ফারুক সুমনের জন্ম ১ মার্চ, ১৯৮৫। শাহরাস্তি, চাঁদপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণি) ও উচ্চতর এম.ফিল (২০১৪) ডিগ্রি অর্জন। অ্যাকাডেমিক কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন ‘নিপ্পন ফাউন্ডেশন অব জাপান’ (২০০৬) শিক্ষাবৃত্তি। ২০১৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘সার্ক সাহিত্য সম্মেলন’ এবং ‘নেপাল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’-এ যোগ দেন। সম্পাদনা করেছেন (যৌথ) লিটল ম্যাগাজিন ‘অক্ষৌহিণী’। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ‘পোয়েম ভেইন বাংলা’। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘রউফিয়ান রিদম সাহিত্য সম্মাননা-২০১৬’, ‘উচ্ছ্বাস প্রহর সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯’, ‘সমতটের কাগজ লেখক সম্মাননা-২০২০’ ও ‘দোনাগাজী পদক-২০২১’।
বর্তমানে ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ’ (রাইফেলস কলেজ, বিজিবি সদর, পিলখানা, ঢাকা)-এ বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন।
এই প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো: অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে (২০১৭), আঙুলের ডগায় সূর্যোদয় (২০১৮), বিচঞ্চল বৃষ্টিবিহার (২০২০) ও বিরামচিহ্নের কান্না (২০২২)। প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হলো: শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ (২০১৫), শিল্পের করতালি (২০১৯), শামসুর রাহমানের কাব্যস্বর (২০২১) ও শিল্পের সারগাম (২০২২)। ভ্রমণগ্রন্থ: ভ্রমণে অবাক অবগাহন (২০২১)।
নির্জন প্রান্তিকে
তোমরা যারা কবিতা লেখ
অথবা শব্দ কারিগর
আমাকেও ডেকে নিও
চিনিয়ে দিও কবিতাঘর
আমার কোনো দশক নেই
জনহীন প্রান্তিকে—
আমি এক দলছুট কবুতর।
উঠে এসেছি হামাগুড়ি দিয়ে
কনুইয়ে কাদার দাগ
হাঁটুর বাটিতে কালো মতো কড়া
আমি তবে কোন দশকে যাব?
সত্তর, আশি, নব্বই?
না, তাও নয়। তবে শূন্য!
এভাবেই দশক বিচ্ছিন্ন হয়ে
ভেসে বেড়াই মহাশূন্যে
অবর্ণনীয় বর্ণমালায় বিবৃত জন্মবৃত্তান্ত
হে কবিতাদেবী! দশক চাইনা
কবিতার দান দাও; দাও অমরতা
দাও বিমূর্ত মিনারের শুভ্র অবয়ব।
ধূলিভায়োলিন
কবির মৃত্যুর পর
কিছু কবিতা মুখ্য হয়ে ওঠে
ভীতসন্ত্রস্ত হরিণের বনে
অনন্ত দুঃখ জমে থাকে।
এই যে নকশাকাটা লতাফুল
বাটালির মুহুর্মুহু আঘাতের দাগ
সুশোভিত দেয়ালের গায়
তবু মৃত্যুই যেন চিরন্তন ডাক।
এত যে অবারিত প্রীতি
কাজলটানা চোখ, চিকন সিঁথি
মিহি ডিজাইন চৌকাঠে, অবয়বে
এখানে কাঁদবে একদিন, ধূলিভায়োলিন।
ফসলকাটা মাঠে মাঠে বিরহ-নীরব
ঈর্ষার কলহাস্যের শিকার হয়ে
ভীষণ বিনীত দেখো ময়ূরের মুখ
ঝাঁপি থেকে উড়ে যায় অদৃশ্য পাখি
কিভাবে রুখবে তার আদরের সাখী!
বঁধুর আঁচলে বাঁধা প্রণয়ের ফুল
পাখি রূপে উড়ে যায় যদি হয় ভুল
একবার চোখে তার ভেঙেছে পাহাড়
তারপর কোনদিন নেয়নি আহার।
আহারে চর্যার নারী টিলাতেই বাস
আজন্ম করেছিলে দুঃখের চাষ
জলরেখা দেখে দেখে শিখেছ প্রণয়
জলবনে একা একা শুধু অভিনয়।
রক্তবর্ণ ফুল এনে দিয়েছ কসম
প্রণয়ের নাম করে দিও না জখম
এখন হেমন্ত ঋতু রিক্ত অনুভব
ফসল কাটা মাঠে মাঠে বিরহ নীরব।
মনে মনে পুষে আছো কাঁচের সিঁড়ি
মাটিতে হাতের তালু আদুরে মোকাম
পায়েতে পথের ধুলি ডাকে দূরগ্রাম।
নিরক্ষর ভালোবাসায় বেশি উল্লাস্বর
অবুঝ বেহুলা তাই খোঁজে লখিন্দর।
করাতকাঁটার খাঁজে খাঁজে বিচ্ছেদের সুর
কবিও করাতকাটা কষ্টে কষ্টে ভোর।
মনে মনে পুষে আছো কাঁচের সিঁড়ি
মনে মনে জনে জনে প্রণয়বাড়ি।
ঘোড়দৌড়ে ধুলি ওড়ায় বেজন্মা বাতাস
ধুলিকণার স্ফূলিঙ্গে আলোকোদ্ভাস।
খুরের দৃশ্যে ভাসে রক্তজবা চোখ
মুহূর্ত মিলিয়ে গেল তাই এতো শোক।
এতোটাই বেপথু হলে তিমিরের খোঁজে
বিবেক বিবস করে ভোগবিলাসে মজে।
বেঁচে দিয়ে সুরম্য আবেগের বাড়ি
মনে মনে পুষে আছো কাঁচের সিঁড়ি।
জালের জমিন জুড়ে ছেঁড়া হাহাকার
রক্তজলে ধোয়া এই ধীবর জীবন
ভালো লাগে না, পোড়ায় ভীষণ
জল নেই এখন আর জলের মতন
নদী মরে পড়ে আছে, সাপের জখম
কান পেতে শোনা যায় মাছের মাতম।
শৈশবে, পিতার পাতানো জালে
আমার হাতের ডুলা ভরে যেত
নানাপ্রকার মাছের আহ্লাদে।
সেই শখ ফুরিয়েছে এই আকালে
বেড়েছে দিনে দিনে দেনা ও দূষণ
জালের জমিন জুড়ে ছেঁড়া হাহাকার
তালি দেওয়া অজস্র চোখের কিনার।
ডুলা হাতে জাল নিয়ে ধীবর জীবন
পিতা, ওপারে ডেকে নাও- কসম
রক্তজলে ধোয়া এই ধীবর জীবন
ভালো লাগে না, পোড়ায় ভীষণ।
আদর্শলিপি ও ধারাপাত
তারপর কালের কলস ভেঙে জলের হাসিমুখ
গড়িয়ে পড়ে বয়সের পৌরাণিক সিঁড়ি বেয়ে
যতই গত হয় দিন, অবনত মনের হরিণ
আদর্শলিপি তলিয়ে যায় ধারাপাতের গহ্বরে।
সেই শৈশবে বর্ণপরিচয় আর নীতিপদ্য পড়ে
মায়ের স্নেহধারা বাবার মৃদু শাসন মনে পড়ে
শৈশবে আদর্শলিপি পড়ে শিখেছি বর্ণবানান
ভেবেছি এই বই বুঝি পৃথিবীর আসল সবক।
অথচ বয়সের ব্যবধানে জীবনসায়াহ্নে এসে
বিমূর্ত ধারাপাত হাতে বার্ধক্যে দিয়েছি হেলান
পাশেই শৈশব, আদি-আসল আদর্শলিপি, হায়!
আদর্শকথা তলিয়ে যায় ধারাপাতের গহ্বরে।
আদর্শলিপি, মানবিক বাগানে প্রথম বৃক্ষরোপণ
ধারাপাত, গণনা শিখে হয়েছি হিসেবি, লোভী।
পাপ ও পতন
হয়তো মোহ, হয়তো মায়াজাল
হয়তো কন্দর্পকান্তির মতো
নিঃশব্দে সময় কাটে
কিছু মৌনমুখ, কিছু মুখরতা দেখে।
এই যে আমাকে দেখ—
কেমন হেসে উঠি গানের জলসায়
কেমন ঝলসে উঠি ধূসর পাতায়
দুধঢালা পর্বতের খাঁজে খাঁজে
হারানো হৃৎচিহ্নের খোঁজে।
মানুষ মূলত চিহ্নের অনুগামী
চিহ্নের খোঁজে উদ্ভিন্ন হয়ে
দিনশেষে ফিরে আসে
পাপ ও পতনের গল্প নিয়ে।
মগ্নগিরি, ঝিরিপথ
এই যে মগ্নগিরি, এই যে ঝিরিপথ
এই যে অতৃপ্তি, এই যে আয়ুরথ
তুষারাবৃত মন নিয়ে রয়েছ নিশ্চল
কেমন স্তব্ধতা অথচ শক্তি প্রবল
লুকিয়ে রেখেছ মোহের মোহর।
প্রতিদিন এখানে শতচোখ জুড়ে
আবেগপরায়ণ পাখির বিলাপ
হে হিমালয়, তুমি শুনতে পাও?
অনিকেত মন, অন্তরোৎসার।
এখানে নারীমন খুঁজে ফেরে ঘর
এখানে পুরুষ যেন নিঃস্ব যাযাবর
এখানে শিশু যেন আবেগের চাঁদ
এখানে বৃদ্ধ যেন অন্ধকার রাত।
জলধোয়া দেহ
অচঞ্চল জলের ভাষায় ডেকেছিলে কবে?
মনে নেই আঁকাবাঁকা ঢেউ
মনে নেই ডেকেছিল কেউ।
অচঞ্চল জলের ভাষায় ডেকেছিলে কবে?
মনে নেই জলের বুদবুদ
মনে নেই জলধোয়া সুখ।
অচঞ্চল জলের ভাষায় ডেকেছিলে কবে?
মনে নেই জলজ জোয়ার
মনে নেই জলজ বিহার।
তারপর জলবাসের আশায়—
ফেনায়িত দীর্ঘ ভ্রমণ
গাঢ়তর গভীর রমণ।
তবুও আঁকাবাঁকা সাপের সাঁতার
তবুও প্লাবন—
ডাকাতিয়ার ঘাটে ঘাটে জলধোয়া দেহ
আমাকে ডাকে না, ডাকে না কেহ।
জলপ্রেম
জলের শরীরে শয্যা পেতে
লিখে চলি জলপদাবলি
জলময়ী ফিরে এসো তবে
সিক্ত হোক মরুবুক বালি।
আমাদের কথা হোক
জলজ সুরে
আমাদের দেখা হোক
প্রণয় পুকুরে।
জলের তলদেশে
রতিশেষ পরিণতি নিয়ে
শয্যারচনা করে
ঘুমিয়েছে বারুণী বরুণ।
জলের নাভিমূলে
ভীষণ আহ্লাদে
ফুটেছে জলজ কুসুম।
স্বর্গের লোভে বিচূর্ণ চাঁদ
স্বর্গ দেখানোর ছলে
নিয়ে গেলে নির্জন প্রান্তিকে
রাতের গহবরে
সমুদয় ধ্যানমগ্ন দিন।
স্বর্গ-সন্ধানে যত হাঁটি
ততই দিকশূন্যপুরের বাঁকে
জোনাক জ্বলে অন্ধকারে
বিভ্রমে মনের হরিণ
ধীরে অন্ধ হয়ে যাই।
কিছু নাই, কিচ্ছু নাই
দৃশ্যান্তরের পাণ্ডুলিপি ছাড়া
মর্মার্থ উদ্ধারের আশায়
অনুভবে যেন শীত নামে।
স্বর্গের লোভে চূর্ণ হয় চেতনার চাঁদ
ভয়ে বয়ে চলে একলা ফোরাত
জল আর জল
ধীরে অন্ধ হয়ে যাই।
অন্ধের আলো নেই
শব্দ আর গন্ধই গন্তব্য তবে!
স্বর্গ-সন্ধানে অন্ধ হওয়ার পর
শব্দই সত্য—
শব্দই পথচলার পরম প্রতীতি।
স্বর্গ দেখবো বলে—
গন্ধের বুকে মাথা রেখে বন্ধু হয়ে থাকি
ধীরে অন্ধ হয়ে যাই।
যত হাঁটি ততই অলৌকিক গ্রাম
প্রশ্ন বিস্তারে—
কোথায় কথিত সেই অমরাবতী।
কবরের প্রতিবেশী
মসজিদের কাছেই আমার আবাস
মাঝে মাঝে মাঝরাতে অথবা ভোরে
অথবা করুণ সুরে ভরদুপুরে
একটি বিষাদবাক্য উড়ন্ত ছুরি হয়ে
হানা দেয় অন্তঃপুরে।
এসেছে মৃত্যুদূত নিয়ে গেছে কারে!
মুয়াজ্জিন মিহি সুরে ডাক দিয়ে যায়
হাওয়ায় ভেসে ভেসে ইথারে ইথারে
আসে সংবাদ, কখনো সদ্যোজাত শিশু
কখনোবা অশীতিপর বৃদ্ধের নামে
বাক্যটি এসে বিঁধে যায় মর্মমূলে
‘একটি শোক সংবাদ…
ইন্তেকাল করিয়াছেন।’
চিরবিদায়ের এই ডাক শুনে শুনে
ক্রমশ আমিও ঘুমিয়ে যাই
কবরের প্রতিবেশী হয়ে।
মানুষের মুখে মুখোশের হাসি
মাঝে মাঝে নীরবে সরে যাই, যেতে হয়
এটাই নিয়তি মেনে মানচিত্রে মাথা রাখি
দীর্ঘশ্বাসের হাওয়া এসে লাগে—
পাথর গড়ায়; ভিজে ওঠে পাথরের আঁখি।
যাপিত যৌনজীবন কেবল মানুষের নয়;
তবু কেন ফেটে যায় মানচিত্রের মাটি
ধর্ষণহিংস্রতায় নদীর তলদেশ জলশূন্য
হৃদয়হীন মানুষের মুখে মুখোশের হাসি।
প্রাণের উচ্ছ্বাসে, পাখিও ভালোবাসে
পরস্পর কাছে আসে প্রণয়প্রবাহে ভাসে
অথচ মানুষের মুখে মানুষের হাসি কই?
এসো মানুষ, তবে প্রণয়প্রকাশে পাখি হই।
মানুষ হয়ে যায় করাতের দাঁত
সঙ্গ পেলে ভঙ্গ হয় নিমগ্ন ধ্যান
বহুদিন আগে রাগ-অনুরাগে
বৃন্তচ্যুত ফলের মোহে
নিভে গেছে দীপ, মুছে গেছে দাগ।
তারপর—
তাপিত প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে
মানুষ হয়ে যায় করাতের দাঁত।
তাবিজ পুরাণ
প্রতিদিন বাড়ি আসে ব্যর্থ ইতিহাস
অম্লজলে লিখে রাখি আফিমের চাষ।
উর্বর জমি জুড়ে ব্যর্থতার বীজ
ছড়িয়েছি বীজ নয়; বাঁচার তাবিজ।
কৃষকের গোলা ভরে তাবিজ পুরাণ
কৃষকের কানে বাজে শ্মশানের গান।
হাতের তালুতে আহা কষ্টের কড়া
অহোরাত অনশনে শুধু নড়াচড়া।
ক্ষেতের আইল ভাঙে অবুঝ ইঁদুর
কৃষকের মন ভাঙে স্তব্ধ দুপুর।
ঋণের হরিণ কভু ছাড়ে না তো পিছু
আমি যে চাষার বেটা জাতটাই নীচু।
পুলকসঞ্চার
শব্দটি এমউচ্চারণমাত্র প্লাবিত হয় আবেগের বন
উড়ে যায় হাওয়ায় দুই অক্ষরের পাখি
শব্দটি এমন
উচ্চারণমাত্র অনুভবে শীত নামে
হৃৎ প্রান্তরে শুরু হয় রৌদ্রোৎসব।
শব্দটি এমন
উচ্চারণমাত্র বাহিত হয় বেহুশ বাতাস
পুষ্পপুরে, পাতায় পাতায় পুলকসঞ্চার।
শব্দটি প্রেম
উচ্চারণমাত্র ঝলসিত বিবেকের ডানা
ধ্যানাসন ছেড়ে নেমে পড়ে মুনিঋষি।
কামুক শীতপাখি
শীতবিকেলের গল্পের নামে
উঁকি দেয় কিছু শরমের চোখ
মর্মন্তুদ রক্তকথা-
হামাগুড়ি দিয়ে
ঢুকে পড়ে কুয়াশাকন্দরে।
পাতাঝরা মুখ, অসহায় শীতঋতু
প্লাস্টিক ফুল ঝুলে থাকে
অতিথিশালায়, কুয়াশাবেলায়।
ফসলকাটা মাঠ, শেষকিনার ধোঁয়াময়
সেখানে প্রেমভাঙা ইট
ডানার বিস্তারে ঢেকে যায় হিমক্ষেত্র।
শীতের শরীর ঘেঁষে
দাঁড়িয়েছে কামুক শীতপাখি
সূর্যের বুকে মুঠোফোনের চার্যার
সারারাত উষ্ণ শ্বাস, শরমের চোখ।
মৃৎভাণ্ডে রেখে যাই হৃৎচিহ্ন
অস্বীকার করতে করতে—
এক আগরবাতি জ্বলা সন্ধ্যায়
আচমকা আমাকে দিয়েছ স্বীকৃতি
তারপর এও বলেছ
‘তোমার কবিতা আমার ভালো লাগে।’
এভাবেই ভীষণ শম্বুক গতিতে
ঈর্ষামুখগুলো কবিতামিত্র হয়
রোদ ওঠে, ফুল ফোটে
কবিতাশ্রমে বুঁদ হয়ে বসে
মৃৎভাণ্ডে রেখে যাই হৃৎচিহ্ন।
জন্মদিনের ঋণ
দেখে হাসি, তবুও ভালোবাসি
জীবনসায়রে কেউ কেউ
এভাবেই তোলে জীবনানন্দের ঢেউ।
আমিতো গোপন ছিলাম সুরবাহারে
আমিতো গোপন ছিলাম প্রণয়পুকুরে
যৌথ ভালোবাসায় এসেছি ভেসে
এ-বেলায়, এই বাংলায়।
ঘুমিয়ে গুহাগহবরে থেকেছি অনন্ত দিন
মুমূর্ষু মাছি ভেবে রেখেছ দূরে, উড়তে পারিনি
কামার্ত কবুতরের শীৎকারে ভেঙেছে ঘুম।
আবেগকাতর প্রাপ্তবয়স্ক শিশু
মাটির শরীর নিয়ে মাটিতেই হাঁটি
কারণ প্রতিটি ভোর ভোরের মতো নয়
কিছু ভোর বিভোর হয়, হয় আলোময়।
মৃত্যুতে মুছে যাবে কাগজের কাল
তারপর শুরু হবে মৌলিক সকাল।
সম্পর্ক
রাতদিন টাকার ঘ্রাণে যা হয়—
ক্রমশ ভাঙে তীর
নদীও শুকিয়ে যায়
শাণ কমে মরিচা জমে
শাণিত ছোরায়।
তরতাজা লতাও অমনোযোগিতায়
একদিন ঢলে পড়ে
মাথা রাখে শূন্যতায়।
এভাবে অলক্ষ্যে হাওয়ায়—
মুছে যায় সম্পর্কের দাগ
আমাদের সম্পর্কগুলো পরিচর্যায় থাক।
নামতাড়িত মানুষ, কামতাড়িত কুকুরের মতো
তারপর কৈফিয়তের ফুল কাদায় ঝরে পড়ে
এই মর্মে, বৈরিকালে কাদাবর্তী থাকা ভালো
চৌদিকে অতি সুনামের ঘোর, আত্মমৈথুন
কেবল স্বনামের মোহে মলে দেয় মুখ
দৃষ্টি দিয়ে পেতে চায় সৃষ্টির আস্বাদ।
এরা বেপরোয়া খ্যাতির কাঙাল
নামের ধ্বজাধারী চোরাকারবারি
নামতাড়িত হতে হতে একদিন
নিজেরে খুঁজে পায়
কামতাড়িত কুকুরের আস্তানায়
নামতাড়িত মানুষ, কামতাড়িত কুকুরের মতো।
বিদায় বিষণ্ণতা মোলায়েম ফুল
দিনান্তের খোঁজে নিত্যই শুরু হয় দিন—
আনারস ফুলের আশায় উন্মুখ মন
কিন্তু না ফোঁটা ফুলের হতাশায়—
আছড়ে পড়ে রাজ্যের ঢেউ
ভাঙে চাক চাক মাটি
তলিয়ে যায় অপেক্ষার নাও।
দিনগুলো গত হয় অবনত মনের হরিণ—
খসে পড়ে উপকেশ
কোথাও নেই মিটিমিটি আলোঘর।
গোরের নীরবতায় স্তম্ভিত একাহারী
এই বলে চলে যায়—
বিদায় বিষণ্ণতা মোলায়েম ফুল
বাতাসে কামের আভাস বাকী সব ভুল।
চিত্রখচিত শবাধার
মুষ্টিবদ্ধ হাত মেলে দিতেই
ঝনঝনিয়ে মুদ্রা পড়ে।
সে কী দৃশ্য!
অবাক হয়ে দেখি দ্বিচক্রযানের ঘুর্ণন
দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে—
ফিরে যাই ঋণদাতার দহলিজে।
আমার মৃত্যুদিন নথিভুক্ত থাকে ঋণের চাপে।
ঋণ যতো বাড়ে—
সমকালে মৃত্যু ততো নিকটবর্তী হয়।
ঘরময় ঠাণ্ডা অনুভূতি নিয়ে—
বিরাজ করে সুগন্ধযুক্ত আগরবাতি।
আতর আর আগরবাতির গন্ধে
নিজেকে আবিষ্কার করি চিত্রখচিত শবাধারে।
অন্তহীন জলের গান
বহুদিন ধরেই তো জল তুলে নলে ঢেলেছি
পূর্ণতার লোভে, ধরেছি জলের গান
এভাবেই বেড়ে চলে জীবনের পরিধি
নলের অন্ত কোথায় মেলেনি সন্ধান।
পরিণত প্রণয়ের দিনে
স্বল্পবসনা নারী ভীষণ অনাহারী
পাড়ভাঙা
. নদীর মতো
. বিরহে থাকুক।
কামার্ত পুরুষ মুহূর্তের মুখরতায়
ভুলেছে উৎসমুখ
. বনবাসের কথা
অথচ একদা এই বনে যৌনজীবন।
অথচ একদা
. এই বনে
. যৌথমরণ
এখনও পড়ে আছে রতি, মধুরাতি।
এভাবে ভুলে গেলে গানগুলো ঘুম হয়ে যায়
স্তব্ধতা, ফিরেয়ে দাও—
লতাগুল্মবৃক্ষের ছায়া সুনিবিড়।
মেঘের ভাষ্য
এই বর্ষায় মেঘের ভেলায়—
বাহিত হয়েছে কিছু মেঘময় দিন
প্রতি অঙ্গে ভেজা অনুভব
মেঘসংঙ্গের গোপন সংকেত
মেঘের সহাস্য ভাষ্যে জেনেছি—
মেঘমানচিত্র মানে কামের কুহক।
মেঘও জানে—
ভালোবাসা ব্যতীত বর্ষণ যে ধর্ষণের মতো
বর্ষণ বঞ্চিত সময় ভীষণ যন্ত্রণার
মেঘের তাই মেঘের মতোই
থমথমে কালো কষ্ট
নিঃসীম আকাশে এতো ওড়াওড়ি
মেঘ সেখানেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে
যেখানে শুধুই ভালোবাসার সংশ্রব।
বাহানার দিন
বহুদিন রোদের দোকানে যাওয়া হয় না
এখানে অন্ধকার প্রিয় জনকোলাহলে
অভ্যস্ত হয়ে কিনেছি মাটির তৈজস
গলির শেষে অন্ধকার মোড়ে
ভাড়া নিয়েছি বাহানার দিন
ওড়ে কবুতর; আমি দেখি।
প্রত্নখননের অজুহাতে—
খুঁড়েছি মৃত্তিকার বক্ষদেশ
সেখানে মায়াময় মৃগকঙ্কাল
যে কিনা ভালোবাসার নামে বলি হয়েছে
ধোঁয়া উড়ে। আমি দেখি।
বাগানজুড়ে ফুল নয়; পাতাদের কানাকানি
মনে মনে দিনরাত কোদালের কোপ;
শিরায় শিরায় শিহরণ যতো
প্রবাহিত হয় রোদের দিকে
ও রোদ! তুমি কোথায়?
কামুক শীতপাখি
শীতবিকেলের গল্পের নামে
উঁকি দেয় কিছু শরমের চোখ
মর্মন্তুদ রক্তকথা—
হামাগুড়ি দিয়ে
ঢুকে পড়ে কুয়াশাকন্দরে।
পাতাঝরা মুখ, অসহায় শীতঋতু
প্লাস্টিক ফুল ঝুলে থাকে
অতিথিশালায়, কুয়াশাবেলায়।
ফসলকাটা মাঠ, শেষকিনার ধোঁয়াময়
সেখানে প্রেমভাঙা ইট
ডানার বিস্তারে ঢেকে যায় হিমক্ষেত্র।
শীতের শরীর ঘেঁষে
দাঁড়িয়েছে কামুক শীতপাখি
সূর্যের বুকে মুঠোফোনের চার্যার
সারারাত উষ্ণ শ্বাস, শরমের চোখ।
জীবনের ধারাবাহী মিথ
বয়সী বৃক্ষের গোড়ায় রঙকরা পাথর-নুড়ি
পাতার অনড় দিনে উড়তে চায় রঙকরা ঘুড়ি
ললাটের জমিনজুড়ে আয়ুক্ষয় গমন-রেখা
তবুও বাঁচার ছলে ভুলে যাই বিয়োগ-কথা।
আমি তবে প্রলেপনকারী! রঙের কারবারি?
বাঁচার তাড়নায় বেঁচে দিই সমুদয় আশ্রয়ী
রাস্তার শেষ বাঁকে আমি সেই নি:সঙ্গ গ্রাম
পথিকের চলাচলে ভুলে যাই স্ব-সর্বনাম।
এখন এসেছে দিন, করতলে কৃত্রিম নড়ি
হাতড়ে হাতড়ে খুঁজি পরিশুদ্ধ জীবন-সিঁড়ি
সম্মুখে চৌচির তাপিত পাথার, অনন্ত দিন
ফেরার পথ নেই, হা হয়ে আছে বিগত ঋণ।
এই ভেবে মেনে নিই জীবনের ধারাবাহী মিথ
প্রতিটি সৃষ্টিদিনে মনে অনুরণে প্রলয়সংগীত।
বালিধস
আমারও দুঃখ আছে
আছে রোরুদ্যমান মধ্যাহ্ন
বিকেলের তেরচা রোদ
সন্ধ্যায় আবাস হারানোর আর্তি।
এই নির্লিপ্ত মানুষের দেশে—
কিছুতে কিছু যায় আসে না
স্বাধীনতা, বাইরে সবুজ উপত্যকা
ভেতরে ক্ষীয়মাণ বালিধ্বস।
রক্তভেজা কিশোরের লাশ
পড়ে থাকে স্বাধীন সড়কে
চাকায় পিষ্ট হয় বাকস্বাধীনতা
বাস্তবে গুড়ো হয় গরিবের হাড়।