কত করে বললাম, চলে এসো কিছুতেই এলে না তুমি
পাহাড় অরণ্য আর সমুদ্রের মায়া ছিন্ন করে
এলে না আমার সঙ্গে ঢাকায়
তোমার কি মনে পড়ে কবিতা
সেদিন মেঘের গম্বুজে ঠেস দিয়ে তুমি আর আমি
অনিমেখ দেখছিলাম
সমুদ্রের অপার সহস্যাবৃত জলের প্রান্তর
তুমি মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলে কি সুন্দর!
আমি সেই মহাসুন্দরের তলদেশে
অবলীলায় নেমে গেলাম
তোমাকে আবিষ্কার করতে
কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠলাম কিছু বর্ণিল শব্দ সঙ্গে নিয়ে
তুমি বললে গাঁথো একটার পর একটা
আমি তাই করলাম
আমি অমনি তৈরি হয়ে গেল
তোমার আদলে এক নারীমূর্তি
এরপর থেকে আমি কোনো নারীমূর্তি দেখলেই
তাকে কবিতা-কবিতা বলে ডাকি
অথচ তুমি ঈর্ষায় কাতর হতে না
লজ্জায় নির্মীলিত হতো না তোমার চক্ষুযুগল
কবিতা তুমি কি এখনো
কর্ণফুলীর স্বচ্ছজলে সাঁতার কাটো?
নাকি রাঙ্গামাটির ফালিটাঙ্গাচুড়ে বসে
সেবন করো জলধোয়া বাতাস
এক সময় গুলেমর গন্ধে ঘুম আসতো না তোমার
তুমি বলতে,
চলো আমরা এমন সৌন্দর্য স্পর্শ করে মরে যাই
আমি হাসতাম তোমার মেয়েমানুষী দেখে
জানো কবিতা,
আমি এখন যন্ত্রণায় চটপট করা শহরের
যান্ত্রিক জট আর কোলাহলে স্নান করি
আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়
ডলার আর দিনারের সৌরভ
ঢাকা শহর প্রতি মুহূর্তে প্রসব করে ঘৃণা আর ক্ষোভ
প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির টানাপড়েনে
নতুন কোনো কবিতা আমার পাশ ঘেঁষে না।
আমার ভূতপূর্ব আবেগগুলো মাথাছাড়া দিয়ে ওঠে
যদিও এখানে, এ শহরে আবেগের কোনো মূল্য নেই
বাস্তবতার কঠিন শিকলে বন্দি এখানকার মানুষেরা
কৃত্রিমতার মিশ্রণে বায়ু দূষণের মতো,
প্রতিনিয়ত দুষিত হয় ভালোবাসা
মূল্যহীন আবেগের মতো এখানে ভালোবাসারও মূল্য নেই
ভালোবাসা হলো
ব্যাংক থেকে উড়ে আসা কড়কড়ে টাকার গর্জন
ইট আর পাথরের তৈরি উঁচু-উঁচু অট্টলিকাগুলো
নীরব দর্শকের মতো রোদন করে
এ শহরে প্রতিদিন
অনিয়মের অত্যাচারে ক্লান্ত প্রতিটি রাজপথ
কিছু কিছু রমণীর চোখ থেকে নির্গত হয়
আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা
আমি সেই লাভাস্রোতে ভাসতে-ভাসতে
নিজের অজান্তে শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়াই
জানো কবিতা,
সেদিন এ শহরেই ঘটে গেছে এক অত্যাশ্চর্য কাণ্ড
তোমার মতোই দেখতে এক রমণীকে আমি
কবিতা-কবিতা বলে ডাকতে থাকি
আমার মনে হলো তুমিই বোধ হয়
চলে এসছো আমার সন্ধানে এ শহরে
রাতের কোনো এক প্রহরে
ফিরিয়ে নিতে তোমার কবিকে
সে রমনী আমার দিকে তাকালো রাজ্যের সব ক্রোধ এক করে
আমি যেন এক নব্য রোমিও
যে কিনা সেক্সপিয়রের পাণ্ডুলিপি থেকে
পালিয়ে এসেছে একটু আগে
তারপর সে আমার দিকে নিক্ষেপে করল অগ্নিবর্শা
তার আগুনখচিত দুটি চোখ
প্রজ্জ্বলিত বাত্যাচুল্লির মতো গনগনে
যেখানে লোহার আকরিক শোধন করা হয়।
আমার অনুভূতিগুলো মুহূর্তেই ব্যবচ্ছেদ হলো
আমার খণ্ডিত আত্মা লুটিয়ে পড়ল তার পদতলে
বৈক্লব্য সরোবরে আমি আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে
পূণরায় ভেসে উঠলাম
অদৃশ্য এক ইশারায়
আমার খল্ডিত আত্মা জোড়া লেগে গেল
অবসাদগ্রস্ত অনুভূতি পুনরায় তরতাজা হলে আমি দেখলাম
কিছু কালো রক্তের জমাট বেঁধে আছে চারদিকে
বুঝলাম এ শহরে এলে
মানুষের রক্তও কালো হয়ে যায়
বিকল হয়ে যায় মানুষের হৃদপিণ্ড
ভালোবাসা উৎপন্ন করার মেশিন
এখানে এ শহরে প্রতিদিন
কারণে অকারণে খুন হয় সবুজগুল্ম
উজাড় হয়ে যায় লহমায় উদ্যানের পর উদ্যান
প্রতিটি গলি পথে ফুটপাতে
তপ্ত নিঃশ্বাসে বিবর্ণ হয বিবেক
মহাসাগরীয় স্রোতের মতো ছুটছে মানুষ
অথচ গন্তব্যের দেখা পাওয়া
আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র
এখানে মানুষেরা শুরু কতে পারে
যার কোনো শেষ নেই
অন্তহীন শোকে বিমর্ষ তরুণ প্রজন্ম
আমি তাদের অক্ষিকোটরে
ভাঙা স্বপ্নের টুকরোগুলো অবলোকন করি।
তোমার মতো গুটিকয়েক কবিতা
যাদের আমি চিনেছি লৌকিক কাব্যকোলাহলে
যারা প্রতিনিয়ত প্রতিভার
খনন কাজ চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়
অথচ ওদের এ শহর মনে রাখে না।
অরিন, দীবা, জিনাত, পারভীন
আরও অনেক নাম না জানা তোমার সহোদরা
যাদের পাঁজর পঙ্ক্তির প্রাচুর্যে আলোকিত
অথচ এ শহর ভক্ষণ করে তিমির
গ্রাম হতে সদ্য আগত জরিনা, স্বামী পরিত্যক্তা সখিনা
নিজ নিজ ছিন্নভিন্ন সুখস্বপ্নগুলো
সেলাইয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়
কিন্তু সেখানেও অন্তহীনতার প্রাদূর্ভাব
কিছু অদৃশ্য শকুন তাদের স্বপ্নগুলো চেটেপুটে খেয়ে নেয়
মানুষের পদভারে যন্ত্রনামুখর এ শহর
পরাজিত সৈনিকের মতো কাতর পর্যুদস্থ
আমি কতো মধ্যরাত শহরের ফুটপাথ ধরে
হাঁটতে হাঁটতে দেখেছি
দূঃখগুলো শুয়ে থাকে সমান্তরাল
নিশীথের মৃত্তিকায় কান পেতে আমি শুনতে পাই
দুঃখের হতাশার জটের অব্যক্ত অস্ফূট কান্না
কখনো কখনো বসে থাকি
রাতের বারান্দায় উৎসবহীন বিষণ্ন মাছির মতো
দেখি, আমার রক্তে অনাগত মানুষের ঢেউ
প্রবহমান মানুষগুলো শূন্যতা বোঝাই করে
এগিয়ে আসছে প্রতিদিন
আমি শংকিত হই ভেবে
এখনই সতর্ক না হলে একদিন এ শহর
মানুষবাসের অযোগ্য হবে।
এখন যেমন প্রতিটি মোড়ে যানবাহনগুলো গায়ে গায়ে
লেপ্টে থাকে ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগায়
তখন পুরো শহরময় শুধু গাড়িতে মানুষে ভরে যাবে
সামনে এগোনোর কোন ফাঁকা জায়গা থাকবে না
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে নিশ্চল পর্বতের মতো
এক স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন
কবে জন্ম হয়েছিল এ শহরের?
কারা গোড়াপত্তন করেছিল এ নগরের
কতদিন আগে, কত বর্ষ আগে
কেউ বলে চারশত বছর
কেউ বলে তার চেয়েও অধিক
কী ছিল এর পূর্বে এ মাটিতে?
কারা ছিল কিভাবে ছিল
আমার জানতে ইচ্ছে করে খুব।
জানো কবিতা
হে আমার পর্বতসমুদ্রবন আচ্ছাদিত
অহিংস আত্মার আত্মীয়া
এখন এ শহরের সাথে আমার স্থাপিত হয়েছে
আত্মিক যোগাযোগ
আমি তার সাথে কথা বলি সঙ্গোপনে
আমি তার সাথে কথা বলি সঙ্গোপনে
আমি মুছে দিই তার আপ্লুত চোখ দুটি
সে বলে, কবি আমার তলদেশে কিছু চাকা লাগিয়ে দাও
আমি চলে যাবো গ্রামের নিসর্গের কাছে
চলে যাব নদীনালা খালবিল জলাশয় ঘেরা মায়ের কাছে
যেখানে আমার প্রকৃত স্বদেশ
এখনো উজ্জ্বল চন্দ্রের মতো জ্যোতির্মান
যেখানে ভোরের আবীরের ভেতর ওড়াওড়ি করে পাখিরা।