সার্জন
অপারেশনের আগে দু’পেগ ভদকা
ওটির টেবিলে তখন ঝাপসা মানুষের জীবন তীব্র-আলোর নিচে
অলিন্দ-নিলয় ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়ে বসে আছে,
কাঁপছিল ঈশ্বরের হাত।
লোকটির ছিল সুন্দরী স্ত্রী আর ষোলো বছরের অটিস্টিক শিশু
যার মুখে অ্যাডোনিসের পবিত্র হাসি
এবং যা পরে মেঘ হয়ে ঢেকে দেয় সার্জনের প্রস্ফুটিত উজ্জ্বল উঠোন।
ছেলেটিকে পিতৃস্নেহ আর ছেলের সুন্দরী মাকে…
ঈশ্বরের হাত ধরেছিল সে-ও, একবার ওটির টেবিলে,
পরেরবার শোবার ঘরে, চুমু খেয়ে টেনেছিল নিজের গভীরে…
শেষমেশ ঘরেই ফেরেন তিনি, অভিজ্ঞ সার্জন।
দামি ঘড়ি, কিছু কড়কড়ে নোট, হাস্যোজ্জ্বল পুষ্প,
স্ত্রী-সন্তানের প্লেট থেকে চুরি করা কিছুটা সময়…
অনড় মৃতের ছায়া তবু সার্জনের প্রশস্ত উঠোনে।
পুত্রই প্রথম, এরপর বয়োসন্ধির লাজুক ফুল, তার প্রিয় কন্যা,
এরপর সার্জনের নিজস্ব ভেনাস…একুশ শতকে এ-কোন অসুখ,
ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে মিইয়ে যাচ্ছে বিছানায় উচ্ছ্বল জীবন!
ব্যর্থ মেডিক্যাল বোর্ড, চিকিৎসা বিজ্ঞান!
না, এ কিছুতেই হতে পারে না, কিছুতে নয়।
দেবশিশু হেসে বলে, সবচেয়ে উপযুক্ত ন্যায়বিচার এটিই হতে পারে
ভয় নেই, ঈশ্বর হত্যাকারী হলেও তার মৃত্যু নেই…
এইসব আধিভৌতিক জাদুবাস্তবতার জাল ঘচাঘচ কেটে ফেলেন সার্জন
সহস্রাব্দের ধারালো ছুরি দিয়ে…
ওটির টেবিলে ধর্মঘট করা অলিন্দ-নিলয়
বারবার জেগে ওঠে নিদ্রার ভেতর
মৃত লোকটির ছায়া উঠোনের পত্রপুষ্প ছেড়ে ঢুকে পড়ে বেডরুমে
ঢেকে দেয় কুড়ি বছরের সংসার।
অপারেশনের আগে মাত্র দু’পেগ ভদকা।
জলের মলিকুল বোঝে মানুষের ভালোবাসা
জলের সরল মলিকুল বোঝে মানুষের ভালোবাসা
টেলিফোনে বলছিলেন বিজ্ঞানী ধনঞ্জয় সাহা
যখন সাগ্রহে আমি তাকে আদিবাসী মানুষের বৃক্ষ নিধনের সেই পুরনো গল্পটি বলি।
ওরা বাগানের আগাছা, কাটাগুল্মের মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে অভিশাপের খিস্তি বর্ষণ করতো রোজ সন্ধ্যেবেলা
কাটাগুল্ম, আগাছা ও বিষবৃক্ষেরা সকালে নুয়ে পড়তো লজ্জায়
এবং ক্রমশ অভিশাপের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত, মিইয়ে যেত মাঠের ধুলোয়।
একটুও অবাক না হয়ে বলেন ডক্টর সাহা
এ-তো প্রমাণিত সত্য
জাপানের বিজ্ঞানী মাসেরু ইমোতো প্রমাণ করে দিয়েছেন
মানুষের ঘৃণায় কি করে মরে যায় জলের জীবন।
কর্ণগহ্বরে আমি সেলফোনটিকে শক্ত করে চেপে ধরি।
মাথার ওপর নাশপাতি গাছ তখন অশ্রুর মতো দুটি পাতা ঝরায় কী এক গভীর বিষাদে।
দু’বোতল সুস্থ জল-স্ফটিকের ছবি তোলে বিজ্ঞানী মাসেরু,
. হাস্যোজ্জ্বল অগণিত পুস্প।
একটির গায়ে লিখে রাখে ভালোবাসি আর অন্যটিতে ঘৃণা।
রোজ এসে অতিথিরা শব্দ করে পড়ে সেই লেখা,
মাসেরু নিজেও দিনে বেশ ক’বার বোতল দুটিকে সজোরে নিবেদন করে প্রেম ও কঠিন ঘৃণা।
দু’সপ্তাহ পরে বোতলের ঘৃণা-বর্ষিত জল-ক্রিস্টালে
ফুটে থাকা ফুলগুলো যায় ঝরে।
একই ঘটনা দুটি পুকুরেও ঘটে
পচা পুকুরের জল মানুষের ভালোবাসায় উঠেছে জেগে
অথচ কী কাণ্ড দেখো
জীবন্ত পুকুর বুক ভরা জল নিয়ে মরে যায় ঘৃণা আর অভিশাপে!
কিছুক্ষণ আগে বেশ কঠিন গলায় গৃহস্বামীকে বলেন ফরহাদ ভাই,
যিনি মাত্রই উঠে এলেন করোনার করুণ বিছানা থেকে,
কেটে ফেলুন তো এই বুড়ো নাশপাতি, আর ফল দেবে না এ-গাছ।
আমি গাছটির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই,
মা কী করে বুড়ো হয়!
বৃক্ষকাণ্ডে রাখি ভালোবাসার উষ্ণ করতল এবং জপমন্ত্রধ্বনির মতো শতবার বলি,
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি…
নেকড়ে
প্রথম যেদিন গ্রামে নেকড়ে এসেছে
সেদিন আকাশে ছিল রক্তচাঁদ
চাঁদের ভেতর থেকে একদিন যে বালিকা এসেছিল নেমে, ছড়িয়েছে রূপের আগুন সারা গ্রামে;
শুধু তাকে নিয়ে গেল দুর্ধর্ষ নেকড়ে
আর মাংসের বাগানে কিছু নোখ গোপনে রোপন করে গেলো।
এখন নেকড়ে আসে প্রতিদিন
না, কোনো পাহাড় থেকে নয়, গ্রামের কোনো না কোনো
ঘর থেকে বুভুক্ষু নেকড়ে আসে রাতের আঁধারে
. মানুষের মুখোশ পরে,
কেড়ে নেয় প্রাণ, বেছে বেছে…
সন্দেহ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত
লোক-শ্রুত চোখের আকাশে আলোছায়া কানামাছি খেলে
. প্রতিটি পূর্ণিমা রাতে।
হতাশাবাদীদের অগ্নিবর্ষণ
ওরা ভোগবাদীদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে বলে
ত্যাগেই আনন্দ শুধু
আসলে ভোগে এবং ত্যাগে দুটোতেই আনন্দ।
মানবদেহ যা গ্রহণ করে আর যা বর্জন করে
এর প্রতিটি ক্রিয়াতেই কি সে আনন্দ অনুভব করে না?
শুধু রাজা আর গোপাল ভাঁড়ের গল্পই ওরা বলে।
ওদের পাত্র অপূর্ণ বলে সুস্বাদু আহারের গল্পে রেগে যায়
এবং খাবারের ছবি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়,
মুখে বলে, আহা কত মানুষ খেতে পায় না;
অথচ নিজের প্লেট থেকে খাদ্যকনা তুলে
ওরা কখনো অন্যের মুখে দেয় না।
নিজের গ্লাসের অর্ধেক জলকে ওরা
চিরকাল খালি গ্লাস বলে বলে আহাজারি করে।
এই আহাজারিই ওদের প্রধান বিনোদন…
ওদের আহাজারির আগুনে তোমার পত্রপুষ্প পুড়িও না,
বিকশিত হও নিজের বিবেচনায়
এবং ওদের আহাজারির আগুন
হাঁসের গা থেকে গড়িয়ে পড়া কাদার মতো ঝেড়ে ফেল
এবং সকালের উজ্জ্বল রোদে গিয়ে দাঁড়াও।
তোমার শুভ্র সৌন্দর্যে ওদের চোখ ঝলসে যাবে
এবং ওরা আরও অধিক অগ্নি বর্ষণের প্রস্তুতি নেবে
তোমাকেও আরও অধিক দক্ষতায়
তা গা থেকে ঝেড়ে ফেলবার জন্য তৈরি হতে হবে।