আয়ুর কাঙাল এ মন
কী করে হাসব, রাঙাব মন মৌনতার নিরুত্তাপ দিনে!
মৃত্যুর দাঁতে কাটা জীবন আয়ুর কাঙাল;
অনুষ্ণ ঠোঁটের জমিনে ফোটে কি গোলাপ?
রঙিন জলের ভাসমান পৃথিবীতে
নিজেকে বদলায় যারা পোশাক বদলানোর স্বভাবে;
ভাষার ভদ্রতা খুলে কোথায় রাখে দু’চোখ?
শ্যাম্পেইনের স্রোতে ভাসছে কথা
বিবেকে বিঁধে থাকা মানবিক বিশ্বাস!
অপাঙ্ক্তেয় এ আমার বিষাদ বিমূর্ত মুখ
নৈরাজ্যের নিষ্ঠুর আক্রমণে অর্ধ্বমৃত মুমূর্ষু মন
প্রতিদিন ভাবি দূরে কোথাও চলে যাব।
কোন দিকে কোথায় যাব!
ঘুনে ধরা পৃথিবী; ফুঁসে ওঠা সমুদ্র
বিষবাষ্পের এই তপ্ত বায়ুমণ্ডল!
একদা যে বুকে নদীও পেয়েছে ঠাঁই
নরম-নীরব-শান্ত শ্যামলিম গ্রাম
নিদ্রাহীন যন্ত্র-সভ্যতার উত্থানে
সেও এখন প্রাণহীন কংক্রিটের শহর!
চলে যাব কোন দিকে কোথায় যাব
চিত্তশূন্য নৈরাশ্যের নিষ্ক্রিয়তায়
পড়ে আছে অগণিত অসম্পূর্ণ পথ
অতঃপর কেবলই ঘোর;
ঘোরের ভেতর ভুলে ও ব্যর্থতায়
. ফুরিয়ে যায় সময়!
সবুজ সংসার
একদিন অরণ্যের কোলে ছিল আমাদের সবুজ সংসার।
রোদেলা আকাশ মেঘ বৃষ্টি নদী ও ঝর্ণার ধারাপাত আর
মাটির আদর্শ লিপি পাঠ করা এই আমি
বুনোফুল ও পাতাদের রঙ দেখিয়ে
মা আমায় দিন পঞ্জিকার হিসাব বোঝাতেন!
পাখিদের সঙ্গীত মুখর সকাল-সন্ধ্যায়
কী করে বদলে যেতো দিন;
এক বর্ষা ডিঙিয়ে আরেক বর্ষা
এক বসন্ত গিয়ে আসতো আরেক বসন্ত!
মাঝে মাঝে সময় থমকে যায়;
ফেলে আসা স্মৃতির টানে বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পেছনে তাকায়,
যেভাবে আমার সরল বিশ্বাসে
আজও স্থির নুড়ির নূপুর পরা দুরন্ত শৈশব!
আমি এখনো আচমকা পাখিদের সুরে গেয়ে উঠি,
চেনা সব বৃক্ষের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকি
যদিও সে চিৎকার শোনে না বাতাস;
ইট-পাথরের এ নাগরিক দেয়াল ভেদ করে
আসে না ফিরে একটিও প্রতিধ্বনি!
আজ আমার নিজের দিকে তাকাতে লজ্জা হয়,
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি পাখিরা কোথায় যাবে?
কোন শূন্যতায় বাঁধবে ঘর?
বৃক্ষের পাঁজরে জ্বলছে আগুন
উজাড় অরণ্য পাহাড় বনভূমি!
আজ আমার নদীর দিকে তাকাতে লজ্জা হয়,
দেখি যখন মাছশূন্য
জাল হাতে ঘরে ফেরা জেলের বিষণ্ন মুখ
গায়ে তার মাছের আঁশটে গন্ধের বদলে
লেগে থাকে নষ্টজল দগদগে পঁচনের
দাগ।
আজ আমার নিজের দিকে তাকাতে ঘৃণা হয়,
শুনি যখন মৃৎশিল্পের মায়ায় মাটিহীন কুমারের হাহাকার!
স্তব্ধ তাঁতীর সুতোহীন বিপন্ন তাঁত
স্বপ্ন পোড়া মাঠে ফসলের ধূসর কঙ্কাল
কৃষকের জলজবা চোখের উঠোনে চেতনার শূন্য চাতাল!
আজ আমার মাটির দিকে তাকাতে লজ্জা হয়,
তবু হন্য মনে একমুঠো মাটি খুঁজি;
কোথায় আছে এটেল দোঁআশ পলি মাটি?
দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে
বলব তাকে, আমাকে ক্ষমা করো মাটি, ক্ষমা করো মা!
তোমার কোমলতা ঝলসে দিয়ে সভ্যতার নামে
আমিই তৈরি করে চলছি ক্রমাগত
আমার অনিবার্য পতনের শেষ সিঁড়ি!
আজ আর আকাশের দিকেও তাকাতে পারি না,
যদিও খুঁজছে তাকে স্তব্ধ ডানার চঞ্চল আবেগ
কোথায় সে আকাশ;
যার উদার আদিম নীলে চোখ রাখতেই বৃত্তবন্দি
বেদনা ভেঙে উড়ে যেতো মুক্ত বিহঙ্গ মন!
এ আকাশ এখন সভ্যতা ধ্বংসের রিমোর্ট কন্ট্রোল ধরে আছে;
সে এখন আগুনমুখো পারমানবিক অস্ত্র
আর মৃত্যুময় বোমারু বিমানের ঘাঁটি!
আহা মানুষ! কী আশ্চর্য এক জীব;
জীবনের বদলে মৃত্যুকে ভালোবেসে
চিরকাল নিজেই করে চলে আত্মহত্যার আয়োজন!
নতুন কবিতার জন্ম চিৎকার
শিল্পে মোড়ানো নিষ্ঠুরতায় বিমুখ হৃদয়
বিবর্তনহীন এই বিষণ্ন বিষাদের অন্ধকারে
কোথায় চলেছ পথিক? কোন্ দূরস্পর্শী অন্বেষণে
কী খোঁজো এদিক ওদিক বেহিসেবী অনিয়মে
জনে জনে সহস্র মনে কোন্ সে প্রেমে মেলে অমৃত সুখ!
কে রাখে খোঁজ দৃষ্টির দূরত্বে মন কতটা আকুল!
যুক্তির বিচার মেনে উপশমহীন অসহায়
অহেতুক সাজানো ঘর গেরস্থালি, শান্তির উদ্যোগ
এগুলো একবিংশ শতকের কয়েদখানা, বহুতল কবর
আকাশের সীমা পরিসীমা ছুয়েছে দেখো!
এখানে ব্যর্থ জীবনের খড়কুটো খোঁজা দিন
ইন্দ্রিয় আগুনে পোড়া সত্যের স্বগতোক্তি শোনা
ফাঁসির মঞ্চের মতো, কত কী দেখে যায় প্রহরী দু’চোখ
শিল্পীত ছোবলের নীল বিষ হাসির ভেতর
কত কী দখলের হাতবদল হয় নীরব যুদ্ধে-প্রতিযোগিতায়
এখানে দিন পঞ্জিকা নেই, নেই নতুন কবিতার জন্ম চিৎকার
কালো কাফনে মোড়ানো একেকটি দিন
যেন হাঙরমুখো নরক থেকে উঠে আসে
আজন্ম ঋণের অধীনে কত যে শব্দ এসে ফিরে যায়!
শাসনের শৃঙ্খলে কে পারে বাঁধতে বলো সময়ের মহাস্রোত
কবির উচ্চতা কে পারে মাপতে বলো অর্ধ মানুষের মাপে
এদিকে তাকাও, বিষনাশক আমার এ দু’চোখেই রাখো চোখ
এ চোখে পৃথিবীর জন্ম-তারিখ আছে লেখা।
জটিল কথার জট, নাগরিক ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ভেতর
আমাদের একান্ত কথাগুলো অশ্রুপাতের মতো অনুভবে
যে ব্যথা, ব্যর্থতা নতুন চেতনার জন্ম দেয়
দেয় আকাঙ্ক্ষার ডানায় উষ্ণতা
জানি না কী তার অনিবার্য উপমা
শুধু যুক্তির অতীত নেপথ্য থেকে নেপথ্যের স্বভাব খুঁড়ে খুঁড়ে;
এসো নামি তার গভীর গভীরে।
পরস্পরের তৃষ্ণা যেখানে সেখানে জীবন অন্তহীন
সেখানে মরণ মহত্তম।
এদিকে এসো, আমার দু’হাতেই রাখো হাত
নিঃশব্দে খসে যাওয়া সময়ের অন্তঃস্থলে
দেব সবুজ আলোর নতুন পৃথিবী, অমরত্বের অনুভব
যে বাঁকে ভাষার বদল পায়ের ঠিকানা লেখে দূর্বাঘাস
সে পথে এসো, পোয়াতি কলমের আঁতুর ঘরে
পুনরায় জন্ম নেবে কবিতার সোনারি ইতিহাস!