চিড়িয়াখানা
সহসা একেবারে বিরাটাকায় ভাল্লুক চৌরাস্তার মোড়ে ঘণ্টা পেটাতে শুরু করে। নগর কতোয়াল সিংহ সমস্ত খাঁচার দরজা মুক্ত করে দেয়। শাখামৃগ সকল কিচির- মিচির ডাকে মুখরিত করে রাজপথ। আর বনের মধ্য থেকে আজব মানবসম্প্রদায়-ভুক্ত নর-নারী-শিশুদের বেঙ্গল টাইগার খেদিয়ে আনে উন্মুক্ত খাঁচার প্রান্তে। ধূর্ত শেয়াল রূপকথার গল্পের মতো বিভিন্ন খাঁচায় এক এক করে প্রদর্শন করে মানব-সম্প্রদায়। পুরুষ, নারী, শিশু এভাবে পেশাগত শ্রেণীবিভাগ সহজলভ্য হয়ে ওঠে ক্রমশ খাদ্য কর্মসূচি বিনিময়ের নগর পরিকল্পনার ফলে।
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দর্শনার্থী আনাগোনা পাঁচ মুদ্রার বিনিময়ে— অবশ্যই ধাতব। ভুঁড়ি বাগিয়ে হাতি মুদ্রাসংগ্রহ এবং দর্শনার্থী প্রবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত। শাখামৃগ এবং মৃগসম্প্রদায়ের শিশুদের ভেতরেই দর্শনাকাঙ্ক্ষা প্রবল। তারা উল্লসিত, ঢিল ছুড়ে, খাবার দিয়ে হৈহৈ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। রবিবার যেহেতু বন্ধ কতোয়াল আদেশে, তাই শান্ত। এদিন খাবারহীন বিশ্রাম মানবসম্প্রদায়ের। ছ’দিন এলাহি ব্যাপার।
উদ্বোধনী দিনে বিশেষ সুযোগে ফ্রি দর্শক ছিলাম আমি।
১.
চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে পড়া বাঘ, যার সঙ্গে গতকাল দেখা—প্রথমে ভেবেছিলাম কাগজের। পরে দেখি, না, অবিকল আমারই গলায় কথা বলে। হাত আছে, হাতে পিস্তন। ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাবতেই, আমার তিন ছুঁই ছুঁই ছেলে বলে ওঠে, বাবা এতো সেই রয়েন বেঙ্গন, পোষা, আমাকে দোকানে নিয়ে কিনে দিয়েছিল চকনেট। ফমমানিন নাই। তুমি দেখো, হাত বাড়িয়ে দাও,কেমন চুমু করে দেবে।
আহ্লাদে হুটোপুটি খেতে খেতে হাত বাড়িয়ে দিতেই, বাঘ, সত্যিকারের—কোন মিছে ভান নেই—কামড়ে হাতের কব্জি থেকে নামিয়ে নেয় পাঞ্জা। আতঙ্কে, ভয়ে চিৎকার করে ওঠার আগেই ছেলে আমার—বলে ওঠে, বাবা, পালাও, এ সেই মিথ্যেবাদি রাখালের কাছে আসা বাঘ, ভয়ঙ্কর, একেবারে সত্যি। এখনই পিস্তন দিয়ে গুনি কববে। মেরে ফেববে। চলো পালাই।
২.
বাবা, যে বাকুমগুলো উড়ে গেল—তাকে যদি যাদু দিয়ে খরগোশ বানিয়ে দেই—বলো তো কেমন হয়?
বাহ, খুব ভালো তো।
শোন এই খরগোশ কিন্তু খাওয়া যায় না। আমার বাঘ বলেছে শুধু প্লেনে করে যখন চাঁদে যাবে— সূর্যের আলোতে ছারাপোকারা যখন ভয়ে কাঁপতে থাকবে—লাঠি দিয়ে মারতে মারতে—তেলাপোকারা যখন একটি ডলফিনকে তাড়া করবে—তখন কিন্তু তুমি ভয় পেয়ো না।
খিদে লেগেছে বলে—পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি আকাশ থেকে একটি তারা—হাতে নিয়ে কামড়ে কামড়ে খেতে আমার ছেলে—ফিক করে হেসে বলতে থাকে—বাবা—চিবিয়ে খাবার মজাই আলাদা। বাঘ আমাকে শিখিয়েছে।
৩.
বেওয়ারিশ যে কুকুরটা সারাদিন পথের মোড়ে বসে থাকে, আমার ছেলের সঙ্গে যে তার গোপন দোস্তি, মাখামাখি, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া না হলে অজানাই থেকে যেতো। খেলা ফেলে দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে-একবার ফিরে এসে,মাকে আটকাবার ছলে, শেষে আমাকে উদ্দেশ্য করে-হাত নেড়ে- প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ ভুলে-যেন মাঝ সমুদ্রে ভেসে ওঠা দিক নির্দেশক-দুপাড়ের মাঝে সেতু-ঝুলতে থাকা -নদীতে অস্পষ্ট অথচ দৃঢ়- এ যেন স্বার্থপরের মতো নিজেকেই বিপদমুক্ত করে রাখার খেলা। যেখানেকর্তৃত্ব দেখাতে হয়-হাতজোড় চলে না, নম্রতার ভাষা অচল মুদ্রার মতো পোশাকি, সেখানে নিজের অস্তিত্ব স্পষ্ট করে তুলতে-ছেলে আমার বলে ওঠে-আমাকে বিরক্ত করবেন না। আপনারা চুপ করুন, না হলে আমি কিন্তু এই এখনই দরজা খুলে ডেকে আনব ভয়ঙ্কর কুকুরটাকে।
৪.
কত অদ্ভুত প্রাণী যে আছে পৃথিবীতে—আছে বাঘ, সিংহ, শিয়াল, খরগোশ। এছাড়া আর কয়টা প্রাণীর নামই বা আমরা জানি। একবার এক ছেলে—দেখি মানুষের তিনটা করে পা—একটা পা ভাঁজ করে খুলে রাখে—কাঁধে রাখে—চেয়ারের মতো ফেলে রাখে—আর যখন তিন পায়ে দৌড়াতে থাকে—তখন একটা হরিণ ছুটতে ছুটতে কি আর বলব? আচ্ছা এ গল্প থাক, তুমি বরং ভাল্লুকের কথা শোনো। নাকি মেশ শাবকের কথা শুনবে? মেশ শাবক আর ভেড়ার শাবকের মাঝে পার্থক্য খুঁজতে যেও না আবার । আসলে বুঝি না, মানুষ যে কেন ঘুমাতে যাবার আগে ভেড়া গোনে। গুনতেই থাকে। গুনতেই থাকে। নদীর অপর নাম তটিনী—আসলে এইসব ভাবনাই অনর্থক।
৫.
ভাবলে আশ্চর্য হবে একটি ময়ূর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা দুইয়ের মাঝে ভৌগলিক দূরত্ব নয়, সাড়াশব্দহীন একটি ভয়ঙ্কর সাপও রয়েছে। বোবা সাপটির কথা শুনে যারা আঁতকে উঠলেন, ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক না করে ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে অথবা ভুলে না জ্বালিয়েই ক্লিক শব্দে মাতিয়ে তুললেন সামাজিক যোগাযোগেরসব মাধ্যম— আপনারা যদি স্থির হন, সংঘবদ্ধ হন—হারিয়ে যাওয়া বিমান বা তার আরোহীদের নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত না হন, তাহলে চলুন, দেখিয়ে আনি ময়ূরের খাদ্যতালিকা। হয়তো দুঃখ পাবেন, ভুল করে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেবেন ভয়ঙ্কর সাপটির কথা। আকারে ইঙ্গিতে বৈশাখি পূর্ণিমার চাঁদটাকে বাউণ্ডুলে বলতেও পিছপা হবেন না।
তবু সরল সত্য কথাটি না বললেই নয়, তরমুজকে ফালি করে কাটার আগে ক’জন অনুমান করতে পারে ভেতরের অন্ধকার।