মুহূর্ত কাল
প্রতিটি মুহূর্ত খণ্ড খণ্ড।
দীর্ঘ একটি জীবনে আমরা হেঁটে যাই
এইসব ভগ্ন মুহূর্তের ভেতর দিয়ে…
আর প্রতিটি মুহূর্ত
কার্যত অদৃশ্য হয় পরবর্তী মুহূর্তে—
বস্তুত জীবন একটি ভঙ্গুর বৃত্তের মতো,
যার শুরু এবং শেষ
সুনির্দিষ্ট কোন বিন্দুতে স্থির থাকে না।
মধ্যবর্তী
কনিষ্ঠ আঙুল ধরে হেটে যাচ্ছি,
পথের আড়ালে পড়ে আছে দীর্ঘপথ
জন্মান্ধ সময় আর ধুসর রোদ্দুর।
মধ্যবর্তী একটি প্রাচীন স্রোত
প্রবাহিত হচ্ছে শীর্ণ সমতটে,
তার ছড়ানো পাপড়ি থেকে
খসে যাচ্ছে ঋতুমতী নদী…
কনিষ্ঠ আঙুল ধরে হেটে যাচ্ছি,
পিছনে গড়িয়ে যাচ্ছে ঘুমঘর
মায়া-মগ্ন সাপ আর নিদ্রিত দুপুর ।
কনিষ্ঠ আঙুল ধরে হেটে যেতে যেতে
প্রলম্বিত একটি ক্রন্দন
নুয়ে পড়েছে দীর্ঘশ্বাসের পাশে,
আর অকস্মাৎ আমি ঘুমিয়ে পড়েছি
ছড়ানো একটি দীঘির ভেতর ।
ক্ষরণ
সংখ্যাতত্ত্বের ভেতর দিয়ে ফিরে যাচ্ছি
চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে স্বর।
কয়েকটি চিত্রল হরিণ
শালবনের ভেতর দিয়ে উড়ে গেলে
স্মৃতির আগল খুলে উপচে পড়ে জল ।
বিষণ্ণতা একটি মায়াবী ভ্রমের নাম…
ভ্রমণের দীর্ঘপথ অতিক্রমণের
পর অনুচ্চ নদীর পাশে শব্দহীন
পড়ে থাকে আতপের গন্ধ মাখা মুখ
অনুক্ত কাল
ছায়া ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে জল,
একটি নোয়ানো বিকেল
স্খলিত স্বপ্নের ভেতর শুয়ে আছে।
সম্মুখে নিবিড় সন্ধ্যা,
ঘুলঘুলিতে সাজানো সংসার।
বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছি—
শীতকালে কোনদিকে যায় ট্রেন…
গাঢ় কুয়াশার ঠোঁটে
দুধ-গন্ধ স্মৃতি রেখে
ফিরে যাচ্ছে বয়ঃসন্ধি কাল।
দাহন
অগ্রহায়ণের প্রতিটি রঙকে
চুমু খেতে ইচ্ছে করে।
দ্বিধাগ্রস্ত একটি যুদ্ধজাহাজ আমাকে
. চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে…
ছাপার প্রতিটি অক্ষর মারণাস্ত্র জেনে
গ্রন্থের ভেতর থেকে জেগে উঠেছে সময়।
ধ্বংসের পিছনে তীব্র কান্না জমে থাকে।
আমরা আনন্দকে ঘোর দিয়ে
কান্নাকে করতলে তুলে নেই-
কান্না শূন্যতার ওপাশে ভেঙে পড়লে
শিরার ভেতর মৃত্যুকে ডেকে আনি।
মৃত্যুর নির্মোহ লাল ঘোড়া
আমাদের কাছে ফিরে আসলে
আমরা অগ্নি-গন্ধি নদীর ভেতর লুকিয়ে থাকি।
ভুবন চিল
অজানা বছরগুলো থেকে উড়ে আসে অসংখ্য ভুবন চিল,
আর আমি ঘুমগ্রস্ত নদীর ভেতর ডুবে যাই।
কেউ একজন আমাকে টেনে তুলে
দাঁড় করিয়ে দিয়েছে হাতখোলা জানালার পাশে…
আমার ডান স্কন্ধ থেকে
বেদনারা ফিরে যাচ্ছে বাম স্কন্ধের দিকে।
একটি সন্দেহের তীর আমাকে আঘাত করতেই
. জল-মগ্নতা ফিরিয়ে দিল তাকে।
এইসব আঘাতগুলো পুতুলের মতো নরম আর শ্রেণীচ্যুত,
আমি কাউকে আঘাত করিনি
তবুও ভুবন চিলের ডানা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো।
দ্বিধা
হাত বাড়াতেই সন্ধ্যা এসে ছুঁয়ে দেয় হাতের আঙুল।
এইসব মুগ্ধ করা অন্ধ বায়ুচলাচল
ক্রমাগত দোদুল্যমান…অদৃশ্য হচ্ছে হাতের ভেতর।
কে তোমাকে স্পর্শ করে ফিরে যাচ্ছে দূরে…
অন্ধকারে কোথাও কি খেলা করে পড়ন্ত বিকেল!
হাত বাড়ালেই পথের আড়ালে ছায়া নামে পথে
সন্তর্পণে ডুবে থাকে বাণবিদ্ধ সন্ধ্যার শরীর।
স্মৃতি পথে
সন্ধ্যা হলে নিচে নেমে যাই,
যতটুকু নামি তারচেয়ে অধিক স্মৃতি
হাত ফসকে গলে যায়
ভঙ্গুর নিদ্রার পথে।
প্রতিদিন হাওয়া বয়,
প্রতিদিন হাওয়া বইতে থাকে—
জলবিদ্ধ কালো পাথরের খাঁজ থেকে
দ্বিধাগ্রস্ত জোনাকিরা
উঠে আসে পৌষের বৃষ্টির শেষে ।
কে তাকে তাড়িত করে নিয়ে যায়
লবণ নদীর দিকে!
অনেকটা পথ পেরোনোর পর
কয়েকটি শাদা কাক খেলা করে
সফেদ দড়ির ওপর,
আর কান্নার মতো বিষণ্ণ একটি বাদুর
ফিরে যায় অনুচ্চারিত রাত্রির গানে।
বোধ
নীরবতা থেকে চাপা ক্রোধ উঠে আসে
আমি দূর গাঁয়ে ফেলে এসেছি মাস্তুল—
প্রতিটি দৃশ্যই বহুধা বিভক্ত হয়ে
. ছড়িয়ে পড়েছে দৃশ্যে…
হাওয়া-কল থেকে ফিরে যাচ্ছে পাখি ।
ভ্রমণ
ঘাসের ওপর উঠে এসেছে রোদ্দুর,
একটি স্নানঘর উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।
তুমি কয়েকটি দুপুর খুলে নিলে—
আমি একটি সাদা বাড়ির ভেতর ঢুকে যাই।
চোখের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ভ্রম ।
একটা দমকা হাওয়ার সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম।
অন্ধ গলির ভেতর লুকিয়ে পড়েছে পথ।
পথে যেতে যেতে কি এক অদ্ভুত মানুষের সাথে দেখা!
হাতের তালুতে তিনি নদী ও পাহাড় এঁকেছেন।
পাহাড়ের গন্ধ নিয়ে আমি নদীর গভীরে ডুবে যাই।
কার কথা মনে আসে!
কে আমাকে নিয়ে যায় সন্ধ্যা-মালতীর ঘরে।
ওগো চাঁদ তুমি কেন ডুবে আছো অন্ধ এক শবরের দেহে!