কর্মী
মহাকালের রেললাইনে ট্রেন চলছে—বিরামহীন যাত্রা
অনাহার হাওয়ার মুখ পিছু নিয়েছে—ঘুরছে আগুনমুখা চাকা।
স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ার মানুষ, ট্রেন চিনলেও বগি চেনে না
যখন বগি চিনে তখন ট্রেন পাড়ি দিয়েছে; সন্ধ্যাপাড়া…
কোন স্টেশনে থামবে ট্রেন—জানে না মহাজন
সিগন্যালের লাল-নীল বাতি নির্বিকার; জন্মমৃত্যু সমান।
ট্রেন চালকের গল্প শুনবে শুনবে বলেও শুনে না কেউ—
তাই, যাত্রা দেওয়ার সকালে শুনতে হলো—মুখ হারানো গান
ভ্রমণের আফসোস কখনোই ছিলো না—
তবুও দমের দামে কিনতে হচ্ছে টিকিট ক্রয়ের বিধান
যাত্রির চেয়ে নাকি ট্রেন দামি; এটা মহাজনের দাবি!
বুঝে না বুঝে স্টেশনে হাততালি দেয়—বোকাচোদা কর্মী…
উপললব্ধিবাজি
আকাশ দেখি না বলেই মেঘবতি আমার বান্ধবী
মাছির মতো কতো ছেলে ঠেলে—ধরলি তুই হাত
যে হাতে ফোটে ভালোবাসার উড়ন্ত নীলগোলাপ।
কেউ জানে না; কেউ কেউ জানে গোলাপ রহস্য
ভালোবাসার বিনিময়ে দিলাম চোখচন্দ্র সন্ন্যাস।
তোর বুকে লক্ষ-কোটি পুরুষ দৃষ্টির বুনোবৃষ্টি
ভিজিয়ে দেয়—মগ্নসুরের ভায়োলিন ভদ্রশহর
আমি বুঝলেও বুঝে না—খানকি মাগির পুত্র যত;
কোনো কোনো বুনোপরুষের চোখ তোর কাছে—
হঠাৎ লাফিয়ে আসা অবৈধ গ্রেনেডের মতো…
কবিতার যে নাম দিয়েছি প্রিয়তমা
এই শহর প্রতিদিন নির্মিত হলেও নির্মাণ হয় না মানুষের মন
ভালো থাকার নামে ভালোভিনয় পোস্টারে ভরে গেছে সব মুখ
উঁচুউঁচু দালানের গ্লাসে একমুঠো রোদ ঝুলে থাকে বারোমাস
ঝুলে থাকে অল্প বেতনের নয়া কেরানির বোকাসোকা হাসিও
অথচ, একসময় ব্যালকনিতে ঝুলে থাকতো ব্রা, শায়া, প্যান্টি
এখন পোষাকের মতো পুরুষই ঝুলে থাকে হাওয়ার মাস্তুলে
এই শহর প্রতিদিন চিনলেও চেনা হলো একজীবন রহস্যগলি
আলো ধরার নামে দিনশেষে মরা মগজমাছ নিয়ে বাড়িফেরা।
শহরের উঁচু দালানে লেখা কবিতার নাম দিয়েছি প্রিয়তমা;
পা ফাঁক করা গ্রাম্যযুবতির হিসিবৃষ্টির আঁকাবাঁকা আল্পনা…
শিক্ষিকা
তোমাকে দেখতে দেখতে নিজেকে দেখা হলো না অনেক বছর।
পোয়াতি গমের শীষের মতো সময়ের নদী তোমার প্রতিবেশী—
প্রতি রাতেই অন্ধ জোয়ার আসে বলেই আমি আহত জাহাজ
বুকের বন্দরে কখনো ডুবে যাই, কখনো ভাসি পরম করুণায়
বেদনার মাঝসমুদ্রে ঠিকানাহীন সারেং জানে না সাঁতার গান।
তোমাকে দেখতে গিয়ে জেনেছি—চোখই মহাসমুদ্র
বোবাকান্নার উপদ্বীপে জড়ো হয় সব নিষ্ফলা ঢেউয়ের ফুল
ফিরিয়ে কী দিতে পারবে ভ্রমণের ভ্রমর; জলের জারুল;
সহজেই ভুলে গেলে জল ও জ্যোৎস্নার নরম নামতা।
কিভাবে যে পাঁজর বন্দর থেকে ভেসে গেলো যৌবনশস্য
দূরের দূরবীন দূরেই রয়ে গেলো—হাত তালুতে তুলি কষ্টকম্পাস
আর তুমি সেই আগের মতোই নিয়ে যাচ্ছ—জলভ্রমণের ক্লাস…
তাঁতপাড়া
আগুনের আঁতুড় ঘরে—সূঁচ ও সূতোর দীর্ঘশ্বাসের দৃশ্যকল্প
সিদ্ধ করে সেলাই পাড়ার সাদাসিধে শিল্পের সরলতা।
খাদির খরিদ্দার খুঁজে না—তাঁতীদের শিল্পবোধ
দ্যাখে না—সেলাইদিদির আঙুলে নেমে আসা সূর্য।
মুখ ও মুখোশে লেগেছে পরবের হাওয়া
নগরপ্লাজার কাচের ক্যানভাসে—রঙ বদলের কোলাহল
তবুও সেই মুখে ফুটে না বিবেকের কাঠগোলাপ।
বড় হয়, ভূঁইচাঁপা সেলাইকলের বেদনা,
হারানো সূতোর রঙ ছেড়েছে হালের হাল
এ কারণে বিবিদের ফ্যাশানে—ফ্যাকাসে তাঁতশিল্পের তারা
সেই কবেই—সূঁচ ও সূতো ছেড়েছে তাঁতপাড়া
তাই ক্লিনিকগুলোতে ভিড় করে—সেলাইশিল্পের আলপনা…
ফাঁদ
শীতশিবিরে হীমবায়ু অবাধ্য—কুয়াশার কাঁকড়কোটরে
জমে গেছে ভেজা আঁচলের নিচে চোখপোড়া শোভা
পল্লিবালার নাভিতে বাজে না ওমের মিউজিক
নাভির ভাটিতে ভাটা পড়েছে ঘাসের যৌবন
সাঁতার জানে না জেনে কমে গেছে ঘাটের ভিড়,
মাঝি নোঙর ফেলবে বুকে নিয়ে পরাণের পূর্ণিমা।
সাঁতারুদের চোখে মুখে জেগেছে কুয়াশার ফাঁদ
পল্লিবালা আঁধারে পাড়ি দিবে ফুসলানো ফেরিঘাট।
নাচঘর মানে না শিল্পের শাসন
বিমূর্ত হাতের ভাগ্যরেখা গন্তব্যহীন
কেবল পৃথিবী থেকে দূরে গ্রহপথে
আবেগি হয়ে উড়তে উড়তে ভাবে
আকাশেও এখন নগ্ন নৃত্যের রঙ্গমঞ্চ!
ধ্বংস করে নাচঘরের শিল্পের মহড়া
নাচঘরও মানে না শিল্পের শাসন…
রঙ
চারিদিক চালাক আলোর ভাঁজে ভাঁজে মিথ্যার রঙ
বিপণন বাস্তবতার কোরকে মুখোশের আড়ালে মুখ
সেই মুখেই মিথ্যা সংক্রান্তি থুথু ভেজা সংলাপ;
অযথাই স্বপ্ন দেখাই—বেদনাবর্ণের নৈঃশব্দকে।
মিথ্যার সূঁচ ও সূতো সেলাই করে সত্যের সারল্য
আর বুকের বারান্দায়, পোষা বোবা ময়নাপাখি
জবুথবু বসে দ্যাখে—রঙ মাখানো পৃথিবী।
অন্ধ পুরোহিত মুচকি হেসে বলে গোপনে
রঙ থেকেই জন্ম নেয়—যতোসব পাগলামি
তাই দেবতারাও বড্ড রঙ পূজারি…
রাজারা বেঁচে থাকে না; প্রজারা থাকে
রাজবাড়ির রাজার অন্দর মহলে রাজনটীর নূপুরের নিক্বণ চিৎকার—
ঝিকিমিকি তারার মরীচিকা বাতাস গলে গলে আগুনফুল ফোটে।
এখানে মাতালের উদযাপন, বোবার বোধ জুড়ে যা কিছু উড়ে—
রঙ্গিলা জলের অভিমুখে গ্রীবাঘেরা মখমল মনের সবই নিমগ্নতা।
চন্দ্রকরোটি বোবাঘুমে গেছে বলেই কেঁপে উঠেছে প্রাসাদের ভিত;
রাজনটীর কানঘরে হিমশীতল লোহার দরজা—জ্যোতির্ময় চাপাকান্না।
জল্লাদের জলজ রক্ত পদ্মকলি গন্ধহীন জেনে সেনাপতির চোখের ভ্রম
মধ্যরাতে ঝুমুর নৃত্যের অ্যাকুরিয়ামে দেয় সাঁতার। চিকন লাল পরি
দুই আনা রূপার কয়েনে ভূমিকম্পন তুলে উষ্ণ অনুভূতির তটভূমে।
দু’মুঠো শুভ্র মেঘমুক্তোর মালা হাতে রাজামশাই উচ্ছ্বাসে নেচে ওঠে;
শিহরিত শ্বাসোচ্ছ্বাসে বসন্ত কালের কোকিলস্বরে বলে-মা-র-হা-বা…
চুন-সুরকি দেয়ালের মাঝে গর্ভবতী মোমবাতির বোবা আলোর ভিড়ে
লাল পরি’রা সব একে একে হয়ে যায় চকচকে আলোকিত আলেয়া;
সেই আলোর উঠোনে চোখের পিদিম্ ফুঁড়ে জ্বলে ওঠে সুবর্ণ সকাল।
এভাবেই সুবর্ণ সকালের হেঁটে চলা—ঘুমক্লাসে রাজ্যের ইতিহাস পাঠ
এ যেনো অতীতের পলে পলে খোয়াবের ঠোঁটে ভাঁটফুলের মৌ মাঠ।
মাঝে মধ্যে ঘুমঘরে দলছুট মেঘের ভেলায় রাজবাড়ির রাজাকে দেখি
হামেশাই হাঁফাতে হাঁফাতে গলা ছেড়ে হাঁকে-রাজারা বেঁচে থাকে না;
. প্রজারা থাকে।
সুগন্ধি সুনামি
নীল ফ্রক পড়া বালিকার বুক থেকে ওড়ে আসা ফড়িঙ
দেহের থরে থরে সাজায়—রূপালি রোদের ক্যানভাস
কেড়ে নেয়—চোখের সারল্য; দৃশ্যশিকারির সাম্পান।
সমুদ্রপকূলে দিয়েছে কারফিউ—ওড়ে পর্যটকের চোখ
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে দাঁড়কাকের প্রবাল প্রাণপ্রাচীর
বালিকার ঠোঁটের চাতালে হালের হাওয়া পাল তুলে
মগ্নতার প্লাবনে ভেসে যায়—উপকূলীয় বিলবোর্ড।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দিয়েছে—দশ নম্বর সংকেত;
বালিকার খোলাবুকের ফাঁদ থেকে ওড়ে আসে সুনামি
আর নিরাপত্তাকর্মীরা জানে না—
তবুও কেন পর্যটকরা বালিকা পূজারি…