গুপ্ত ঝরনার দিকে অভিযাত্রা
বেরিয়ে পড়েছি সাপ-নাচা জোছনার ভেতর, যারা উঠে যেতে চায় সাঁচীর স্তূপ বেয়ে, তারা সব ফণা তুলে আছে; বেশ, তারা আলগোছে গেঁথে দিক বিষদাঁত, এর চেয়ে চলো লরিয়া-নন্দনগড়ে, ওখানে আকাশের দিকে মুখ করে সারি সারি অশোকস্তম্ভ খাড়া হয়ে আছে, চলো, তার সিংহমুখ-চূড়ায় চুমু খেয়ে আসি। তারপর চলো, গুহার ভেতরে সেঁধিয়ে দিয়ে আসি উত্থিত ফণাগুলো, কে না জানে আমরা তুখোড় বেদেনী, একদিন যক্ষীর দেহ নিয়ে শুয়ে ছিলাম দিদারগঞ্জে, পাটনার উপভূমিজুড়ে, প্রত্ন-প্রতিমা ভেবে আজ যারা উপচার নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় আছে, যাই, তাদের মুঠোয় তুলে দিয়ে আসি কাঙ্ক্ষিত আপেল…
ওরা দেখুক, কালো মেঘের কিনার ঘেঁষে দুটো তারা, তার নিচে ফুটে আছে গোলাপ, ওরা নিপুণ অভিযাত্রিক, আপেল বাগান রেখে পৌঁছে যাবে মাথিনের কূপ, এরপর মাড়িয়ে যাক আরও কিছু গুল্ম-বিরুৎ, এরপরই ঠিক ঠিক পেয়ে যাবে গুপ্ত ঝরনার খোঁজ—
এইবার, এই উষ্ণ জলে, ওরা সেরে নিক স্নান
হৃদ্সংক্রান্তি
আমার হৃৎপিণ্ড ঠোঁটে করে উড়ে যাচ্ছে যে পাখি, তার জন্য এই উলুধ্বনিময় সন্ধ্যা। ভাবছি, কে হবে আজ এই হৃদ্সংক্রান্তির যোগ্য পুরোহিত। ও পাখি, বলো, কোন পুরাণে তোমার বসবাস? আর কোন সর্গে তোমার স্নানদৃশ্যের ললিত শোলোক? আমি ফেটে-পড়া ডালিমের বিচ্যুত দানার মতো এই জীবন পুরোটা বন্ধক রেখে তোমাকে একফোঁটা পবিত্র জল এনে দেব।
পাতা আছে মঙ্গলঘট; এখনই বেজে উঠবে করুণ পাঞ্চজন্য। আতপ হলুদ আর শিলনোড়া নিয়ে ওই তো বসে গেছে গ্রাম্য বধূরা। বাটা হবে হরিতকী নিম সুগন্ধি চন্দন। এই মাহেন্দ্র-মুহূর্তে দূর্বা আর তিল-তুলসীভরা বরণ-কূলা নিয়ে কিভাবে দাঁড়াই—আমি তো সেই অবিমৃশ্যকারী, যে এক নিষিদ্ধ নদীর আহ্বান উপেক্ষা করতে না পেরে বেছে নিয়েছে অন্ত্যজ—অচ্ছুৎ জীবন…
তবু—হে সন্দিগ্ধ্য খেচর, সময়ের আঘাতে বিচূর্ণ খণ্ড খণ্ড আয়নায় তোমার ভবিতব্য দেখে আমি স্পষ্ট বলে দিতে পারি—আকাশের প্রশস্তি গেয়ে গেয়ে তুমি এক তপস্বিনীকে খুঁজে নেবে, যে তার বুকে ঝুলিয়ে রেখেছে একটি বিবর্ণ খাঁচা—তোমার আগমনে এক প্রান্তিক পূজারীর নগণ্য নৈবেদ্য।
এপিটাফ অথবা চুক্তিপত্র
হয়তো এভাবে একদিন অনূদিত হবে শতাব্দীর নীরবতা—মৌনতা নামে তোমাদের ভাষাবিজ্ঞানে যুক্ত হলো নতুন অধ্যায়—আমি ওই শ্যাওলা-সবুজ সমাধিতে ঘুমিয়ে গেলে তোমরা উদ্ধার কোরো তারাদের স্বরলিপি। আর আমার এপিটাফে জুড়ে দিয়ো একটি নমিত সুর—যার নিমজ্জন পাহাড়ে—নির্জনতার নিটোল নিস্তব্ধতায়।
যে জীবন পেরিয়ে এলাম, শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্য এসব বাহারি নামের একেকটি সাঁকো ছাড়া আর কিছু নয়—আর মৃত্যু এক জ্যোতির্ময় পাখি, বুকের মাঝখান থেকে টুপ করে খুটে নেয় ‘প্রাণ’—সুস্বাদু শস্যদানা।
প্রতিদিন কুয়াশার কংক্রিট ফুটো করে যে এক বিন্দু আলো আসে—ঘুরন্ত লাটিমের মতো তাকে হাতের তালুতে নাচাই। এভাবে পুরো পৃথিবীটাই নিয়ে আসি হাতে। তবু দেখো, ঈশ্বরের সাথে বন্ধুত্ব হলো না আমার—
আর তুমি, আয়নায় বিম্বিত পুরুষ—কেবলই ছায়ার মোহে জীবন আর মৃত্যুর চুক্তিনামায় রেখে গেলে অজস্র অমোঘ স্বাক্ষর—
পরিত্যক্ত হেরেম
অতল মধ্যরাতে তুমি আসো—পরিত্যক্ত সোনার হেরেমে—নিঃসুর, নিথর এই হাওয়ার অভ্যন্তরে কান পেতে কার করুণ শিঞ্জিনী শোনো রোজ!
জাদুর আয়নার পাশে দিন-দিন বেড়ে উঠছে প্রশ্নের স্তূপ—সেসব মাড়িয়ে, স্বর্ণসিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়া মূর্ছিত ঘুঙুরগুলো কুড়িয়ে নাও একটি একটি করে, ঝরা আঙুরের মতো। আর ভাবো, কে সেই ইতিহাসে নিদ্রিত রাজা, এই সুবর্ণ মহলে যিনি রোজ বসাতেন সভা—আর কে সেই স্বর্গ-সুন্দরী, মোমের ডানায় ভর করে যে নেমে আসত আগুন-উদ্যানে। কোনো জাতিস্মর পাখি অথবা পরিচিত ফুলেদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারো সেই সব অলিখিত আনন্দ-উপাখ্যান—
পরিত্যক্ত এই হেরেমজুড়ে আজ জমাট স্তব্ধতা—থেমে গেছে ঝাড়, সেই সুর, সোমস্রোত—তুমি শুধু একা বিষাদের পেয়ালায় পান করো কল্পনা-নির্মিত সুখ…
ফিরে না আসা কথার জন্য শোক
বরং রাত্রিই মোহময়, দিন অপেক্ষা—জীবনের চেয়ে যেমন মৃত্যু—আহা, যদি জানা যেতো আর কতটুকু অক্সিজেন প্রাপ্য আছে বায়ুমণ্ডলের কাছে, কখন আসবে সেই অন্তিম মুহূর্ত ফুসফুস ভরে প্রশ্বাস নেওয়ার—
আহা জিরাফ, তোমার তো বাকশক্তি নেই—কী হবে এতবড় লম্বা গলা দিয়ে—যেমন আমার; —এই এত এত কথা ঈশ্বরের সাথে—অথচ মানুষের ভাষাই বোঝেন না তিনি—বরং কোনো ভাষাবিজ্ঞানীকে পেলে আমিই জেনে নিতাম, কতগুলো বর্ণ আছে ঈশ্বররের ভাষায়—
অবিকল, আমার কথাগুলো যে আমাকে ফিরিয়ে দেয়, সে আর কেউ নয়, এই বোবা পাহাড়— এত দিন কেবল ধরিত্রীমাতার স্তন রূপেই জেনে এসেছি তাকে—অথচ সে-ই জানে ধ্বনির নির্ভুল অনুকৃতি—
হে প্রতিধ্বনি, কে তোমার মহান শব্দশিক্ষক—কোন আনন্দ-উদ্যান থেকে হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার এই তৃপ্তি এনে দাও তুমি—আমার কথাগুলো বারবার পোষমানা ফড়িঙের মতো আমার কাছেই ফিরে আসছে, আহা—
অথচ আকাশের প্রতি—সমুদ্রের প্রতি—মরুভূমির প্রতি—কতশত কথার পাঁচালি ছুঁড়ে দিলাম, এই দীর্ঘ জীবনে—তার কিছুই ফিরে এলো না!
বালিকামৌসুম
নিভৃত পদ্মপুকুর আর জলঢোঁড়া সাপের বন্ধুতা—এই ছাড়া কী থাকে সবুজ বালিকার—আমি তবু লালঠোঁট টিয়ের মতো বুকের গভীরে পুষে রাখি ভিনগ্রহপ্রেম। কেননা ঠিকানা হারিয়ে ফেলা আগুনের সরোবর খুঁজতে আসা যে যুবক বলেছিল—বেঁচে আছি একখণ্ড পোড়া কাঠের যন্ত্রণা নিয়ে—সে থাকে নেপচুন অথবা ইউরেনাসে—আর খসে পড়া আলোর চিঠিগুলো হাওয়ার পিয়নের কাছে পৌঁছে দেয় সিনীবালী রাতে—
সেই যুবকের দিকে একবার চেয়ে ফিরিয়ে নিয়েছি চোখ—আজ তাই ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে— ক্যানভাসে আঁচড় কেটে দেখি, ভুলে গেছি তার মুখ আঁকা—অথচ সেই দিন একটি বন্ধ্যা যুগ মরে গিয়েছিল—আর তার মৃতদেহ থেকে বেরিয়ে আসা লালের সংকেতে জেনেছিলাম—আমি—ভিনগ্রহচারী—রক্তজবা ফোটা আমারও রয়েছে এক আশ্চর্য মৌসুম—
তাই রোজ, নিজেকে বিম্বিত করি পদ্মপুকুরের জলে—নিজেরই নিটোল ত্বক বাহু নিতম্ব নাভি স্তনের দিকে চেয়ে মুঠো মুঠো বিস্ময় কুড়াই—মাংসের সৌষ্ঠব ছাড়া ধাতুর চিহ্নমাত্র নেই—তবু আমাকেই টানে কেন অলীক চুম্বক?
আমার কিউরিওসিটি, কল্পযানে চড়ে পৃথিবীর প্রেম নিয়ে প্লুটোর প্রেমিকের কাছে যাই—আর দেখি—আমি—অসহায় দেবযানী—প্রিয় কচের কাছে হারিয়ে যাওয়া আগুনের হ্রদ ফিরিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই কখন একখণ্ড চুম্বক হয়ে গেছি!
সময়
তোমাদের সময় এত অহং-বেষ্টনী দিয়ে আটকে রেখেছ কেন—আমি তো কেবল আমার নাম বনঘুঘুদের পালকে লিখে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম—
আর চেয়েছিলাম জেনে নিতে, একটা ছেঁড়া তারের বীণা কতটুকু স্বর-শোকে ডুবে থাকে সারাক্ষণ—এক তিরবিদ্ধ বাইসনের চেয়ে তার বেদনা কতটুকু বেশি অথবা কম—
এইভাবে আমি নিশ্চয়ই একদিন সুরের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে ভ্যান গগের নীল অথবা পিকাসোর ধূসর হয়ে যাব; অথবা রদ্যাঁর চিন্তক—চিবুকে হাত রেখে ভাবব, আমার চিন্তাবিশ্ব আর কোন মহাবিশ্বের অধীন—অহঙ্কার সেখানেও কি এতটা মহান, ঈশ্বরের মতো?
যে সময় আজ তোমাদের, তা একদিন আমারও হবে—হয়তো সেদিন আমার গোপন পকেটে পেয়ে যাবে দালির ঘড়ি—আর পাবে অজ্ঞাত পরিচয় এক বনঘুঘুর সাদা কঙ্কাল।
বাদাবন
মাটির মানুষ আমি, খাটি দিনরাত। কোদাল চালাতে গিয়ে ঘামি। জল আর কাদা মেখে হই একাকার। ক্লান্ত হই। আমার ক্লান্তিও ধরে মাটি।
এই মাটি, ঘাসের মখমল বিছিয়ে রাখে মাঠে। শহরে যে বন্ধুরা থাকে, তাদেরও বলেছি এই কথা, ‘একবার আয় আমাদের গ্রামে, সারারাত ঘাসের বিছানায় শুই, কথা কই তারাদের দিকে চেয়ে…’
আমি যার গেঁয়ো প্রেমিক, তাকে পাঠাই ফুল। নীল নীল ঘাসফুল সব। নাচের স্কুলে পড়ে সে। শহরের রঙিন মঞ্চে তার উত্তরীয় ওড়ে। তার কথা ভেবে সারা রাত জাগি—
আকাশে অসংখ্য তারা। তাদেরও তো নাম আছে, ধাম আছে, আলো আছে আলাদা আলাদা।
দক্ষিণে বাদাবন। বাঘের ডাকে ঘুম ভাঙে গভীর কোনো রাতে। বাঘটার মুখে ধরা হরিণীকে ভেবে সারা রাত কাঁদি, গোধূলির মেঘের মতো লাল হয় চোখ। কোদাল কোপাতে গিয়ে অসাবধানে ভাঙে যদি শামুকের ডিম, তখনও তো কেঁদে কেঁদে এ বুকভাসাই।
বাদাবন পেরিয়ে গেলে অথৈ সাগর। আমার বাল্য বন্ধু সুধাকর যায়। ইলিশের মরসুম এলে প্রতিবার নৌকা ভাসায়। কূল নেই। জল তার আকাশে মিলেছে, নাকি আকাশ মিশেছে ওই জলে, এত দিন সমুদ্রে গেল, সুধাকর আজও তার পায়নি জবাব। ঘাম আর চোখের জলের মতো তার স্বাদ—ও কেবল এতটুকু জানে।
আমারও ইচ্ছে করে সমুদ্রে যাবার, শুধু প্রেমিকা ছাড়ে না। কেবলই শাসনে রাখে। এখানে-সেখানে যাই, মাঠ-ঘাট চষি, আনমনে ঘুমিয়ে পড়ি ঘাসে—এসব বারণ করে। আর দেয় নিজের দিব্যি, ‘ওখানে সাপের বাস। শঙ্খিনী, চন্দ্রবোড়া, গোখরার হাঁড়ল—সবুজ ঘাগরা আর ঘুঙুরের দিব্যি দিয়ে বলি, ওখানে যাবে না কিন্তু…’
আমি শুধু হাসি। কে তারে বোঝাবে গিয়ে, এমন বেহুলা আছে যার, তার কি সর্পভয় সাজে?
রাজা
খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েন বাবা—মাথার ফেটিতে ঠিকরে পড়ে আনকোরা রাঙা রোদ্দুর—দূর থেকে মনে হয়, সোনার মুকুট পরে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি—যেন কোনো গরিব দেশের ঋণগ্রস্ত রাজা—
যতটুকু পাই আহার ও স্নেহ—তোমার কর্মিষ্ঠ হাত দিয়েই তো আসে—এই বন-উপকূলের দরিদ্র সংসারে, বাবা, আদতেই তুমি মহানুভব রাজা—
যখন শাণ দেওয়া কাস্তের গলা অথবা জীবন্ত ছুরিমাছ সহসা ঝলসে ওঠে তোমার ওই ধান কাটা আর জাল টানা হাতে—তুমি নিজেই তখন হয়ে ওঠো তোমারই প্রধান সেনাপতি—মনে হয়, কী সীমাহীন দৃঢ়তা নিয়ে শক্ত করে ধরে আছো খোলা তলোয়ার—
একদিন, খুব গোপনে তোমার পিছু পিছু যাব বনের ভেতর—অপার বিস্ময়ে দেখব, গাছ-প্রজারা তোমাকে দেখে কুর্নিশ করে কি না—আর ‘ওই তো আসছে রাজা’ এই কথা বলে সরে সরে দাঁড়ায় কি না বুনো পথ ছেড়ে—
শাহজাদি
তুই গুণীনের মেয়ে—আমার নদীর ঘাটে কেন এসে এভাবে দাঁড়াস—চুলের ফুলনাদিতে গুঁজে রাঙা রাজবলা ফুল কেন টেনে ধরিস বেতের আঁকড়ির মতো—
দক্ষিণ রায়ের নামে তোর বাপ যেভাবে চালান দেয় বাঘ দ্বীপ থেকে দ্বীপে—কোনো এক কৃষ্ণচতুর্দশীর রাতে অন্য কোনো বনে রাগের মাথায় আমাকেও চালান দেয় যদি—তুই তবে কার কথা ভেবে নিজেকে সাজাবি রোজ ছৈলার ফুলে—আমি যদি আর বৈঠা বেয়ে বেয়ে জলের ঘোড়ায় চড়ে না যাই জঙ্গলে—যে আমার শহুরে প্রেমিকা, তার কাছে কী জবাব দিবি—
ও গুণীনের মেয়ে, বনের শাহজাদি—ভালো যদি বাসিস, এই গেঁয়ো খালপাড়ে তুই আর আসিসনে যেন…