প্রকৃত ঈশ্বর
বাড়ছে চন্দ্রকাতরতা—আমরা চলেছি মঘা-অশ্লেষার রাতে—গন্তব্য জানি না বলে
খুঁজে ফিরছি সপ্তর্ষিমণ্ডল—গুরু নানক, এই তো সেই পথ, যে পথে ফিরে এসেছিল
ভাওয়াল সন্ন্যাসী—
পেরিয়ে যাচ্ছি ঘন কুঁচবন—কেউ কেউ বলে, যেতে হবে বিশাখাপত্তম। করোটিতে
প্রশ্ন-পিপাসা—অথচ বিস্ময় ছাড়া আর কোনো যতিচিহ্ন নেই। কেউ কেউ বুঁদ হয়ে
আছে পাণিনি ও চার্বাকে, কেউ সাংখ্য বা যোগে—অথচ আমরা যেতে চাই, যেখানে
শূন্যই প্রকৃত ঈশ্বর।
সঙ্গে নিয়েছি উইকিপিডিয়া আর মহান ঘড়ি—সূর্য ও চন্দ্রের যিনি নির্ভুল অনুবাদক।
মহাশূন্যে কেউ নেই—শুধু ঊষার ইশারা—ভোর হলো—আমাদের চারপাশে
ক্রুশকাঠ, শিবলিঙ্গ; সারি সারি ভেজাবুদ্ধের দল…
সমুদ্রসঙ্গম
ছুটে আসছে ফণাতোলা ঢেউ—এত নাচমুদ্রা ধরে আছ পৃথুল শরীরে…সমুদ্র,
সাঁতার জানি বলে তোমার মাহাত্ম্য এতটা বিশদ—
এই তো দিয়েছি ঝাঁপ। কে জানে তোমার কতটা গভীরে আমার গন্তব্য স্থির
হয়ে আছে—মারিয়ানা ট্রেঞ্চ, না কি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড? বলো, বিষতীর
বিদ্ধ করে কত দূর গেলে শোনা যাবে শিস—শাঁখের নিনাদ?
প্রবালমহল আর ঝিনুক-অরণ্য ঘুরে আজ কোনো মুক্তা কুড়াব না। বরং ল্যাবরাডার,
পেরুভিয়ান স্রোত কেটে কেটে একদিন অন্তরীপবাসী হব। কেননা প্রশান্ত, পীত,
বঙ্গোপসাগর আর শৈবালসমুদ্র ঘুরে আমি আজ জলমুগ্ধ জীব।
একদিন তোমাকেও মুগ্ধ করে দেব। আর জানি, সেদিন লোনা ঢেউয়ের গর্জন
ছাপিয়ে তুমিও বলে উঠবে—সহসা শরীরে বর্শা গেঁথে দিল এ কোন মাছকুমার…
এপিটাফ অথবা চুক্তিপত্র
হয়তো এভাবে একদিন অনূদিত হবে শতাব্দীর নীরবতা—মৌনতা নামে
তোমাদের ভাষাবিজ্ঞানে যুক্ত হলো নতুন অধ্যায়—আমি ওই শ্যাওলা-সবুজ
সমাধিতে ঘুমিয়ে গেলে তোমরা উদ্ধার কোরো তারাদের স্বরলিপি। আর
আমার এপিটাফে জুড়ে দিয়ো একটি নমিত সুর—যার নিমজ্জন পাহাড়ে—
নির্জনতার নিটোল নিস্তব্ধতায়।
যে জীবন পেরিয়ে এলাম, শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্য এসব বাহারি
নামের একেকটি সাঁকো ছাড়া আর কিছু নয়—আর মৃত্যু এক জ্যোতির্ময়
পাখি, বুকের মাঝখান থেকে টুপ করে খুটে নেয় ‘প্রাণ’—সুস্বাদু শস্যদানা।
প্রতিদিন কুয়াশার কংক্রিট ফুটো করে যে এক বিন্দু আলো আসে—ঘুরন্ত
লাটিমের মতো তাকে হাতের তালুতে নাচাই। এভাবে পুরো পৃথিবীটাই নিয়ে
আসি হাতে। তবু দেখো, ঈশ্বরের সাথে বন্ধুত্ব হলো না আমার—
আর তুমি, আয়নায় বিম্বিত পুরুষ—কেবলই ছায়ার মোহে জীবন
আর মৃত্যুর চুক্তিনামায় রেখে গেলে অজস্র অমোঘ স্বাক্ষর—
অলৌকিক অশ্বারোহী
সবাই নক্ষত্রের মালিকানার কথা ভাবে, আমি তার আভাটুকু চাই—
কেউ কেউ বলে, এ অসুখ কবিতাবাহিত—মেনে নিয়ে চলে যাই,
যেদিকে মুখ করে ফুটে আছে রক্তজবাগুলো—পথের সন্ধান দেয়
শীতনিদ্রা থেকে উঠে আসা পিঁপড়ের সারি—তাদের নির্দেশনা শিরোধার্য মানি—
যদিও নাবিক নই, ধ্রুবতারার আলোক দেখে চলি—কম্পাসে
বিশ্বাস নেই—সে শুধু মেরুপ্রীতি জানে—আমি যে ঘোড়ার সহিস,
তাকে দিই স্বপ্নমোড়া ঘাস—তামাম গ্যালাক্সিতে তার অগম্য কোথাও নেই—
ফলত, মুহূর্তে চলে যেতে পারি নেপচুন ফকল্যান্ড জাঞ্জিবার—ভানুয়াতু
অথবা শাকিরার গোপন বেডরুমে—আমি তাকে কল্পনা-অশ্ব বলি—
পালাবার সময় হলো আজ—আলো ফেলো ধ্রুবতারা, পুনরায়
উল্কাপতনের আগে পবিত্র পাহাড়ের দিকে যাই—
আদিম কবিতা
ওই অগ্নিকায়া, মাঝে মাঝে ডেকে যায় মশাল-সংকেতে—
আর আমি খঞ্জনি বাজাতে শুরু করি এক মহাকাব্যিক মহূর্তের সম্ভাবনা
নিয়ে—বেশকিছু মৃত্যু-পরিখা আর ঝঞ্ঝা-উপত্যকা পেরিয়ে তবে ওই চূড়ায়
পৌঁছাতে হয়। অথচ আমাকে নিয়ত লক্ষ্যচ্যুত করে এক দিগ্ভ্রমের পাখি—
ভুলে যাই, নৈর্ঋত নাকি বায়ু, কোনদিকে শুয়ে আছে নিষিদ্ধ পাহাড়—
যারা ভ্রমরপ্রজাতির, যতই রহস্যাবৃত হোক লিপি, সহজেই পড়ে নিতে পারে
প্রতিটি প্রত্যঙ্গের ভাষা। পতঙ্গতাড়িত যারা, তারাও জানে আগুন-আলিঙ্গন,
আদিম আহ্বান আর এইসব ইশারার যথার্থ মানে…
কোনো গন্ধবণিক, ওইখানে, অচেনা ফুলের ঘ্রাণ অনুসরণ করে পৌঁছোবে একদিন,
যে ভরে দিয়ে আসবে নিশিকুম্ভ যত—ততদিন, আমি কেবল ইশারার অনুবাদ করে চলি