এক
বালুকণা, অপেক্ষা কর না ভাই—খানিক। শ্বাসমূলের শিকড় ছুঁয়ে বেলা একটু গড়ালেই ভাটিতে ফিরে যাবে নোনাজল, তখন রুপার জেওর পরা ঝিনুক খুলবে তার কপাট। এ উপদ্বীপে জনবসতি নেই তেমন, তবে পড়ে আছে—স্প্যানিশ খালাসিদের কাঁধে চড়ে চলে আসা একটি বয়োবৃদ্ধ কামান, তাকে জড়িয়ে ফণা তুলছে অপরাজিতা। হাতে সময় প্রচুর, নিরিবিলিতে খুঁজে চলি—জীবাষ্ম হতে চলা তিমি মাছের হাড়। তা কেটে-কুঁদে-বাঁকিয়ে…ঘঁষেমেজে তৈরি করতে চাই অদ্ভুত এক ইকোলিলি। ধ্বনিতে তোমার আগ্রহ নেই…বালুকণা, তা নাই বা থাকলো। ভাটা পড়তে দেরি আছে। জেটিতে ঊর্মিনন্দন হয়ে ভেসে থাকা সেইলবোটখানা তো ভারি সুন্দর। সারেং…খালসি…কিছু নেই, নাই বা থাকলো, ভাসছে তো দিব্যি, ঘুরে আসি, অপেক্ষা করো একটু। তালশ্বাসের মতো ঝিনুকের নরোম অন্তস্থলে প্রস্তুত হচ্ছে তোমার জন্য কবোষ্ণ এক কনডেম সেল।
দুই
ভরদুপুরে নৌকার নিশি পেলো কী? দেখছো…সেইলবোটখানা কী রকম সম্মোহিত হয়ে ভেসে যাচ্ছে। হালে কেউ নেই, পাল খাটানোরও প্রয়োজন পড়ছে না। মনে হয়, পেরিয়ে দীপাবলি তিমির সংক্রান্তি, এসেছে কিসতি ভাসানোর মাঝিমাল্লাহীন মৌসুম। এদিকে আকূল পাথার বলে কিছু নেই, নোনাজলের অগভীর প্রণালী, বালুকণা, গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাও তো দেখি পেছনে, ডলফিনটি সাঁতারের চিরুনিতে কেটে দিচ্ছে জলের সিঁথি। ভাসি না হয় আরও কিছুক্ষণ। জল আর শৈবালের সমাহারে তো আমাদের সংসার, তুমি না তাতে জুড়ে দিলে সামান্য ঊর্মি। অনুরোধ একটিই—পারো তো তারামাছ হও, নক্ষত্র হয়ে ভেসে যাও সমুদ্রজলের নীলাভ ছায়াপথে।
তিন
ডিফ্টউডে ঠেকা খেয়ে থেমে পড়লো যে সাধের কিসতি। না হয় নেমে পড়ি, দাঁড়াই হাঁটুজলে। স্রোত নেই তেমন। ডলফিনটি ভাসছে কেমন যেন স্থীর হয়ে, মনে হয়, বিস্মৃতিতে বিভ্রান্ত মৎস্যকুমার সাঁতার-ফাতার ভুলে তাকিয়ে আছে জলতলে। ওখানে নুড়িবালুকায় মিলেমিশে সেঁদিয়ে আছে বার্বি-ডল এক। তার চোখের চুমকি থেকে ছাড়াচ্ছে জাফরানি আলো। তাতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুশুক সন্তানটি দিনদুনিয়া ভুলে গেরো কি? একদিন না হয় এরকম তামাম রাজ্যপাট, ওপাড়ে পৌঁছানোর খেয়াঘাট, তাবৎ কিছু ভুলে টুলে স্রেফ ভেসে থাকলাম খোয়াব জলে? বদলে গেলো ঋতু, হাঁটি হাঁটি করে হেমন্ত পা দিলো কুয়াশা নিবিড় শীতে, সূর্য চলে এলো কর্কটরাশিতে, আর আমার দেহমন রূপান্তরিত হলো গলুয়ে চোখ আঁকা নায়ের দৃশ্যপটে, আর বালুকণা…তুমি পড়ে থাকলে সমুদ্রতটে।
চার
সৈকতের প্রান্তিকে—পার্কে এসে আধচেনা নারীর অপেক্ষায় বিব্রত হওয়া পুরুষের মতো…সবুজের বিত্তে ভরপুর বৃক্ষটি বড় খিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিন্ন তাতে…ছড়াচ্ছে বৈভব, শিংগাল হরিণের করোটির মতো ডালপালায় বিস্তৃত স্টেগহর্ন ফার্ন। না হয় দাঁড়ালাম এখানে একটু। বালুকায় গুলতানি পাঁকানো হাঁসগুলো কথা বলছে, না হয় শুনলাম মনযোগ দিয়ে তাদের আলাপ। জমছে তো এ মুহূর্তে চতুরদিকে কার্বন ইমিশনের সন্তাপ, কী পরামর্শ করছে এরা, সংকট দুর্বিষহ হলে উড়ে যাবে কি ভিন্ন গ্রহে, না কি ভাঙা হৃদয়ের মতো আইসবার্গের ফাটলের ওপর ওড়াউড়ি করবে…ছড়াবে নিবিড় হাহাকার? এই যে আঁকড়ে ধরে আছি, এ মোহমায়া…খনিজছোঁয়া জল…তেজষ্ক্রিয় অন্ধকার, বলো তুমি…বালুকণা, কবে করবো সংসারসুমুদ্র পরিহার?
পাঁচ
নোনাজলের জনমনুষহীন পাথারে কারা যেন পেতে রেখেছে সেতু বা বোর্ডওয়াকের মতো কাঠের শিলপাট। না হয় হেঁটে যাই একটু। তিন কাল হারানো বেঁকেচুরে দ হওয়া বৃক্ষটির দিকে তাকাও, মেয়াদ শেষে খালাস পাওয়া আততায়ীর মতো দাঁড়িয়ে আছে যেন জেল রোডের চৌমুহনীতে। একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, একটু না হয় ভাবো, কবে শেষ হবে তোমার মেয়াদ, দেখেছ কী রকম বৃত্ত সৃষ্টি করছে ঘাই, তা মিলিয়ে গেলে বেরুতে পারবে হে…বাজাতে পারবে অবরুদ্ধ সানাই।
ছয়
যে ট্রেইল ধরে হাঁটছ, তা কিন্তু তৈরি করোনি তুমি। যে ঝোপ-জঙ্গল স্তব্ধ হয়ে আছে, তার নীরবতায় ধৃত আদিবাসীদের নিবিড় পদশব্দ, নিভিয়ে মশালের নিশিরঙিন শিখা, এ পথ ধরে যেতে যেতে চিরোকী সম্প্রদায়ের চিরসবুজ মানুষেরা একদিন নিরিখ করেছিল নিহারিকা। এসব নিয়ে ভাবিত হওয়ার তেমন কিছু নেই, শ্বাসমূলের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে থাকাও অবান্তর, বরং পড়ে থাকা পাথর ডিঙিয়ে না হয় উঠে পড়ো সেতুতে। দ্যাখো…হিরণ পাখিটি জলের আরশিতে তাকিয়ে খিলাল করে নিচ্ছে তার নীলাভ পালক, তার এ সাজগোজ…গোছগাছ কার জন্য? প্রতিবিম্বে ফুটেছে ঝুমকোপাশার মতো অর্কিড এক, দেখোনি তো আগে, এ প্রজাতি বিরল…নাকি বন্য? অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে চেয়েছ সৈকতের শঙ্খদ্বারে, সেতু ছিল কিন্তু তারপরও পৌঁছতে পারোনি অন্যপারে।
সাত
না হয় নাই-বা পৌঁছলে ওপারে, দাঁড়িয়ে থাকলে দিবস-নিশি, বদলে গেলো পঞ্জিকা, নভোযান ভিড়লো দূর গ্রহে, দাঁড়িয়ে থাকলে তুমিও…বালুকণা…মেঘবনানীর বৃক্ষদ্বারে। ফার্নের পত্রালি ধামসে পড়ে থাকা তরুবরটি হতে পারে ঔক কিংবা সিডার। প্রকৃতির নামাবলি নিয়ে ভেবো না অত, পরিহার করে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, কাছে যাও, নিরিখ করে দ্যাখো…চাইলে কিন্তু কেঁটে-কুঁদে বের করতে পারো সমুদ্রজলে কত্থকের মুদ্রা ফোটানো জলঘোড়ার আকৃতি, কথা বলে না বটে,তবে আছে তাদের প্রেম ও প্রীতি, আছে কিন্তু মুগ্ধতা ওদের সমুদ্রযাপনে। বৃক্ষের স্নায়ু ও পেশীতে নির্মাণ করতে পারো—চীনা নিসর্গচিত্রে তুষারের তবক দেওয়া পাহাড়, তলায় ছোট্টমোট্ট কুড়েঘর। জানো কি ডালে চাক বেঁধে স্বপ্ন দেখতো নিযুত ভ্রমর? ফার্নের তলায় পাথরের বর্ণের সাথে মিশ খেয়ে আছে যে লতাবিভ্রম, সেও দক্ষ হয়েছে আত্মগোপনে, চাইলে জানতে পারো তার অভিলাস, ক্লোরোফিলবাহিত ধমনীতে দানা বেঁধেছ কিসের সন্ত্রাস?
আট
বালুচরের ছিটকে আসা তরঙ্গে না হয় দুলুক তোমার নাও, খালি পায়ে হাঁটো…একটু থামো। ধূসরে রূপালি ঝিলিক পাড়া পেল্লায় পাথরটির দিকে ফিরে তাকাও। সবুজে সফেদ ডোরাকাটা গিরগিটির পদরেখায় আঁকা হচ্ছে ধুমকেতুর পথপরিক্রমা। প্রকাশ পেয়েছে দেবদারু দুপুরের প্রচ্ছন্ন আকাশ। কাছে এসেছে উপলব্দি কিন্তু শেষ হয়নি অনুধাবনের সীমা। মনে আছে, ঘুঘুর অন্যমনস্ক গাঢ় স্বরবিভঙ্গে একবার খুঁজে পেয়েছিলে লাবন্যের আর্দ্রতায় সিক্ত তূলোট, যাতে চারকোলে আঁকা ছিল বঙ্কিম রেখা। ডুমুরের ঝুপসি আন্ধারে সুইচোরা পাখিটি বেঁধেছিল নীড়, তারপর থেকে পথের ভেতর দিয়ে পথ করে চলেছো একা, কখনো ইমনের অবরোহী ধরে ডিঙ্গিয়ে একাধির স্বর…পারোনি বুঝতে কখন তৈরি হয়েছে বিমুগ্ধ মীড়।