বৃষ্টি হচ্ছে
বৃষ্টি হচ্ছে, জানালার পাশে চুপচাপ ঝড়ে পড়ছে
গোপন কান্নার স্রোত। দূর আকাশে উড়ে
যাচ্ছে রাজহাঁস, সযত্নে লুকিয়ে রাখা প্রণয়ের ভ্রমর।
সখি আজ নিরাভরণ হয়ে তুলে আনছে প্রগাঢ় কাতরতা,
মেঘমন্দ্র ভেলায় সহস্র অনুরাগীর ভিড়ে হে বিভূঁইয়ের
বিদেশিনী, অস্তবেলার আগে তোমাকে নিবিড় চাই
বকুল আর পলাশের ঘন শাখায়। বাতাসে বৃষ্টির পরে ভেসে
বেড়ানো জলকনায় যে হিম, হিরণ্ময় স্মৃতি আহ্বান জানায়—
হে অপেক্ষমানা, আমাদের হৃদয়মথিত অস্তিত্বহীন প্রেম,
সমুজ্জল বিশ্বাসের ছায়া কি পথ হারিয়ে ফেলবে অনন্তের
কাঁটাতারের ভেতরে, কৈশরের কানামাছি খেলায়।
দূরত্ব ঘোচে না কখনো
দূরত্ব ঘোচে না কখনো, দূরের ওই চাঁদটার মতো
এত স্পষ্ট, তীব্র আলিঙ্গনে কেঁপে উঠছে—
শিহরণে থরথর। পরস্পরের গাঢ় ভাপে ভিজে
ওঠা চোখের আদ্রতায় ম্লান হয়ে উঠছে কুয়াশার
সারি। দূরের কথা থাক, যে তীব্র আলিঙ্গনে
আমরা জড়িয়ে ধরেছি—স্বপ্নবিন্দুর মতো মনে
হয়। রূপকথা? পরাবাস্তব স্বপ্ন? এত স্পষ্ট হয়?
সারারাত ঘুমকে তাড়িয়ে—ছড়ানো রাত্রিকে
পাঠ করতে করতে যখন বাস্তবতার মুখোমুখি—
আবেগে থরথর কাঁপছে ঠোঁট, যে অবিচ্ছেদ্য দুয়ার
সম্মিলিত ব্যর্থতার ভার বইতে ক্লান্ত বহুদিন
খুঁজছিল নড়বড়ে হলেও কোনো হাওয়া খুলে দিক
গুমোট পোশাক। উত্তেজনায় খণ্ড খণ্ড হতে হতে—
যখন বইতে শুরু করেছি—যখন কাঁপতে শুরু
করেছি শিহরণময় সন্ধ্যায়। তখন
একটি মুমূর্ষু চিত্কার জানিয়ে দেয় দূরত্ব হলো যন্ত্রে
তৈরি একনায়ক—ছিঁড়ে যায়, স্পর্শে ভুলভাল ডাকে,
কিন্তু ঘোচে না কখনো।
প্রবাস
মুকুরে প্রতিফলিত মুখ কখনো সত্য বলে না
তবুও আমরা আস্থা রাখি বারবার মুকুরেই।
সীমান্তঘেঁষা শরণার্থী শিবিরে দূর ভূমি থেকে অস্পষ্ট
নিভু নিভু আলোর রেখার দেখানো পথে
ফেলে আসা হৃদয়ে ঝড় ওঠে।
চতুর্দিকে চৈত্রের হঠাৎ দমকা হাওয়ায়
গাছের পাতাতে লিখে রাখা প্রিয় মুখ
ঝরে যায়;—শিবিরে হুটোপুটি করা শিশুর সরল চোখে
দুপুরের আলস্য ভেঙে সেইসব মানগুলো মালা গাঁথে।
কোনো দুঃসংবাদ নয়, বরং প্রতিদিন ডানা গজানো ঘুড়ি উড়ে ওঠে
মুকুরে প্রতিফলিত মিথ্যে মুখের মতো, বদ্ধ কুঠুরিতে।
জন্মদিন
নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি জন্মদিন—
ধূসর হয়ে উঠছে স্মৃতি, শুধু অনিহিত বিশ্বাসে
অন্তহীনতার পথে নিকট ও অতীতের কিছু হিরণ্ময় দৃশ্য
পরিত্যক্ত রেলস্টেশনের কাছে ওত পেতে থাকে যদি—
ফিরে যাওয়া যায় জীবনের সেই উজ্জ্বল রঙে।
চলে গেছো, নিশ্চিদ্র বাসর ভেঙে, মুক্ত, ভারহীন
যে ধারাপাত কানাঘুঁষা হয়ে ছড়িয়ে পড়তো তাকে মধ্যবিত্ত
মনের খামখেয়ালি মাখা চুম্বনের ভেতরে ডুবিয়ে, নিষ্ঠুর কুয়াশায়।
কোথায় আছ? ঝাপসা হয়ে আসা ফটোগ্রাফ, বাতাসের
জলকণা আজো তোমার সুঘ্রাণ ছড়ায়। নিরুদ্দেশে,
বেদনাজোয়ারে বিস্তৃতির ঢেউ তুলে আয়নায় ভেসে ওঠা মুখ
আমাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে করে স্বগতোক্তি: ভালো থেকো।
পুরীর সমুদ্র দেখিনি
পুরীর সমুদ্র দেখিনি, দেখেছ তুমি—
সে নাকি সুন্দর, পোষ মানা, তার খাপখোলা
রূপ, জীবনজোয়ার, প্রান্তর, বেলাভূমি, নুড়ি—
ক্রয়ক্ষমতা থাকলে আর কাউকে দিতে না।
দিগন্তছায়া, পথের পাশের কচিপাতা, বারেবারে কার্পেটিং
হতে হতে লুপ্তপ্রায় আলপথ—সব নির্ভুলভাবে
বলে দিতে পারো। তাই যেকোনো সমুদ্রের কাছে
স্মৃতির ক্যানভাসে জড়িয়ে যায় পুরীর উপমা।
প্রত্নতাত্তিক হারানো নগরের কাছে এলে
জীবনবদলানোর যে দমকা বেগুনী শিখা
বিচ্ছিন্ন করে রাখে মন
তাকে কোন পরিখায় আটকাবে?
বুকের মধ্যে বয়ে চলা যে সর্বশক্তিমান সমুদ্র
নির্ভুল গর্জনে, তপ্তবালুতে আছড়ে ফেলে ঢেউ
তাও ঠিক ঠিক গুনতে পারো অভিজ্ঞ আম্পায়ারের মতো।
আমি মুগ্ধ, দীর্ঘমায়ায় তোমার সমুদ্র মেলানো উপমায়।
সময়
সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানো শূন্যতা শুধু।
এ এক শরীরি ভ্রমণ। দেহ থেকে দেহান্তরে, চক্রাকারে।
শূন্যতায় কোলাহল—বোবা অনুভূতি—দিনমান অস্থিরতা
শূন্যতায় ফিসফিস—কলকল ছলছল—স্বপ্নময় স্পর্শ।
একাগ্রতায়, আনমনে শুধু ঘুরিয়ে দেখানো নয় নিজেকে।
প্রতিবিম্ব অশরীরী মতো চলমান।
অভিমান—অনুরাগ—ভালোবাসায় দীর্ঘ দিবস।
এ শুধু ভ্রমণ নয়। এক শরীরী যাপন।
অরণ্যে মায়ামৃগ-দুই
আমি একটি নদীকে জানি। উচ্ছ্বল, আমার প্রেমিকা। তার সাথে যাবতীয় খুনসুটি আমাদের সান্নিধ্যকে নৈকট্য দেয়। রাত্রিময় স্বাপ্নিক অধ্যায় বোনা রূপালী শিশিরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঝিকমিক করে ওঠা ঔজ্জ্বল্যে পৌরাণিক কাহিনি জেগে ওঠে। আমি তার ওষ্ঠ চুম্বন করি। সামাজিক অহমিকার তপ্ততা ভ্রূকুটি করে তার ওষ্ঠ ভবিষ্যতের নির্ধারিত গন্তব্য জেনে আমার জ্বলন্ত মুখগহ্বরে যাত্রা করে। মাঝে খুব চুপচাপ, লাজুক, কখনো চুলে ইলিবিলি কেটে আদর করে।
আমি তার পৌরাণিক হৃদয় সাঁতরে বৈতরনী পার হওয়ার অপেক্ষায় ভালোবাসি।
দানবের মতো সূর্য চোখে, কখনো খুব নিঃসঙ্গ দাঁড়ায়। ভয়ের বর্শা এগিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে প্রিয়মুহূর্ত। আমি তার অসংখ্য লৌকিকতা থেকে খুব নিভৃত অনাড়ম্বর কিছু জানি। আমার শৈথিল্যে ক্লান্ত করে কিনা জানা নেই। আলাদা অস্বচ্ছ ভূমিকায় তাকে জানি। সেই স্রোতস্বিনী, আমার প্রেমিকা।
কবিতা কিছুই বলে না
এভাবে জন্ম নিতে পারে একটি কবিতা
শষ্যভূমি ভরে যেতে পারে শব্দে—ছন্দে—অলঙ্কারে
যদি প্রশ্ন ছুড়ে দাও কিভাবে?
বলব না, কেননা—
কবিতা কিছুই বলে না, হয়ে ওঠে—
হয়ে উঠতে টানে না রমণীর শেমিজ
ছায়ার আড়ালে লুকানো মসৃণ তলপেট খামচে খামচে
হাঁটে না গোপন স্বপ্নে—শুধু হয়ে ওঠে।
যদি প্রশ্ন ছুড়ে দাও কিভাবে?
একজন পুরুষ অথবা নারী যেমন
নিজেকে সমর্পণ করে হয়ে যায় আত্মার অংশ
টেলিফোনের তার চুইয়ে ঐশ্বরীয় বাণী ঢলে পড়ে কানে
স্তন থেকে গড়িয়ে দুধের ফোঁটা নামে শিশুর গালে
তেমনি মৃত মানুষের কফিনের পাশে
ইচ্ছার বলি হয়ে কবিতা শুয়ে থাকে
কিছুই বলে না, শুধু হয়ে ওঠে।
আমাকেই ছেড়ে যায় সবাই, আমি নই
আমাকেই ছেড়ে যায় সবাই, আমি নই।
বুঝি না, কি অফুরন্ত সম্ভাবনার মুখে বারবার
দুপুরের রোদের ভেতরে সামান্য
বিশ্রামের খোঁজে—ভাঁটফুল, জংলি কাঁটা আর
গুল্মলতার বাগান মাড়িয়ে—খ্যাতিতে নগন্য-
চোখের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ঠাঁয়—ভীষণ
অচেনা গাছকেই বেছে নেয় মানুষ।
নিরুদ্দেশে, দূরের কার্নিশে নিজেকে অমর, অক্ষয় করার
অপ্রাকৃত আনন্দে গা খুঁড়ে খুঁড়ে লেখা নাম, বেদনার
নীল ক্ষতে ধরে রাখি। প্রিয় অনুরাগে ভ্রমণ পিপাসু
মানুষ চলে যায়। ভোরের হাওয়ায় বর্ষাভেজা
আকাশের নিচে যে লেখে নাম—সেও ভুলে যায়।
শুধু আমি, জীবনে ফেরার পথে সবচেয়ে বেদনার
গানগুলো মনে করে ডুকরে উঠি। খুলে দেই
আড়াল থেকে ধরে রাখা চোখের নেকাব। নিভৃতে,
ক্ষতবিক্ষত মুদ্রিত ইতিহাসের ভেতর দাঁড়িয়ে দেখি
বসন্তের চেয়ে ঝরাপাতার স্পর্শ অনেক বেশি সঙ্গীতমুখর।
চিড়িয়াখানা ও মুনতাকা হকের কবিতা
চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে পড়া বাঘ, যার সঙ্গে গতকাল দেখা—প্রথমে ভেবেছিলাম কাগজের। পরে দেখি, না, অবিকল আমারই গলায় কথা বলে। হাত আছে, হাতে পিস্তন। ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাবতেই, আমার তিন ছুঁই ছুঁই ছেলে বলে ওঠে, বাবা এতো সেই রয়েন বেঙ্গন, পোষা, আমাকে দোকানে নিয়ে কিনে দিয়েছিল চকনেট। ফমমানিন নাই। তুমি দেখো, হাত বাড়িয়ে দাও, কেমন চুমু করে দেবে।
আহ্লাদে হুটোপুটি খেতে খেতে হাত বাড়িয়ে দিতেই, বাঘ, সত্যিকারের—কোন মিছে ভান নেই—কামড়ে হাতের কব্জি থেকে নামিয়ে নেয় পাঞ্জা। আতঙ্কে, ভয়ে চিৎকার করে ওঠার আগেই ছেলে আমার—বলে ওঠে, বাবা, পালাও, এ সেই মিথ্যেবাদি রাখালের কাছে আসা বাঘ, ভুয়ুংকর, একেবারে সত্যি। এখনই পিস্তন দিয়ে গুনি কববে। মেরে ফেববে। চলো পালাই।