পড়েছো ধরা একদিন তাকে নিয়েইতো
০৬.
হুঙ্কার হুঙ্কার
ওই শোনো গর্জে ওঠে নেকড়েটা ঝোপের আড়ালে
আরবার বার বার
আসে আর করে ক্রাস
উল্লাস উল্লাস পৈশাচিক
ও লাউল, নেকড়েটা ভেতরেই আছে
প্রাসাদভবন ঘেঁষে শেওড়ার ঝোপ, ক্যাকটাস
সেখানেই নিপুণ ঘাপটি মেরে আছে
অসতর্ক হলে খাবে দুমড়ে-মুচড়ে
ও জন্মান্ধ, ভেতরেই আছে নেকড়েটা
অজিমেন্ডিয়াস, নেকড়েটা ভেতরেই আছে
স্বগতোক্তি
বন্ধু আমার ঢের, তবু ডোবার সময় হয় না কেউই হাতের কাছের খের। হেঁটে চলি একা, দূরে মাঠের শেষ রেখা। সেখানে এক পাখি উড়ে দূর থেকে যায় দেখা; কী করে পথ চলতে হয় তারই কাছে শেখা। সামনে একটা বন; ওই বন পেরোলে নদী, খরস্রোতা ওই যমুনা পেরিয়ে যেতাম যদি। বৃন্দাবনে একলা পায়ে হাঁটছো নীরবধী! আমি স্বপ্নঘোরে চাই, চতুর্দিকে মহাসাগর, পানের পানি নাই। বন্ধু অনেক আছে, শুধু প্রাণের কাছের বন্ধুটি আর নেই রে বুকের কাছে!
পুরাঙ্গনা
১.
তাকালে আগুন বাড়ে
না হলে তৃষায় মরি—
তোমাকে দেখার আগে
নিজেকে জড়ায় ধরি।
তুমিতো মোমের দেহ
যেনবা গোলাপ মাখা—
এসেছো ধরিত্রিতে
রাখিয়া পরীর পাখা।
২.
পাখিরা কুজন করে
তটিনী উদার বহে—
তোমাকে দেখার তরে
মেঘেরা আমায় কহে।
এ রূপে বেহুশ তারা
ছাড়ে না মাতালপনা—
আমাকে পূরণ করো
হে প্রিয় পুরাঙ্গনা।
৩.
শরতে কাশের বনে
ছড়িয়ে মেঘের ফেনা—
চলেছে জীবন বয়ে
কেবলি বাড়ায় দেনা।
আমাকে ব্যথার সাপে
কেটেছে অনেক আগে—
বেহুলা, তোমার তরে
তাকিয়ে গভীর রাগে।
আমাকে কে ভালোবাস তুমি
আমাকে কে ভালোবাস তুমি! যেনবা চুম্বন দিয়ে চলে যাও, যেন কাশফুল ছুঁয়ে যায়, আদুরে বিড়াল নরম শরীর দিয়ে স্পর্শ দিয়ে গেলো, যেন ধানশীষ দোলা নিয়ে বয়ে এলো আলতো বাতাস, বহুদিন পর বাগানে বারিষ এলো… আমাকে কে ভালোবাস তুমি! শতবর্ষ ঘুম ভেঙে যায় পাথরের, পড়ো জমি হয়ে ওঠে সুজলা-সুফলা; আঁধারে তলিয়ে থাকা সবুজ বনানি ভেসে ওঠে, যেন এক দ্বীপ; পাখি ডাকে, ঝর ঝর বয়ে চলে নির্ঝরিণী…তুমি এক প্রজ্বলিত মাছি। কেরাম স্ট্রাইক হয়ে গতিময় করো। আমাকে কে ভালোবাস তুমি!
সুন্দরের রানি
তোমার কাছেই যাই, তুমি এক অর্ধনগ্ন মূর্তি;
সুরের লহর, তাল, ঢেউ ঢেউ, স্রোত উন্মাতাল।
পাশবিক আঘাতের দাগ দ্যাখো আমার শরীরে।
আমি এক সঙ্গীহীন দ্বীপ, একা ব্যথায় সাঁতরি
এক হারমোনিয়াম, বাজি বেদনার সকরুণ সুরে
যাওয়ার কোথাও নেই কোন পথ, তোমার কাছেই
ফিরে ফিরে যাই, ওগো অর্ধনগ্ন সুন্দরের রানি
তোমাকে খুলি না সব—সবটুকু খোলাও যায় না—
অনাবৃত করা হলে সৌন্দর্য্য হারাও, তাই ঢাকি।
আবৃত অর্ধেকে থাকে রহস্যের অপার মহিমা
থাক না সেটুকু এই দৃষ্টির বাইরে, গোপনীয়।
যতটুকু খুলে রাখো, তার মধ্যে আমাকেই পাই—
যে যায় সে চলে যাক, যে আসে আসুক, আমি শুধু
তোমার কাছেই যাই, তুমি আসো, ফিরিয়ে দাও না।
শুশুক
এই শোকের নদীর গভীরে এক শুশুকের বাস; সে যখন
বিচরণ করে, তার জন্য রূপসী হয়ে ওঠে নদী, আকাশে
ফড়িং ফেরে ঝাঁক বেঁধে। একঝাঁক গাঙচিল
সাবলীল উড়ে উড়ে যায়…
চিরহরিৎ পাতাগুলো আনত হয়, চুমু খায়
এই শোকের নদীর গভীরে এক শুশুকের বাস; সে যখন
লাফিয়ে ওঠে
ঝরনা ধারার স্ফটিক জল
আছড়ে পড়ে তীরে,
স্থবিরতা কেটে যায়, গতি ফেরে, প্রবাহও ফেরে
ঝুমকা
আলোকোজ্জল ঝাড়বাতি হয়ে ঝুলে আছে সোনালী ঝুমকা ব্রম্মাণ্ডের তাবৎ সুন্দর নিয়ে। চুলের গোছার ছায়া ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে, যেনো বাঁশের পাতার ফাঁকে চাঁদ। বিচ্ছুরিত আলো হৃদয় অবধী যায় ছুঁয়ে এমন শ্যামলমুখ, কী দারুণ কারুকার্যময়, তার মধ্যে ফুটন্ত গোলাপ, বিকেলের রোদচ্ছটা; ঘোর কাটছে না… ঘোর কাটছে না…
পারাবত
ঘন কুয়াশায় ঢাকা সুদূরের পথে পারাবত
দেখো উড়ে যায়; ঝাকা ঝকাঝক ছুটে পারাবত
কতো সবুজের মাঠে দুলে যায়
কতো জলাশয় ফেলে রেখে যায়
কতো তটিনীর পানে হেঁটে যায়
উঠে দিবাকর, তবু চলে যায়
ঝাকা ঝকাঝক ছুটে পারাবত
চলে সিলেটের পথে ঝকাঝক
পাতা পাহাড়ের বুকে বাতাসের খেলা দেখে যায়
উচুঁনিচু আর আকাবাঁকা পথ মেড়ে তেড়ে যায়
কতো লেবুদের গাছে কাঁচা ঘ্রাণ
কি যে তাজা ঘ্রাণ!
কতো টিলাদের গায়ে পাখিদের দেখি বিচরণ
জাগে পাখিপ্রাণ—
আসে বনানীর শোভা ছোপাপথ
তারি মাঝে যায় সাদা পারাবত, কি যে অপরূপ!
যেনো সুড়ঙের পথে অবিকল কোনো ঢোঁড়াসাপ—
ছুটে পারাবত ঝাকা ঝকাঝক ঝাকা ঝকাঝক
হাসপাতালের ফুলগাছ
আশ্চর্য সুন্দর নিয়ে ফুটেছে পুষ্প
হাসপাতালের বাগানে!
আমি জানি, তোমার শেকড়ে হাসছেন
পৃথিবীর মুখ না দেখা কোনো শিশু
যাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার বাবা-মা
আর এখন তুমিই তাকে ভালোবাসা দিচ্ছো—
শেকড়ে জড়িয়ে রাখছো আদরে
এজন্য তোমার ফুলে আমি সেই
শিশুটির অনাবিল হাসি দেখতে পাচ্ছি
অর্ফিউসের কান্না
কুণ্ডলী পাকিয়ে যেভাবে চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ে যায়,
সেভাবেই সরে গিয়েছিলে—
নরকের পথ ধরে হেঁটে এসেছি। চারপাশে কতশত
আর্তনাদ-চিৎকার শুনেও থামিনি। শেষবার যখন পেছনে ফিরি
তখনই উধাও তুমি
অনেকটা প্রতিধ্বনির মতো
হায় ইউরিদাইস, আর কি কখনো ফিরবে না
আর ফিরবে না!
এখন এ বনপ্রান্তরে একা একা ঘুরি, বাজাই তোমার নামের
বীনা, যেন এতে কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, যেন
আমি এক সঙ্গীহীন পাখি…
ইউরিদাইস, চিরকাল এভাবেই অনিঃশেষ রোদন, আর
ফিরবে না জেনেও