ধানকুড়োনি মেয়ে
ইঁদুরের সংসারে হাত পাততে গিয়ে
রক্তাক্ত আঙুল নিয়ে ফেরে
ধানকুড়োনি মেয়ে।
ওর রক্তে যেন আসমান ও লাজুক হয়ে
গোলাপি হয়,
সূর্যাস্ত এনে দেয় অধোবদনে!
ইঁদুরের সংসারে হাতপাতা ধানকুড়োনি মেয়ে
খুদের চালের আধো পেট যার সম্বল,
মাঝে মাঝে আফসোস করে—
কেন চেয়ারম্যান বাড়ির গরুটা হলো না;
তবে তো পেটপুরে খাওয়া যেতো
দু’বেলা ঘাস, ভূষি।
গরুর গামলায় রাখা ফেনের কথা ভাবতে ভাবতে
খুদের চালের আঠা যায় মজে,
ফেন মজে গেলে
ধানকুড়োনি মেয়ে কাঁদে
গরম ফেনে নুন খেয়ে সে বাঁচে।
ফসল কাটা হলে জমিনে জমিনে সে হাঁটে
প্রতিটি আইলে তার পায়ের চিহ্ন গাঁথে।
ছোট ছোট গর্তে হাত ঢুকে যায়
ন্যাকড়া বাঁধা ঘুম জাগানিয়া আঙুলসহ।
ইঁদুরের ঘরে সাপেরা ঘুমিয়া থাকে!
আহত আঙুলের ব্যথা তীব্রতর হয়ে
ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট শরীরে
সাপের বিষে নির্মম ঘুম নেমে আসে
মুখ থেকে উগরে দেয় জাউয়ের মতো ফেনা
এ ফেনাই মজে গিয়েছিল বোধহয় উনুনে।
হেমন্তের হলুদ মাঠে,
নীল হয়ে ধানকুড়োনি মেয়ে শুয়ে থাকে
নীলাকাশের নিচে,
উত্তরের হিম আদর বোলায়
তার অপুষ্ট গালে।
এক থালা ভাত
শ্যাওলা জমা পুকুরের মতো
ধনিয়াপাতা ছিটানো ডালের বাটি সামনে রেখে,
পোষা টিয়ের ছানার মত সুদর্শন কাগজী লেবু চিপে
আমি বসে পড়ি।
খিদের সময় দস্তরখানাটাকে
পানিপথের বিজয়ী ময়দান বলে মনে হয়।
মা গাছ থেকে অসংখ্য শিউলি ফুল পেড়ে আনে
অথবা হাঁড়ি থেকে ঢালে ভাত—
দাদু বলেছিল,
‘যে মেয়ে ভাতের মতো মুড়ি আর
মুড়ির মতো ভাত রাঁধে তাকে ঘরে নিতে নেই।’
দাদু অন্নপূর্ণা খুঁজে এনেছিল ঠিকই;
এখন দাদু আর আমি একসাথে ঝরঝরে ভাত খাই,
ভাতগুলো যেন রাজহাঁস,
ওরা ফেনে ভিজলেও শুকনো হয়ে থাকে।
এক থালা ভাত থেকে কুয়াশা উড়তে থাকে।
উষ্ণ কুয়াশায় আমি মায়ের মুখ দেখতে পাই।
মুখটা কি শিশিরে ভেজা?
না কি ঘাম?
ধান ভানার দৃশ্য
এখানে এত সোনালি ধানের বর্ণ যে
বধূরা যখন উঠানে ছড়ানো পাকা ধানের মাঝে হাতড়ে বেড়ায়-
তাদের স্বর্ণের বালাগুলো আলাদা করে বোঝা যায় না।
আমি সূর্যালোকে উষ্ণ কোমল ধানের মাঝেই
পা ডুবিয়ে দেই, টেনে টেনে হাঁটি
তিন আলিফের মতো দীর্ঘ করে।
মনে হয় যেন সমুদ্রপাড়ে একটা গ্রীষ্মের সকালে
বালির মাঝে হাঁটছি।
একচালা ঘরের ঢেঁকিটাকে রাজার পদলেহী মন্ত্রী মনে হয়,
প্রতি আঘাতে ‘জি হুজুর’ করে মাথা উঁচুনিচু করে সে
কৃষকের ঘামগুলোকে গুঁড়িয়ে দেয়।
আমি ভয় পাই যদি গুঁড়িয়ে যায় ঢেঁকির মুখে জাবর কাটা হাত ও?
অকুতোভয় বধূটির হাত ঠিক জাবর কেটে চলে
ঢেঁকির মুখে।
জলহস্তী যেমন তরমুজ খেয়ে ফেলে,
তেমনি ঢেঁকিটাও চিবোতে থাকে ধান।