হলুদ জোনাকি
যখন কবিতা আসে
নির্জন ভোর কিংবা নিঃসীম
শূন্যতার দুপুরে—
ইচ্ছে হয় তোমায় নিয়ে হেঁটে যাই
কৈশরের শিমুলতলা দিয়ে,
ঝাঁ ঝাঁ রোদে
হাতে রেখে হাত
পেরিয়ে যাই আমাদের
ক্ষীণস্রোতা নদী
তারপর ধু ধু চরে দুপুরের রোদে
তুমি আর আমি হই
হলুদ জোনাকি।
হ্যাংগারে ঝুলছে
মেরুদণ্ডগুলো হ্যাংগারে ঝুলতে দেখে
শিশুরা চিৎকার করে ওঠে—
ওরা সরিসৃপ হতে চায় না
অথচ লন্ড্রির হ্যাংগার থেকে
কেউই ওগুলো নামিয়ে
বাড়িমুখো হয় না।
বহুজাতিক লন্ড্রি এবং
বিপণী বিতানে ব্যস্ত
সেলস্ম্যানদের কানে
শিশুদের চিৎকার পৌঁছয় না।
নিজস্ব মুখ
নীল পাহাড় থেকে একদিন
সেই বাঁশিওয়ালা
নেমে আসবে নিশ্চিত;
শহর দাপানো ইঁদুরের রিলেরেসে
রেফারি হয়ে
বাঁশিতে ছোঁয়াবে ঠোঁট
শরীর দুলিয়ে নাচবে ভরত কিংবা কত্থক।
ইঁদুরেরা তখন
বাজারি জামা গায়ে
ছুটবে তার পিছু পিছু
নাকি দিঘির অতলে নেমে
স্নান করে পুণ্য জলে
আয়নায় দেখবে নিজের
নিজস্ব মুখ?
যুদ্ধ
তখন আমাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বয়স
যুদ্ধটা যখন সত্যিই হয়েছিল
আমরা কাঠের টুকরো এবং
বাঁশের কঞ্চি দিয়ে
রাইফেল বানিয়ে
মুখে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ তুলে
গুলি করতাম টিক্কা খানসহ
অন্য খানসেনাদের;
সত্যিকারের গুলির আওয়াজ পেলে
উবু হয়ে শুয়ে পড়তাম মাটিতে
দূরে কোথাও ‘মিলিটারি মিলিটারি’ রব উঠলে
খেলার মাঠ, উঠোন বা উঁচু সড়ক থেকে নেমে
ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে যেতাম দ্রুত।
আকাশে তখন বিকট শব্দে প্রায়ই
উড়তো যুদ্ধজাহাজ
আমরা রাইফেল তাক করে
প্রাণপণ শক্তিতে
বিমানের পেট বরাবর চালাতাম গুলি
বিচিত্র শব্দ সহযোগে।
আমাদের ব্যক্তিগত যুদ্ধস্মৃতি শোকাবহ নয়
কেননা আমাদের যে আত্মীয়
যুদ্ধে গিয়েছিলেন
তিনি বিজয়ী বেশে ফিরেছিলেন
যুদ্ধ শেষে।
তিনি যেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন
সঙ্গে ছিল তাঁর অনেক সহযোদ্ধা
তাঁরা উঠোনে বৃত্তাকার দাঁড়িয়ে
আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে
বিজয় উদযাপন করেছিলেন,
আমরা পড়ে থাকা বুলেটের
খোলস কুড়িয়ে
ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছি
আর ভেবেছি—
বড় হয়ে আমরাও একদিন
‘সত্যিকারের যুদ্ধ’ করব।
তারপর পৃথিবীময়
যুদ্ধের বিচিত্র সংজ্ঞা
এবং স্বরূপ দেখতে দেখতে
আমরা বড় হলাম
এবং জানলাম—
মোটা দাগে যুদ্ধের রয়েছে দুটি ভাগ
হা-ডুডুর কোর্টের মতো,
বাঁয়ের বিজয়ী যুদ্ধগুলোকে
গ্রাস করেছে ডানভাগ।
আমাদের আয়ুর দৈর্ঘ্যে
শৈশবে দেখা স্বপ্নের যুদ্ধটা
আর করা হলো না।
আততায়ী অন্ধকার
মূক ও বধিরদের নিয়ে
গাড়ি এসে থামলো
সূর্যোদয়ের পেছন দিকে
সেখানে আগে থেকে কিছু লোক
জড়ো হয়েছিল
তামাশা দেখবে বলে;
গাড়ির আরোহীরা
এলাকা প্রদক্ষিণ করে
ধীর পায়ে এগোয়—
তামাশা প্রিয়রা
তাদের অনুসরণ করতে করতে
এক সময় মিশে যায়
তাদের সঙ্গে;
তেল জলের মতো নয়
জলের সঙ্গে জল যেমন মসৃণভাবে মেশে
কিংবা তেলের সঙ্গে তেল
ঠিক সেভাবে।
এলাকার আবাদী মানুষগুলো
সূর্যের আলোর অভাবে
মৃত রবিশস্য চাষ করতে করতে
একসময় নিজেদেরও
মৃত ঘোষণা করে।
খোলস ভাঙার স্বর
তখন গাড়ি ছুটছে পূর্ণ গতিতে
দানিয়ুবের তীরে জ্বলছে
রাত দশটার জ্বল জ্বলে সূর্য
দু’ধারে পেকে ওঠা গমের ক্ষেত
আঙুর বাগানে কৃষকের সযত্ন চর্যা—
এমন পটভূমি একাধিক আছে
ফরাসি সাহিত্য ও চিত্রকলায়।
অভিবাসী মন ডুব দেয়
এমিল জোলায়—
জলপাই বনের নিপাট বর্ণনা,
আঙুরের রস নিংড়ে
কৃষকের হাতে স্বাদু মদ
রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের খোলস মানুষ,
মদ তৈরির কড়াপড়া হাতে
খোলস ভাঙার মড়মড় স্বর—
কী জীবন্ত দৃশ্য সেসব।
কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে পড়া মন
দুলে ওঠে আবার
ভিনদেশি মসৃণ রাস্তায়
দুলে ওঠে স্বদেশ, প্রিয় জন্মভূমি।
আমাদেরও ধানক্ষেতে কড়াপড়া হাত
কৃষকের জীবন্ত ফসিল,
আমাদেরও খোলস মানুষ কিলবিল
শুধু কড়াপড়া হাতে নেই
খোলস ভাঙার
মড়মড় স্বর।
হেসে ওঠো জীবনের রোদে
কামিনী ফুলের মতো শুভ্র দুপুর
ঝরিয়েছ দু’চোখে তাই, বুভুক্ষু প্রান্তর হাসে
নোনা রোদে। কুহক দ্বীপে হারিয়েছিলে পথ
ময়ূরপঙ্খী বাঁধা ছিল উজান স্রোতে;
কার জীবন যাপন করে এতকাল ছিলে শাপগ্রস্ত,
ভালোবাসা সন্ন্যাস নিয়ে পড়েছিল অবেলায়।
আজ সম্বিৎ ফিরে পেলে যদি, কাকে তুমি দেখো
রাজকুমার? জাদুকরী আয়না ফেলে দাও
তুলে নাও অতশী কাচ; আঁজলা ভরেছে
সোঁদা সোঁদা রাঙা ফুল, চোরাবালি টান
উবে গেছে, চন্দন সুবাস ওঠে দেহের কপাটে।
সাতমহলায় চাঁদের আঁচলে ঢাকা মুখ
বিরহের প্রস্তর ঠেলে জেগে আছে
কতকাল, শীর্ণ শরীরে তার সজল প্রেমের স্রোত;
ভালবাসা হেঁটে এলো এই ভৈরবী ভোরে
সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়—
এখানে নোঙর ফেলো, করো জীবনের চাষাবাদ।
দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো
মিলু শামস
প্রকাশক: উৎস প্রকাশন
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য: ১৫০ টাকা