নাম তার সুরবানু
০১
নাম তার সুরবানু, এ গাঁয়ের মেয়ে সে
এ গাঁয়ের মায়া যেন বাড়িয়েছে সে এসে
পুঁইপাতা রঙ আর
লাউলতা ঢঙ তার
বাতাসের সাথে দোলে যেন দোলা পেয়ে সে
নাম তার সুরবানু, এ গাঁয়ের মেয়ে সে।
কী মোহন ঝলমল
টলমল টলমল
চোখ তার, মুখখানি লাবণ্যে ঢলমল
তার চুল তুলতুল, এলোমেলো চঞ্চল
তার শাড়ি ওড়ে লাল বাতাসের অঞ্চল
তার হাসি যেন ঘাসফুলদের ঝিলমিল
তার খুশি নেচে ওঠে, হেসে ওঠে খিলখিল
স্বপ্নিল ফুল আর পাখিদের চেয়ে সে
নাম তার সুরবানু, এ গাঁয়ের মেয়ে সে।
এ গাঁয়ের ধানক্ষেতে বাতাসের ঝিরঝির
বাঁশবনে কচি পাতা নেচে ওঠে তিরতির
লাল লাল বটফল ঝরে পড়ে টুপটাপ
সোনারোদে আকাশের মুখ ভারী চুপচাপ
আনমনে বুনোফুলে ভোমরার গুঞ্জন
বিমোহিত চারদিক উন্মন উন্মন
তার সাথে মেতে থাকে নেচে আর গেয়ে সে
নাম তার সুরবানু, এ গাঁয়ের মেয়ে সে।
তার মুখ পানপাতা, শিশিরের টলমল
তার পায়ে নদী বাজে কলকল কলকল
তার কথা দোয়েলের মোলায়েম শিসটি
তার অভিমানভরা আষাঢ়ের বৃষ্টি
তার মন সাতরঙা রঙধনু সৃষ্টি;
সাতরঙা রঙধনু এ গাঁয়ের মেয়ে সে
তার হাসি খুশি আহা, কেড়ে নেয় কে এসে?
০২.
নাম তার সুরবানু, যে গাঁয়ের মেয়ে সে
সে গাঁয়ের হাসিখুশি কেড়ে নেয় কে এসে?
দুই চোখ জলে ভরে
আঁকাবাঁকা পথ ধরে
একদিন এক ঘুমভাঙা ধলপহরে
সুরবানু গ্রাম ছেড়ে চলে এলো শহরে।
এ শহর চকচকে
রঙ মেখে ঝকমকে
আলো জ্বেলে উজ্জ্বল সপ্তসুবর্ণা
ছড়িয়েছে আনন্দে উচ্ছল ঝরনা
আর কালো কুচকুচে
চোখ থেকে জল মুছে
সুরবানু হেসে ওঠে
ঢেউ তুলে দুই ঠোঁটে
বলে-ও মা, এতগুলা লাল নীল বাত্তি
কারা জ্বেলে রেখেছে গো? দিন নাকি রাত্তি…
দিন নাকি রাত্রি-সুরবানু ভুলে যায়
আঁচলের স্বপ্নের গিঁটগুলো খুলে যায়
লাল-নীল বাতিগুলো জ্বলে ওঠে লক লক
এ শহর গ্রাম নয়, ইটে কাঠে ঠক ঠক
এইখানে হাসি নেই খুশি নেই, খালি রাগ
সারা পিঠে জেগে ওঠে নীলসিটে কালো দাগ।
এইখানে বাঁশপাতা কাঁপে না তো তির তির
বটপাতা মোলায়েম বাতাসের ঝির ঝির
শব্দের শিহরণে হয় না তো উন্মন
নেই বুনোফুলে নীল ভোমরার গুঞ্জন
সোনারঙ ধানক্ষেতে ঘাসফড়িঙের ঝাঁক
গুনগুনে মৌমাছি, টুপটুপে মধুচাক
নেই নদী নিরবধি ঢেউয়ের কল-কল
নেই পানপাতা মুখ লাবণ্যে ঢলমল
নেই ফুল প্রজাপতি দোয়েলের শিসটি
নেই অভিমানভরা আষাঢ়ের বৃষ্টি
সাতরঙা রঙধনু জ্বলে উঠে নিভে যায়
ডাকে যেন-সুরবানু, আয় বাছা ফিরে আয়!
ফিরে যাবো? সুরবানু ভাবে-না না, যাব না
এ শহর ছেড়ে গেলে খাওন যে পাব না!
আগামীকাল সকালে
কতবার বলব তোকে
তুই কি আর শুনিস কানে?
বলেছি এই বাগানে
প্রতিদিন খুব সকালে সুয্যি ওঠার আগে উঠে
নিমেষে আসবি ছুটে
তা কি তোর কানে ঢোকে?
তুই এমন কাণ্ড ঘটাস
আমাকে শুধুই চটাস
তখন তো খুব রেগে যাই, মুখ দিয়ে যা
আসে, তাই বলেই ফেলি
তুই তখন ফুলতে ফুলতে
হয়ে যাস বেলুন ফটাস
শুকনো কাঠির মতো
বেঁকে যাস, ভাঙিস মটাস।
বাগানে বকুল ঝরে
সারারাত বকুল তলায়
ভেবেছি ধলপহরে
দু’জনে মজা করে
দু’হাতে ফুল কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে মালা গেঁথে
সে মালা পরবো গলায়।
ও মা, কী ঘুমকাতুরে
মেয়ে তুই বল তো দেখি!
সারারাত নাক ডাকিয়ে
ঘুমুলি পিঠ বাঁকিয়ে
তবুও সকাল বেলায়
ঘুম ভাঙিয়ে আনতে গিয়ে
ঝক্কি সে কী!
আসলেই কুঁড়ের ঢেঁকি।
ঠিকাছে, কী আর করা? রোদ তেতেছে
এখন তো বকুল তলায় খুঁজতে গেলেও ফুল পাবো না
ওদিকে আর যাবো না
তারচে’ চল নদীর পাড়ে
দু’জনে বসি গিয়ে
কাশবনে ডিম পেড়েছে
চন্দনা শালিক টিয়ে
পালতোলা নৌকোগুলো হাওয়ার টানে নেচে নেচে
উত্তরে যাচ্ছে ভেসে
রুপালি ঢেউগুলো খুব ছলাৎ-ছলাৎ
খুশিতে উঠছে হেসে
আকাশটা পানির গায়ে এক্কেবারে
যেন ঠিক মিশে গেছে
সেখানে শাদা-কালো নানান রঙের
মেঘেরা ঘর বেঁধেছে
তুই তখন আনমনে খুব
তাকাবি নদীর পানে
নীরবে বসে বসে কাশের ডগা খুঁটবি নখে
আর আমি ঘাস থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে
তোর বেণীতে গেঁথে দেবো ফুলগুলোকে।
দুপুরে বাড়ি যাবো
বিকেলে আসবো না আর
আগামীকাল সকালে
বাগানে আসিস যেন
নইলে ঠিক ধরে নিস
তোর সাথে আড়ি আমার।