কাঁটা তারের বেড়া
মিতা দি–
আসছে পুজোতে তোমার ওখানে বেড়াতে আসবো
সঙ্গে আনবো পদ্মার ইলিশ আর টাঙ্গাইলের চমচম
জামাইবাবুর জন্য কুমিল্লার খাদি ধূতি-পাঞ্জাবি।
তোমার অভিমানি ভাইটির জন্য—
‘নির্মল বাতাস, মেঘনার জল, একমুঠো মাটি।’
বড় ভালোবাসে এই বাংলাকে।
দিদি,
আমি আরও আগেই আসতাম
কী জানি! কী সব আবশ্যকীয় কাগজ লাগে
না হয় ফেলানির মতো
আঁটকে যাবো কাঁটা তারের বেড়ায়;
পরদিন ছবি ছাপা হবে খবরের পাতায়।
দিদি,
দু’জনে একই স্বপ্নের পেছনে ছুটি
একই ভাষায় কথা বলি
কুয়াশার জলে স্নান করি
জোছনার আলোতে ডুবে থাকি
প্রিয় গঙ্গাকে মা বলি
তারপরও স্বপ্নে বোনা ধান পুড়ে খরায়
পথরুদ্ধ করা হয় কাঁটা তারের বেড়ায়।
দিদি,
তুমি আর আমি ভিন্ন কেউ নই
তুমি নদীর জল হলে আমি হই ঢেউ
তুমি মেঘ হলে আমি হই বৃষ্টি
তুমি ঝড় হলে আমি হই সৃষ্টি
তুমি নৌকা হলে আমি হই মাঝি।
দিদি,
তুমিই বলো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জয়নুল
কার না প্রিয়!
কার কথা লেখা হয়নি পাঠ্যপুস্তকে?
তবে কেন এ দেয়াল মায়ের বুকে!
দিদি,
তোমার ভাইকে বলো,
‘এক ঘটি গঙ্গার জল তুলে রাখতে’
অভিমানী মানুষটির জন্য মন বড়ই চঞ্চল
কখন যে লুকিয়ে পরে।
তবে বলো তাকে-
৪৯ বছর আগের ক্ষতটা মনে ভীষণ দাগ কাটে।
পূজারিনী
বাবা-মা পছন্দ করে নাম রেখেছে পূজারিনী
যদিও কন্যা সন্তান তবু ছিলাম আদরিনী
বাবা স্বপ্ন দেখতেন—
আদরের কন্যাকে স্কুলে পাঠাবেন
শখ করে বাজার থেকে আনলেন
নতুন ব্যাগ, জুতোজোড়া আরও কত কী!
কন্যাকে নিয়ে স্বপ্নের উচ্চতা আকাশ ছোঁয়া
বাবা বলতেন, ‘বড় হয়ে চিত্রশিল্পী হবি।’
যখন যেথায় যেতেন ফেরার সময়
নানান রঙের পেন্সিল এনে হাতে দিয়ে বলতেন-
‘এখন থেকেই তোর হোক না হাতেখড়ি।’
মা তুমিই বলো—
এই রংপেন্সিলে কার ছবি আঁকবো?
মানুষ নামে পশুর ছবি!
নাকি লাল রক্তে সবুজের বুকে মানচিত্র।
মা সবাই বলে, পুজারিনী ধর্ষিতা
হোক্ না পুতুল খেলার বয়স, তবু তো নারী
সম্ভ্রম হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে
বুঝেছি, নারী হলো, জড়বস্তু, একদলা মাংসপিণ্ড
ইচ্ছে মতো দলিত-মথিত করো।
নারী বরাবরই বাকহীন।
মা আমি শিখে গেছি—
কী করে লড়াই করে বাঁচতে হয়
কী করে স্বপ্নের কবর রচনা করতে হয়।
জানো মা,
সেদিন ওরা ব্লেড দিয়ে কী জানি কী করলো
পরনে ধবধবে সাদা ফ্রকটা মুহূর্তেই লাল হয়ে
রক্ত জবার মতো ভয়ঙ্কর সুন্দর ফুল ফুটলো।
জানো মা,
ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম, পরে কী হলো জানি না।
আমার জ্ঞানশূন্য দেহ কতটা ক্ষুধা নিবারণ করলো
নরপশুরা কতটা তৃপ্তি পেলো
সে কথা জানতে পারিনি, চেতনার পর দেখি
তোমার চোখে জল আর বাবা অদূরে দাঁড়িয়ে
বাবা হয়তো ভাবছেন-
ঝড়ের তাণ্ডবলীলা কতটা ভযাবহ ছিল
আর যন্ত্রণাটা কতটা নারকীয় ছিল
তিনিও তো পুরুষ;
কেন হলো? কিভাবে হলো আর কে করলো?
প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলাতে পারছে না সকলে
তুমিই বলো-
এসব প্রশ্নের উত্তর কী আর আমার জানা!
কেউ কেউ বলছে পুজা হিন্দু মেয়ে, হয়তো তাই!
সত্যিই আমি সাম্প্রদায়িকতার শিকার না নারীত্বের
আসছে মাসে আমার মেয়ে পুতুল মাধবীর বিয়ে
বর আসবে তো!
আমি যে পুতুলের ধর্ষিতা মা; যদি বর না আসে
মাধবীর কী হবে!
রিমঝিম কি আসবে; না আমায় ঘৃণা করবে!
বাবাকে বলো, একটা নতুন ব্লেড আনতে
সাথে রাখবো।
সবিতা,কবিতা, নমিতা, মাধবীলতা সবাইকে বলবো
সবাইকে শিখিয়ে দেবো কী করে বদলা নিতে হয়
‘রক্তের দাগ মুছে নিতে হয় রক্ত ঝরিয়ে আর
নিজেকে বাঁচাতে তন্ত্রের প্রাচীর টপকাতে হয়’।
হৃদয় ভেঙো না তুমি
প্রিয় সব কবিতা উৎসর্গ করে
স্বত্ব তোমার নামে দিয়ে
মিটিয়ে গেলাম কবিতার দেনমোহর
একটাই আরজি, হৃদয় ভেঙো না তুমি।
জীবন অতি সামান্য,
সেও তোমার জন্য রেখে গেলাম
মিটিয়ে দিয়ে অনাবশ্যকীয় চুক্তি
কেবল মিনতি, হৃদয় ভেঙো না তুমি।
তোমার জন্য পাড়ি দিতে পারি
উথাল-পাতাল নদী
চাও তো দিতে পারি সময়ের দাম
একটাই আরজি, হৃদয় ভেঙো না তুমি।
স্বর্গের ঠিকানা অনায়াসে দিতে পারি
দিতে পারি বিশ্বাসের ছাড়পত্র আমার
শুধু পারি না কথা দিতে
এ জীবনে তোমাকে ভুলে থাকবার।