জল-হাওয়ার পদ্য
হাওয়ায় উড়ছে, ধূলো
রোদ্দুরের খর পায়ে ভীষণ জমছে তাপ
তোমাকে খুব পড়ছে মনে, এমন পঙ্ক্তিগুলো
উবে গেছে বহু আগেই, মুছে গেছে ছাপ
তোমার চিহ্ন মুছে দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার লালে
মন জুড়েছে ফাগুন রঙের দারুণ কলরব
জড়িয়ে নিতে তোমায় যখন মোহন কথার জালে
বলেছিলাম, একটু শোনো! করো অনুভব!
এখানে খুব বৃষ্টি এখন, খুব উঠেছে ঝড়!
তুমি তখন অনেক দূরে! কোন সে তেপান্তর!
অন্যগানে মুগ্ধ তখন তোমার চটুল মন
অন্যসুরে বিভোর তুমি, তোমার অনুক্ষণ!
এখানটাতে রোদ্দুর এখন, থেমে গেছে ঝড়
বৃষ্টিও নেই, হাওয়ার নূপুর বাজছে নিরন্তর…
এখানটাতে ফাগুন এখন, নতুন কিশলয়
হাওয়ায় হাওয়ায় নিপুণ সুরে গোপন কথা কয়
তোমার কি আর কেটেছে ভ্রম! কাটবে কোনো কালে!
তোমার তুমি আটকে আছ কোন সে মায়াজালে!
এখানটাতে ফাগুন কাঁদে বিষণ্ন সুর তুলে
কপট তুমি কাটাও সময় পুরান স্মৃতি ভুলে!
ব্যক্তিগতের ফাঁদে তোমার আটকে গেছে গা
তোমার যা তার কোনো কিছুই এখন আমার না!
হাওয়া উড়ছে, উড়ছে ধূলো
উড়ছে তোমার নামও
ফুলের কণায় উড়ছে তোমার জমাট স্মৃতিগুলো
তোমাকে আজ উড়িয়ে দিলাম, দিলাম স্মৃতির খামও
হাওয়ার পালে উড়িয়ে দিলাম ভুলের বিষাদ ডানা
সব উড়ে যাক তোমায় নিয়ে ছড়িয়ে ফাগুন রোদ
তুমি থাকো তোমার মতো তেমনই তালকানা
এখানটাতে ফাগুন ঝরুক, পলাশ মেলুক চোখ…
বিনিময়
চিরে ফেলো
আমাকে চিরে ফেলো লোহার করাত
হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দাও দাঁত
আমি তো বৃক্ষ এক
ছায়া দেই, ফুল দেই, ফল
আমার বাকল তোলো, মাংসসুদ্ধ তুলে নাও
খুবলে নাও তুমি তবে
ভয়াল দাঁতাল
রক্ত নাও, ঘাম নাও
বুক ভরে নাও অম্লজান
তোমার আঁধার ক্ষণে
আমাকে জ্বালানি করো
আলো নিয়ে পথ হাঁটো
অন্ধ মাতাল
আমাকে চিরে ফেলো
আমাকে জ্বালানি করো
আমাকে পুড়িয়ে ফেলো
আমাকে উপড়ে ফেলো
হৃৎপিণ্ডে বসাও ওই দাঁত
আমাকে রক্তাক্ত করো
আমাকে ছুড়ে ফেলে পথ হাঁটো আলোময়
আমি তো বৃক্ষ এক
টেনে নাও দীর্ঘশ্বাসে ছাড়া অম্লজান
চিরে ফেলো অতঃপর, লোহার করাত
শহরজুড়ে বৃষ্টি নামে
মেঘ জমলেই স্মৃতির ধূলো উড়তে থাকে
বৃষ্টি হলেই গড়াইজুড়ে কান্না ভাসে
রেনউইকের বাঁধ ভেঙে যায় দুঃখ স্রোতে
হরিপুরের নতুন ব্রিজও থমথমে মুখ
ধূলোয় ধূলোয় ধূলিয়ে ওঠে সেই নদীয়া
বজরা চড়ে রবিবাবু নৌ-ভ্রমণে
একতারাতে সুর তুলে গায় ফকির লালন
দ্রোহের রোদে ঝলসে ওঠেন বাঘা যতীন
গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠেন গগনবাবু
পথে পথে খবর বিলান কাঙাল হরি
বৃষ্টি হলেই মেঘ ভাসিয়ে স্মৃতির ভেলা
সেই নদীয়ার মানুষগুলোর স্মৃতির ধূলো
ছড়িয়ে দেয়, ছিটিয়ে দেয়, পথে পথে
বৃষ্টি কাঁদে, শহর কাঁদে, মেঘের শোকে
টাপুর টুপুর শব্দ তুলে বৃষ্টি কাঁদে
সকাল-দুপুর-রাত্রি কাঁদে ছন্দ-সুরে
হাওয়ার গায়ে থোকা থোকা স্মৃতির পালক
দুলতে থাকে, ঝুলতে থাকে জনপদে
স্মৃতির ধূলো উড়তে থাকে বৃষ্টি পায়ে
ধূলোয় ধূলোয় ঘোলাটে চোখ আকাশটাও
মেঘের শোকে চোখ ভিজিয়ে কাঁদতে থাকে…
উল্টোরথ
ঝর্ণার শব্দ শুনি
বুকের ভেতর কেউ চুপিসারে ফোঁপায়
পাহাড়ের সবুজ কার রক্তের গাঢ় লাল হয়ে জমে ওঠে চোখের ভেতর
আমি আকাশ দেখি
ডানা ভাঙার শব্দ আছড়ে পড়ে কানে
হাওয়ার নূপুর কার পায়ের শেকল হয়ে বেজে ওঠে হৃৎপিণ্ডের কুঠুরিপাড়ায়
জোছনার জল অমাবস্যায় ছেয়ে ফেলে মনচর ভিটে
আমার রৌদ্রের দিন অগোচরে খেয়ে যায় নিশিদিন
কোনো এক অসার আষাঢ়
অনুক্ষণ বৈপরিত্বের ঘেরাটোপে আটকায়, খাবি খায়
অকরুণ, তুচ্ছ জীবন…
উন্নয়নের কড়চা
গণপ্রজাতন্ত্রের আতশবাজিতে ধাঁধানো চোখ
সাবধানে সরিয়ে আঁচলে মুছে
উনুনে আগুন উসকে সন্তানের মুখে আঁকে গাঢ় চুমু
হাঁড়িতে টগবগ ফোটে জল
মায়ের হৃৎপিণ্ডও ফোটে উত্তাপে
জল উথলে ভিজিয়ে দেয় চোখ
কোলে ঘুমন্ত শিশুর চোখ-কোণে লেগে থাকে সফেদ লবণ
পাশে ছোট্ট শিশুটি প্রতীক্ষান্মুখ চোখজোড়া
হাঁড়ি আর মায়ের মুখে ক্রমাগত ঘুরপাক খায়
মা উনুনে আগুন উসকে দেয়
ক্ষুধা উসকে ওঠে আড়ালে দ্বিগুণ
মা জানে, জলে শুধু তৃষ্ণা মেটে…
ক্ষুধা তবু ছলকে ওঠে সবকটা পেটে
হাঁড়িতে টগবগ ফোটে জল
যন্ত্রণার তপ্ত কড়াইয়ে ফোটে মায়ের আর্ত হৃদয়
উথলে পড়ে চোখে
ধর্মাবতার তখনো উন্নয়নগীতে বুঁদ
উন্নয়নের কড়চাও সাবধানে ক্ষুধার আগুন গেলে
তা-থৈ নৃত্যে ধরে ভৈরবী গীত…