নিজের কবিতা কখন নিজেকে মুগ্ধ করে
প্রত্যেক সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের একটি না পাওয়ার হাহাকার থাকে। কী যেন পাওয়ার কথা কিন্তু পাচ্ছি না, এমন হুহু শূন্যতা কাজ করে মনের গহীনে। কবিতা সাহিত্যের প্রধান শাখা। এই কবিতার দাঁড় টানে যে নাবিক, তার দীর্ঘ পথ কখনো শেষ হয় না; শুধু মাঝে মাঝে যাত্রাবিরতি আসে কোনো টং ঘরে। যদি কখনো কাঙ্ক্ষিত একটি থিমের অনুকূলে মোটামুটি একটি কবিতা লেখা হয়ে যায়, তবে অল্প সময়ের জন্য হলেও সঙ্গমের পরিতৃপ্তি পায় সেই কবি। তেমনি আমাকে দুদণ্ড শান্তি দেয় আমার কিছু কবিতা।
রাজশাহী কবিতাকুঞ্জের কবিতা পাঠের এক অনুষ্ঠানে কবি সৈয়দ শামসুল হকের সামনে প্রায় একশত জন কবি কবিতা পাঠ করেছিলেন। সেখানে আমিও আমার ‘দাঁড়কাকের জীবন’ কবিতাটি পাঠ করে ছিলাম। পরের দিন ঢাকায় ফেরার জন্য স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম। কিছু দূরে হক ভাইকে ঘিরে লোকজনের জটলা ছিল। কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছিল আর কেউ তাকে বিদায় জানাতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বরাবরই একটু অসামাজিক ছিলাম, যতই বড় মাপের মানুষ হোক আগে সেধে খাতির দেখাতে যেতাম না। হঠাৎ দেখি হক ভাই হাত ইশারা করে আমাকে ডাকছেন। এগিয়ে যেতেই তিনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাইলেন। কারণ, এর আগে আমি তার সঙ্গে কখনো পরিচিত হতে যাইনি। আমার সব পরিচয় বিস্তারিত শোনার পর আগের দিনে আমি যে কবিতাটি পাঠ করেছিলাম, তার চারটি লাইন তিনি সুন্দর করে পাঠ করলেন। আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এত এত কবির মধ্যে মঞ্চের ওপর পাঠ করা, মাত্র একবার শোনা একজন অপরিচিত, অপ্রতিষ্ঠিত কবির কবিতা মানুষ এভাবে বলতে পারে!
এই ‘দাঁড়কাকের জীবন’ কবিতাটির সেই প্রশংসা বাক্যগুলো এখনো আমাকে প্রেরণা জোগায়। এরকমই কিছু কিছু কারণে নিচের পাঁচটি কবিতাই আমাকে কিছুটা হলেও তৃপ্তি দেয়। কিছুটা কারণ, কোনো বিষয়ে যেদিন পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেয়ে যায় মানুষ, তখন আর সেই বিষয়টির প্রতি তার মোহ থাকে না। তাই আমিও সেই অতৃপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে একজন, যাকে পাওয়া বা লেখার আকাঙ্ক্ষা ঘুমাতে দেয় না। আজ একটি কবিতা নিয়ে লিখলাম আগামীতে আমার এইরকম বিখ্যাত মানুষদের প্রশংসায় প্রশংসিত কবিতাগুলোর কথা জানাবো।
সবাই সৃষ্টিশীল থাকুন এবং ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় নিমজ্জিত থাকুন। মোহ শেষ হয়ে গেলো মানে আপনার আত্মা মরে গেলো। তাই চিরজীবী হওয়ার চেষ্টা করুণ।
দাঁড়কাকের জীবন
করতালিতে মুখর হয়ে ভুলে যাইনি দাঁড়কাকের জীবন
একটা সাবানের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি
বিড়ালের সাথে মিলে যায়।
বোনপ্লেটের উচ্ছ্বিষ্ট ফেলনা হলেও কৃপণতা
প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বড় বেশি চাকচিক্যের।
আহা বিড়াল! আহা দাঁড়কাক!
তোদের সাথে সইপাতা জীবনের মর্ম আকাশে ভাসে
আর জানালা দিয়ে ভেসে আসে সাকুরার সৌরভ
এসো তালপাতা, আমরাও মাতাল হই বৃষ্টিবেলায়
যদি এক ঝাঁক চাঁদ পায়ে লুটিয়ে প্রণাম করে…
তবে কি ভুলে যাবো বিড়ালের সাথে উচ্ছিষ্টের প্রেম!
যদি দেয়াঙ পাহাড় মাথায় করে গান করে শুক্লাপক্ষে
আর নেমে আসে ঝিরঝিরিয়ে ঝরনা দেহের ভাঁজে ভাঁজে
তবে কি ভুলে যাবো দাঁড়কাকের লোভাতুর প্রেম!
একদিন ভুলে যাবো, যাবো কল্কে হাতে ননীদের পাড়ায়
মহল্লাজুড়ে নাচবো…আর ভুলে যাবো দাঁড়কাকের জীবন।
পাখি
পালকের স্পর্শে ভেঙে গেছে ঘুম…
এখন রাতভর জেগে থাকি পাখির স্বপ্নে
বিমূর্ত প্রেমের জৌলুস রঙ খেলে
জেগে আর ঘুমে শুধুই অঙ্কুরিত ভ্রম
আফ্রোদিতির আত্মা ভর করে দেহের গহীনে
এক পেগ মদ ঠোঁটে ঢেলে ফাঁদ পেতে থাকি
সোনাপাখির আদি-অন্তে সুখ ছড়াবো বলে।
সুখের অফুরন্ত বৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ডুবিয়ে
তলিয়ে যায় সমস্ত জনপদ
যেখানে পাখি নেই কেবলি তার আবেশ
পালকে কাম, পালকে প্রেম-কাহারবা, দাদরা, ঝুমুর…
বিষণ্নতার দিন ভেঙে জ্যোৎস্নার উজ্জ্বলতায় গান হবে
ও পাখি, এসো জেগে আছি মহাকালের রথে,
তোমার ধ্রুপদী রঙে আমাকে সাজাবে বলে।
নদী
নদীর কাছে দিগন্তে হেলান দিয়ে
আমারও কিছু বলার ছিল
কেমন করে অনন্ত জীবন বয়ে চলে
অবসরের বেলা ভুলে ছুটে চলা
সাগর পানে!
সাগর তার ফেনিল বুকে, থেকে সুখে
গর্জন তুলে ডেকেই চলে স্রোতস্বিনী, পল্লবিনী
চন্দ্রমনি, হরঘরণী হাজার নামের তুফান তোলে
লবণাক্ত ঘূর্ণিমুখর প্রেমের লোভে যায় ছুটে যায়
তন্ত্রমেদুর দুপুর ভুলে বোকা সরল সকল নদী
নিরবধি আত্মভোলা চপলতার জলাঞ্জলি দিয়েই
সুখী! ও নদী, সুখ কারে কয়, বোঝ তুমি?
এমন নাচন, ধ্বংসকেতন তোলে যখন হায়দরী হাঁক
সে কি তখন তোমার আপন? ভেঙে নিলে চাষার কুলা
চলে গেলে দুধের গোলা, একটুও কি মন পোড়ে না
জান কাঁপে না! এমনই অন্ধ প্রেম কামনায় ছুটেই চলো
ঠিক হলো, ঠিক হলো না। ও নদী, এমন প্রেম আর করো না
আর করো না, থামতে শেখো, শিখে থামো…
সুখ ও স্বপ্নের সাম্পান
ইতিহাসের বুকে দাঁড়িয়ে এঁকে যাবো ইতিহাস
ওগো দরদী যমুনা প্রশস্ত করো বুক
উৎফুল্ল জলে ডুবিয়ে তোল স্নিগ্ধ বাতাস
বয়ে যাক এই লোকালয়ে সুখ ও স্বপ্নের সাম্পান।
এই করোনার করুণধ্বনি বাজে না যেন কারও মনে
অতলের গরল তলে সমাধি তাবিজ করে চলে যাওয়া
জীবন তরী চলে না;
ভূতলে বিঁধে রেখে বুক ওড়ে না চড়ুই, টিয়া
উন্মাদ সকল জাগো জাগো, তরবারি তসবির তালে
একটি নতুন মন্ত্রে অজ্ঞাত দাওয়াই স্ফুরিত করুক
উজ্জীবিত মূর্চ্ছনা
ও উন্মাদ, ও ইবনে সিনা দেখাও শ্রেষ্ঠ করতল!
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না
সূর্যাস্তের ঠিক আগে যে গোলাপি আভা
আমাকে বিমোহিত করে তাতে
গা এলিয়ে এক চুমুক ধূমায়িত কফির সাথে
তোমার ঠোঁট টেনে নেয়ার বাসনা করছি;
তখন সুখের সাথে একটু সিগারেটের ধোঁয়া মিশেল
থাকলে মোহ বাড়বে
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না…
[এবং খেজুর বৃক্ষ ও আঙ্গুর ফল থেকে
তোমরা মদ্য ও উত্তম খাদ্য তৈরী করে থাক,
এতে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে
নিদর্শন রয়েছে। (সুরা নাহল ১৬:৬৭)]
পারলে মদ্যটা মজাও
বোধশক্তি সম্পন্ন হও
কাছে আসতে পুলসিরাত লাগবে না
একটু সুক্ষ্ম কাতরতায় সুরা ঢালো দুটি সরু গ্লাসে
বুকে বুকে চিয়ার্সে রঙিন আলো জ্বালালে
মদ্যআর্দ্র ঠোঁট ঘষে নেবো অতীন্দ্রীয় অলি গলিতে
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না
আগুনে পোড়ানো ইশক—কামাতুর করে
ধোঁয়া আর সুরায় ডোবা ঠোঁট
নবরত্ন সভার মূর্চ্ছনা তোলে
গর্জনরত মেঘ নেমে এলে চন্দ্রগিরিতে
নিত্য আর কলা—অঙ্গ উন্মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়
অতএব পারলে ছেড়ো না
ছেড়ো না জঙলি নদীর বাঁক
ছেড়ো না ধান শালিকের ঢাক
আর আমার তুলসীগঙ্গার মায়া
মারিজুয়ানা আর বুদ্ধের ধ্যানে
যখন পৈত্রিক ভিটা আলুথালু হয়
তখন একটা হাতের ওম লাগে হাতে;
একটু ছোঁয়ার তীব্রতার মোড়কে জড়িয়ে
একটা শীতঘুম দিতে চাই
পারলে মারিজুয়ানার একটা সুখটান রেখো
আমি অথবা লিওনার্দোর মোনালিসা
যে কেউ একটা সুখটান দেবে
দিবে ধোঁয়াসে চুমু তোমার তন্দ্রামগ্ন ঠোঁটে
পারলে সিগারেটটা ছেড়ো না…