এক.
জল ভালোবাসলে যেমন অচেনা লোকালয়, বনানী কিংবা উপত্যকায় অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা পাওয়া যায় নদীর, তেমনি—পূরাতাত্ত্বিক সাইটের ভূগর্ভস্থ নকশায় নিরিখ করে নজর দিলে পাওয়া যেতে পারে, জীবাষ্ম হয়ে যাওয়া রুকাশুখা সরোবরের। ভোর-বিহানে বেরোই আমি, চীনদেশের প্রান্তিকে, তিব্বতী প্লাটোর কাছাকাছি—নাসি গোত্রের গ্রামটির আধজংলা শিথানে, যদি-বা খুঁজে পাই নিদেনপক্ষে কোন ছড়া-নদী, অথবা বনানীর সবুজাভ ছায়াভাসা জলপ্রপাত।
দুই.
প্রকাণ্ড এক বনষ্পতির ডালপালা ছড়ানো ঝুলবারান্দা থেকে নেমে আসা দুটি ঝুরিতে তৈরি হয়েছে রীতিমতো তোরণ, ভেতর গলে খানিক সামনে এগুতেই, যা চাই, সত্যিসত্যি দেখা মেলে তার। পাহাড় থেকে পড়িমরি নেমে আসা প্রপাতের ছিটকানো জলকণায়—ফড়িংয়ের ডানার মতো উড়ছে দিনের নওল কিরণ। তলায় পাওয়া যায়—স্বচ্ছতোয়া একটি পাতকুয়োও। নিমিষে দৃশ্যমান হয়, ডানকানা মাছের চমক-জাগানিয়া ঝাঁক। জলতলে প্রসন্ন আলোয় রুপালি দ্যুতিতে দীপ্যমান কিছু মুদ্রাও।
তিন.
কথা বলার প্রেষণা থাকলে, ভিনদেশের বেগানা ভাষা সৃষ্টি করে না তেমন কোনো অন্তরায়। দেখি, কূপ-সংলগ্ন জলের পরিখা থেকে জলন্ত ধূপকাঠি হাতে বৃদ্ধা এক—ভিজে পায়ে পাড়ে উঠে এসেছেন। ফোকলা দাঁতে বুড়ো-সুড়ো মানুষটি হাসলে, তাঁর মুখের মাংসপেশীতে কম্পন তুলে লেজ নাড়ে অলীক টিকটিকি। কপালে দু-হাত ঠেকিয়ে তিনি জলে ছুড়ে দেন একটি ধাতব মুদ্রা। আমাকেও তিনি রেজগি কড়িপাতি কিছু জলাঞ্জলি দিতে—ইশারায় উৎসাহিত করেন। পকেট উল্টে জানাই, দুঃখিত দিদিমা, খুচরা ভাংতি নিয়ে বেরোইনি যে পথে…
চার.
কোমরের পেটিতে আটকানো বটুয়া থেকে বের করে আমার হাতে তুলে দেন তিনি—চীনের টাকশালে মিন্ট করা ঝকঝকে একটি সিকি কিংবা আধূলি। জলে ছুড়ে দিতেই ছত্রখান হয় ডানকানাদের ভাসমান বৃত্ত। প্রপাত-সলীলে সৃষ্ট পাতকূয়োর পাশে দাঁড়িয়ে ভাবি, রুপালি রেজগির বিনিময়ে প্রসন্ন হবে কি ভাগ্য, নাকি নিরাময় হবে ক্রনিক আসুখের? ইশারায় কথা বলেন ফের, শতাব্দীর শেষ মাইলফলকের দিকে হেঁটে যাওয়া মানুষ; তাঁর আহ্বানে তাকিয়ে দেখি, কাছেই এক কুটিরের কার্নিশে ঝুলছে লোহিত রঙের ফানুস।
পাঁচ.
নির্বাক ইশারার থুরথুরে মানুষটি তাঁর ঘরে যেতে ডাকেন। চোখে চোখ রেখে যেন বলতে চান, ভোরবেলা হেঁটেছ অনেক, খিদে তো পাবেই। ঢুকি—মাত্র দু’কামরার কুটিরে। বোধ করি নাতনি, সামনে এনে রাখে নোডুলসের বাটি। চপস্টিক দিয়ে বৃদ্ধা দেখিয়ে দেন, চীনাপদ্ধতিতে ভোজনের কলাকৌশল। ভাবি, আমার ভ্রূণ সৃষ্টির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল যে বিধিলিপি, তাতে নির্ধারিত ছিল কি নাসি গোত্রের বয়োবৃদ্ধার সান্নিধ্যে প্রাতঃরাশ?
ছয়.
নাতনি একখানা সাদাকালো অ্যালবামও মেলে ধরে। পৃষ্ঠা ওল্টাতেই, মুখের মাংসপেশীতে তুমুল কম্পন সামলানো নারী রূপান্তরিত হন তরুণীতে। মনে হয়, পড়াচ্ছেন শিশুদের পাঠশালায়। পরের পৃষ্ঠার বয়স কমে যায় তাঁর বছর সাতেক। পদ্মের প্রস্ফুটিত ডাঁটি হাতে মন্দিরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। একটি আলোকচিত্রে চেয়ারম্যান মাওয়ের রেডবুক-হাতে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতেও যায় দেখা, প্রেক্ষাপটে উড়ে অজস্র লোহিত পতাকা। দেখতে দেখতে ভাবি, যখন চলে যাবো একেবারে, তখন আমার যাপিত জীবনের অ্যালবাম দেখাবে কি আত্মজাপ্রতিম কেউ, দূর দেশ থেকে আসা অজানা কোনো আগন্তুককে?
সাত.
পাওয়া যায় এক পেয়ালা সবুজাভ চা। জানালা গলে কিছু আওয়ারা আলো আঁকছে দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটিতে ঝলসানো বৃত্ত, নিহারিকার বলয়ের মতো বিচ্ছুরিত হয় কিরণ। সিল্কের মিহি ঝাড়ন দিয়ে বৃদ্ধা, আলতো করে মুচছেন কাঁচের জার। ভেতর থেকে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় অ্যারেঞ্জ বর্ণের জোড়া গোল্ডফিস! চোখে চোখে কথা হয় ফের, কিন্তু মীনদম্পতির বন্দিত্ব কিংবা কাঁচের ওপার থেকে উপস্থাপিত বর্ণবিভা সম্পর্কে তাঁর অভিমত কী—জানতে পারি না তেমন কিছু!
আট.
মনে পড়ে, ফরাসি চিত্রকর মাতিসের চিত্রকলা, পত্রালির সবুজিম ছায়ায়—বিভ্রান্ত হয়ে বউলে ভাসছে তিনটি স্বতন্ত্র গোল্ডফিস; ছড়াচ্ছে কি তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন বর্ণলীলা, না কি নীরবে অনুধাবন করছে স্বর্গচ্যুত অভিবাসনের অভিজ্ঞতা? মীন দম্পতিকে প্রপাতের বহতা জলে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা যেতে পারে, কিন্তু জানি না যে, যথাযোগ্য পরিভাষা কিংবা সামাজিক রীতি-কৌশল-প্রথা। অনুভব করি, প্রাণপণে চাইলেও কিছু আকাঙ্ক্ষা সংসারে থেকে যায় অপূর্ণ, আরশির দিকে ধেয়ে যাওয়া আলোর কড়িবরগায় খেলা করে প্রজন্মের ধূলিচূর্ণ।