বিয়োগান্ত
মৃত্যুই প্রমাণ করে মানুষ মূলত বিয়োগান্ত জীব
দুর্বিনীত জলরাশি উন্মত্ত উল্লাসে ঢুকে পড়ে সহসাই
ডুবে যাই সীমাহীন বিস্মরণে—শিকারির ফাঁদে
শূন্যে ঝুলে থাকা ভীষণ বেপানা—
উঠানে উঠতি রোদে ভেঙে পড়ে জলের জোয়ার
নর্তকী ধ্বংসের পায়ে লুটে পড়ি—আমাদের
সকল সরিষা ক্ষেত আলকাতরায় ঢেকে যায়
ভেসে যায় বাগানের হলুদ গোলাপ, মাঠফেরা চিত্রল হরিণ
ঝাঁক ঝাঁক সাদা কবুতর
যাবতীয় আনন্দের গান হয়ে ওঠে কষ্টের নিনাদ—
বোধের পাড়ায় নামে ঘোর নীরবতা
সব মিলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মৃত্যুই জানায়
মানুষ মূলত চিরকাল লিখে চলে বিয়োগের গাথা, আর
এককালে প্রত্যেকেই বিয়োগান্ত নায়কের পরিণতি নিয়ে
ফিরে যায় একদম একা
বিচ্ছিন্নতা
বৃষ্টিকে কান্না বলি না—বৃষ্টি কার জন্য কাঁদে?
আকাশতো নীলাভ পাথর—কেবল তাকিয়ে থাকে
যেমন বৃক্ষেরা থাকে শুধুই তাকিয়ে
যেমন নদীরা নিজ স্রোতে বয়ে যায়
পাখিগুলো উড়ে যায়—গাছের একান্ত খোপে
যথারীতি হয়ে যায় বেনামি পালক
বস্তির অস্থির বুক ভেদে ভবনে বাজতে থাকে গান
মানুষ নিজের মতো হাঁটে, আর
যে দাঁড়িয়ে থাকে জানালায় চেয়ে
তার জন্য বাতাস কি সহমর্মী হয়?
সবকিছু নিজ স্রোতে বয়—
বৃষ্টি ঝরার শব্দে কারো পায়ে নূপুর বাজে না।
যে মা তার সন্তান বিক্রি করে এসেছেন
যে মা তার কোলের শিশুটিকে অর্থের বিনিময়ে এইমাত্র
বিক্রি করে এসেছেন, তার জন্য আমার চোখে কোনো জল নেই
আমার শোক হতভাগা সেই শিশুটির জন্য, কারণ সে তার মাকে
ভালোবাসতে চাইবে—মধ্যরাতে কেঁপে, কেঁদে উঠলে সে চাইবে
মা তাকে জড়িয়ে ধরুক বুকে, সে ‘মা’ বলে ডাকতে চাইবে কাউকে
উন্মাদ অশ্বদের পিঠে চড়েছি আমি বহুকাল, এখন গোপন এক আস্তাবলে
তাদের রেখে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছি দিগ্বিদিক—অথচ যোদ্ধা অশ্বের পাল মধ্যরাতে
বেরিয়ে পড়ে—খরস্রোতা নদীর যে তীর ভেঙে পড়ে
রাতের আঁধারে, তার খোঁজ কে রাখে—আমি জেনেছি, ক্ষুধাকে খোদা মানতে
জেনেছে মানুষ, তবুও অনেক প্রশ্নের জবাব আজো
অজানা রয়ে গেছে আমার
এইমাত্র নিজের সন্তান বিক্রি করে আসা হে মা, আমাকে আপনি
নিরপেক্ষ না-ই বলুন, স্বার্থপর বলুন, আমি আপনাকে বলছি, আপনি ক্ষুধা
মেটাতে বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছেন উদরের ধন—কখনো কি ভেবেছেন, আপনার
সন্তানটি সারাজীবন মায়ের স্নেহের জন্য ক্ষুধার্ত থেকে যাবে?
তার মনের সেই অসীম ক্ষুধা কে মেটাবে?
প্রজাপতিঘুড়ি
আমার যে হাতে ছিল ঘুড়ির নাটাই
আমি সেই হাতটাকে গুটিয়ে নিয়েছি, আর
সুতো কেটে দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ঘুড়িটির দিকে।
দেখছি, ঘুড়িটা ঠিক প্রজাপতি হয়ে গেছে
প্রিয় প্রজাপতিঘুড়ি, তুমি কেন সারাক্ষণ চারপাশে ওড়ো?
এটিএম বুথ
গলির প্রত্যেক মোড়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছেন
কেমন রূপসী তিনি, রঙ-চঙা আলোঝলমলে
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ
ঘঁষলেই ফোটে ওঠে কাঙ্ক্ষিত মুকুল।
অবগুণ্ঠনে ঢেকে দিলে তিনিও লাজুক
অপেক্ষায়
অতঃপর অন্য কেউ ঘোমটা সরিয়ে
ছুঁয়ে দিলে ভুলে যান অতীতের স্মৃতি
এমনই নির্মোহ তিনি
কারো কোনো স্পর্শে তার অসম্মতি নেই।
তার কথা ভুলে যাও
পেছনে যে পথ রেখে এসেছিলে পথে
তার কথা ভুলে যাও
হয়তো সেখানে কোনো উদ্যান ছিল
ঝর্ণার ধারা ছিল
দখিনা বাতাসে পাখিদের কলতান
রূপালি আলোয় ফড়িংয়ের ছিল গান
এতো মুগ্ধ যে ভুলতে পারো না স্মৃতি!
সেই পথ ভুলে যাও
পেছনের পথ পেছনেই পড়ে থাক
আসলে ওসব তোমার ছিল না কিছু
উদ্যান নয়, ঝর্ণা ধারাও নয়
তার কথা ভুলে যাও
যে হাত তোমার নয়, যে বনে কখনো
তোমার নামটি ধরে কোনো পাখি গান করে নাই
যে চোখ স্বপ্ন দেখেনি তোমাকে নিয়ে কখনোই
তার কথা ভুলে যাও
ওই বুকে তুমি ছিলে না কখনো
তার ভাবনায়, ঘোর লাগাকালে
ফিরে ফিরে তুমি আসোনি কখনো
তার কথা ভুলে যাও
বরং যেটুকু এখন তোমার আছে
বুক খুলে তাকে কাছে টেনে নাও
সারাটা পৃথিবী তার হাতে তুলে দাও