উত্তরসাধক
যে আমাকে অস্বীকার করে
প্রথমত অকবি সে; দ্বিতীয়ত পরশ্রীকাতর
হয়তো সে মিডিয়াপালিত কোনও প্রাবন্ধিক; ভুলবাক্যে বুকরিভিউ করে
অথবা সে আসল কালপ্রিট, দ্যাখে বড়কাগজের লঘু সাহিত্য পাতাটি
নতুবা সে ছোট কোনও কাগজের পাতি সম্পাদক
. নিজেকে জাহির করে নিজের কাগজে
. কাগজে-কাগজে করে সখ্যবিনিময়
ওরা কেউ কবি নয়, ওদের পেছনে ঘুরে বহু প্রতিভাকে আমি নষ্ট হতে দেখি
যে-আমাকে কেবলই স্বীকার করে, বিতর্ক করে না
সে-ও কোনও কবি নয়, জেনো
যে আমাকে গ্রাহ্য করে, পাশাপাশি মধুর তর্কও
তারই মধ্যে আমি কিছু সম্ভাবনা দেখি
. সে-ও কবি নয়
কে তাহলে?
অমিতসম্ভাব্য কবি ভালোবাসে একার সন্ন্যাস
নদীর পাশে একা
আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল পথ
পথের পাশে নদী
নদীর পাশে নৌকাবাঁধা ঘাট
ঘাটের পাশে শেষপারানির কড়ি
গাছঠাকুরের পুজো
দাঁড়িয়ে ছিল হাজার অমারাত
দেউটি হাতে একলা মাঠের চাঁদ
দূরে কোথাও বৃষ্টিভেজা ঘর
টিনের চালে বিঠোফেনের চিঠি
কোথাও একটা জানলা খুলে রাখা
কোথাও একটা কাঁকন-পরা হাত
কোথাও একটা উড়ে যাবার সাধ
দাঁড়িয়ে ছিল কেমন-করা মন
মনের তলে মনের তলদেশ
তার অতলে হঠাৎ কারও মুখ
হঠাৎ কারও রাত্রি-চেরা ডাক
হঠাৎ কোনও নারিকেলের পাতা
ঠাণ্ডা-লাগা একজোড়া টনসিল
দাঁড়িয়ে ছিল ভুবনজোড়া মায়া
অষ্টরানির মৃত স্বামীর ছবি
শাদা ফ্রকের রিবন-বাঁধা চুল
কোল-বদলের ধূসর ছেলেবেলা
অতীত-করা হাজার গতকাল
আষাঢ়-করা শ্রাবণ-করা মন
আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল পথ
পথের পাশে নদী
নদীর পাশে মানুষ কেন একা ?
মানুষ কেন একা ?
বাঙলাদেশ
বাঙলাদেশ বড়ো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। ওকে
অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে
ভূত সেজে ভয় দেখিও না
ওর বুক ধড়ফড় করে।
তোমাদের একটুও কাণ্ডজ্ঞান নেই—
অকস্মাৎ একেকটা ঘটনা ঘটিয়ে বসো, আর
মেয়েটার চোখ, মুখ, সমস্ত শরীর
প্রস্ফুটিত লাবণ্য হারায়।
ও বড়ো আহ্লাদী মেয়ে
সবুজ ফিতেয় চুল বেঁধে প্রতিদিন
পা দোলায় বঙ্গোপসাগরে।
জল, পলিমাটি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে।
কারও সঙ্গে বিরোধ করে না।
তোমরাও বিরক্ত কোরো না ওকে। ওর
খেলার সংসার
তছনছ করে দিয়ে উধাও হয়ো না।
ফের সব সিজিল-মিছিল ক’রে ওঠা
একরত্তি মেয়েটার পক্ষে খুব কষ্টকর কাজ।
বাংলাদেশ বড়ো শান্ত মেয়ে
কারও সঙ্গে খুনসুটি করে না কখনও
নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালোবাসে।
কেউ ওকে চুল টেনে ঢিল ছুড়ে বিরক্ত কোরো না।
অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে
ভূত সেজে ভয় দেখিও না।
অবিরাম কষ্টপাত
কেউ ডাকল না, কেউ বলল না, ‘এসো;
যদি ভালো লাগে, নির্ভয়ে ভালোবেসো।’
গাছে পাখি নেই, পাখি-ডাকা নেই আর
কেউ জানল না, আমি কার আমি কার।
আমি কারও নই, শুধু তারও নই দূরে
বসতি আমার ব্যথার সমুদ্দুরে।
আছাড়িপিছাড়ি ঢেউ মাথা ঠুকে-ঠুকে
মরছে ফেলেছেট বেওয়ারিশ সিন্দুকে।
কেউ থামল না; কেউ দেখল না এসে
কে পোড়াবে আর কে পোড়ে নিরুদ্দেশে।
সময় কি আর নদী, আছে নিরবধি ঢেউ?
আজও এতটুকু, ‘এসো’বলল না কেউ।
মোহরপ্রার্থী
ভিক্ষা যদি করিই, হব রাজভিখিরি
. সোনার থালা ধরব মেলে—
দিতে চাইলে মোহর দিয়ো রাজকুমারী
মোহর দিয়ো, মোহর দিয়ো. মোহর দিয়ো।
কানাকড়ির চাইতে আমার শূন্য থালা, সোনার থালা
. অনেক দামি
তাই সামান্য দিলে আমার ভরবে না মন;
ভিক্ষা যদি করিই, তুমি মোহার দিয়ো।
রাজকুমারী, তোমাকে চাই। নেই অর্ধেক রাজত্বে লোভ।
রাজমুকুটের লালসা নেই; সিংহাসনে বসার চেয়ে
তোমার পায়ের কাছে বসে থাকা
. অধিক প্রিয়।
তাই সামান্য দিলে আমার ভরবে না মন;
ভিক্ষা যদি করিই, তুমি মোহর দিয়ো।
কবিতাবিষয়ক সেমিনার
ধর্ষকামমত্ত ছিল তারা
আহা প্রাজ্ঞজনা, কত বিত্তশালী সমালোচনায়।
ও বোন কবিতা, তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?
এ যদি উপমা খোঁজে, বাকিগণ রূপকসন্ধানী
এ যদি কৈবল্যবাদী, বাকিগণ ছন্দবিশারদ
এ যদি শৃঙ্গারপ্রিয়, বাকিগণ সঙ্গমবিলাসী
এ যদি করেছে চিৎ, বাকিগণ উপুড় করেছে
সাধু, সাধু, প্রাজ্ঞজনা…কামশাস্ত্রে পার্থক্যখচিত
ধর্ষকামমত্ত ছিল তারা
আহা প্রাজ্ঞজনা, কত বিত্তশালী সমালোচনায়।
ও বোন কবিতা, তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?
বৃক্ষসংহিতা
০১.
শাস্ত্র আসে শাস্ত্র যায়; প্রত্ন হয় পতঞ্জলি মুনি
নিসর্গের কণ্ঠে আজও চিরহরিৎ বৃক্ষকথা শুনি।
০২.
শতভুজ বৃক্ষ আমি; উড়ে চলি সহস্র ডানায়
প্রার্থনার হাত পেলে পূর্ণ করি কানায়-কানায়।
মাটি-বংশধর
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা
আমার বাপের নাম কে না জানে, চাষা-মালকোঁচা
আমি গামছা-কুমোরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী যত নিম্নজনা
ধুতি-গোয়ালারা জ্ঞাতি, আরও জ্ঞাতি খড়ম-তাঁতিরা
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা।
বারোভাজা তেরোভাজা তোমাদের তেলেভাজা বুদ্ধি-বিবেচনা
আমাকে ছোঁবে না—আমি কাঁচামাছে, পোড়ামাংসে বাঁচি
আমার বউয়ের নাম কাঁচাসোনা; তোমাদের মতো বুকে কাঁচুলি পরে না
স্তনে মুখ ঘষে দিয়ে চলে আসি; ঝাঁপিখোলা-ঝাঁপিবন্ধ নেই।
মাটিভাষাভাষী শস্য, লতাগুল্ম, বৃক্ষ, বনরাজি
আমাকে শেখায় বীজমন্ত্র; আমি শরীরের মাটিভাষা জানি
মাটি মাতৃভাষা আমি সে-ভাষায় সোঁদাগন্ধ পুঁথি পাঠ করি
যা পড়ি শেকড়ে পড়ি; বাকলে লিখি না নাম তর্জমাবশত।
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি; জন্ম মাটি-বংশধরে
মুখে খিস্তি-খেউড়ের দোচোয়ানি—ব্যাকরণে ঢেঁকুর তুলি না।
বালিকা আশ্রম ০৪
চাঁদ গিয়েছিল বালিকাবিহারে
মন গিয়েছিল মনে
একখানা রাত ভোর হয়ে গেল
টেলিফোনে-টেলিফোনে
সব জানালার বাতি নিভে গেলে
একটি জানালা বাকি
থেকে যায়; আমি সেই জানালায়
তারাদের ছবি আঁকি
আমার তারারা উজালা বালিকা
ঘন-ঘন প্রেমে পড়ে
একটি কবিতা ডুব দিয়ে ওঠে
রাত্রির সরোবরে
একটি দরোজা তারপর থেকে
সিঁড়িঘরে আড়ি পাতে
কবিতার খাতা সমকাল আঁকে
পুরাণের পৃষ্ঠাতে।
বালিকা আশ্রম ০৬
বুকের ঊনপঞ্চাশ পৃষ্ঠা খোলো:
এটা একটা বিষাদের নদী; অভিমানের পাহাড়ে তার বাড়ি
চোখের এক শ বত্রিশ পৃষ্ঠায় যাও:
এটা একটা সাইকেলের গল্প; বালকের পঙ্খিরাজ ঘোড়া
থুতনির বিরানব্বই পৃষ্ঠা ওল্টাও:
এটা একটা বর্ষার কবিতা; প্রথম চুম্বনের জলরঙে আঁকা
চুলের এক শ ঊনসত্তর পৃষ্ঠায় থামো:
এটা একটা রাত্রির গীতিকা; এখানেই চন্দ্রাবতী ফোটে
চলো তবে পরিশিষ্টে যাই:
এটা একটা কীটদষ্ট অধ্যায়; তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না
সুসঙ্গ দুর্গাপুর ২০০৮
সুসঙ্গ রাজারা নেই; পড়ে আছে প্রাসাদের খোসা
এখনও টংকর মাঠে অগণন ভাঁটফুল ফোটে
ঝাঁক-ঝাঁক কবি ওড়ে দেশওয়ালী পাড়ার আকাশে
কবিকে তেওয়ারী টানে; সোমেশ্বর পাঠক টানে না
দুর্গাপুরে এবারই প্রথম পথে সোমেশ্বরী পালা
দুর্গাপুরে এবারই প্রথম ওঠে উর্দিপরা ঝড়
দুর্গাপুরে এবারই প্রথম কবি উদ্বাস্তু শিবিরে
দুর্গাপুরে এবারই প্রথম কাঁদে বন্দি বিরিশিরি
করিরা উদ্বাস্তু হলে মাঠ-মাঠ খরা নামে দেশে
হ্যালো মেঘ তুমি কি মৃণাল বসুচৌধুরীকে চেনো?
সৎ ছিল বলে লোকটা সতর্ক ছিল না
অসতর্ক ছিল বলে হিসেবী ছিল না
হিসেবী ছিল না বলে কবি
কবিরা উদারহস্ত; রাজারা ভিখিরি
হ্যালো কালিদাস, হ্যালো রাজাদের সারিবদ্ধ করো
আমি ও মৃণাল বসু দানসত্র খুলে বসে আছি