পালাবার পথ নাই, স্থানও নেই
কোথায় পালাবো আমি?
শোষণের টাকায় গড়ে ওঠা
ঝলমলে শহর থেকে
প্রতারিত সেই গ্রামে?
নাই-নাই গ্রাম থেকে সবই-আছে শহরে?
পিছিয়ে পড়া এশিয়া থেকে
অগ্রসর ইউরোপে?
অথবা
রবীন্দ্রনাথের পদ্মাতীর ছেড়ে
পাবলো নেরুদার মাপোচোর পাড়ে?
পদ্মাসেতুর পিলারে হেলান দিয়ে
যদি নিবেদন করি,
‘পদ্মার ঢেউরে…
মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা যা রে…’
সে কি আমাকে নিয়ে যাবে কোথাও
যেখানে নেই শত্রুর অদৃশ্য পদচারণা?
কোথাও পালানো যাবে না,
এমনকি রোড খুলে দিলেও নয়,
কিংবা চালু করে দিলেও
পৃথিবীর সমস্ত এয়ারলাইন্স;
সবখানেই অস্ত্রহাতে শত্রু।
সবখানেই শত্রুর সক্রিয় চোখ।
কিন্তু আমি কতদিনই-বা থাকবো লুকিয়ে
ছেড়েছুড়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব
অথবা যাদের প্রতি—
পেশাগত দায় ও দায়িত্ব আছে আমার,
তাদের থেকে পালিয়ে?
এর নাম কি বেঁচে থাকা?
তো যতই পিছু হটি, দেয়ালে পিঠ ঠেকবেই
আজ নাহয় কাল।
আমরা যাকে ছাড়তে চাই,
সে আমাদের ছাড়বে না!
আজ একটাই বাস্তবতা—
যুদ্ধ! যুদ্ধ! যুদ্ধ!
যুদ্ধ মুখোমুখি! যুদ্ধ বহুমুখি।
কিন্তু সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে—
শত্রুর গেরিলা আক্রমণ থেকে বাঁচতে,
কাশিয়াডাঙ্গার মোড়ে—
ভাতের হাঁড়ির মতো
মুদির দোকান,
রহিম চাচা কতদিন বন্ধ রাখবে সেটি?
মহাদেব পুরের জয়নব আপা
কতদিন বন্ধ রাখবে
অন্ধের যষ্ঠিতুল্য
তার জয়নব রাইস মিল?
অথবা, শুধু নিজেরা বাঁচতে—
আত্মার আত্মীয়ের মতো গরিব শ্রমিকদের
অভুক্ত রেখে
সবনম-সবুজ
কতদিন তালা ঝুলিয়ে রাখবে
জাগরণ সমবায় সমিতির দরোজায়?
এত প্রশ্নের নগদ জবাব নেই
কারণ এটা একটা যুদ্ধ
যুদ্ধে এবং প্রেমে অনেককিছুই এসে যায়
যেসবের যৌক্তিকতা
গতানুগতিক স্বাভাবিকতার দর্শনে
মেলে না। আজও মিলবে না।
অতএব, অনিবার্য যুদ্ধ;
যুদ্ধই একমাত্র পথ,
লড়াই-ই একমাত্র ফয়সালা।
আর কে না জানে—
যুদ্ধ মানেই অনিবার্য কিছু প্রাণহানি,
যুদ্ধ মানেই মহত কিছু আত্মত্যাগ,
যুদ্ধ মানেই অপরিহার্য আরও কিছু ক্ষয়ক্ষতি!
যুদ্ধ চায়—সৈনিকের সাহস
যুদ্ধ চায়—ক্যাপ্টেনের বিচক্ষণতা
যুদ্ধ চায়—সম্মিলিত প্রতিরোধ
কোথাও প্রকাশ্, কোথাও গোপন;
সেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে—
গ্রামে-গঞ্জে
হাটে-মাঠে
শহরে-বন্দরে
আসলে এও আরেক গণযুদ্ধ;
ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি যেমন অপরিহার্য,
তেমনি সুনিশ্চিত—বিজয় আমাদের!
করোনার আরশিতে
মড়ক এসেছে দেশে, এসেছে সে
সারা দুনিয়ায়; সে নতুন;
পরনে তার অদ্ভুত পোশাক
চোখেই পড়ে না তাকে
চশমা-আঁটা চোখেও অদৃশ্য,,
এমনকী ডিএসএলআর ক্লোজ-আপও ফেল!
তবু আমরা দেখছি তাকে দিনে এবং রাতে;
তবু আমরা দেখছি তাকে—
জিনভূত দেখে আসা দৃষ্টির অভ্যাসে;
আমরা দেখছি তাকে
অপরের চোখ দিয়ে এখানে ওখানে;
আমরা দেখছি তাকে—
আমাদেরই বন্ধ এই দরোজার ও’পাশে;
আমরা দেখছি তাকে
ছিটকানি এঁটে রাখা পড়শির ভেতর দুয়ারে;
খালিচোখে দেয় না সে দেখা—
ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও
না প্যারিসে,
না নিউইয়র্কে
না কোনো গহন জঙ্গলে আফ্রিকার;
কিন্তু আমরা দেখছি তাকে—
বাজারফেরত কাচা বাজারের ব্যাগে;
আমরা দেখছি তাকে—
অফিস-অভ্যস্ত শাদা শার্টের কলারে;
আমরা দেখছি তাকে
নাকের নিচে রঙ করা গোঁফের ডগায়;
আমরা দেখছি তাকে—
লুবনার আদরের পুষির আদরে;
আমরা দেখছি তাকে
আমাদের প্রেমময় অভ্যস্ত চুম্বনে;
আমরা দেখছি তাকে
আমাদেরই প্রাণপ্রিয় নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে;
কে তার বাহন বলো! কার অতিথি সে!
খুলে দ্যাখো—
ব্যাগে তার কার আমন্ত্রণলিপি?
কিছুই যায় না দেখা;
শোনা কথা—
মানুষই বাহন তার
শুধু দেখি—
সে যায় রাজনীতির বিরোধী শিবির;
শুধু দেখি—
সে যায় সাম্প্রদায়িক প্রচারণার বাড়ি;
শুধু দেখি—
সে যায় আন্তঃরাষ্ট্র দোষারোপের দেশ।
কী তার চরিত্র তবে! কী তার নগ্ন স্বরূপ!
জেনেছে কি কেউ?
কোথাও কোনও সমাজবিজ্ঞানী?
কিংবা মনস্তত্ত্ববিদ?
সেসবই অজানা এখনো;
শুধু সঙ্গোপন গবেষণাগারে, গায়ে পিপিই, মুখে মাস্ক,
চোখে নিয়ে মাইক্রোস্কোপ,
বসে আছেন যে-বিজ্ঞানী
মৃত্তিকার ধৈর্য তার শরীরে ও মনে,
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
বড় করে
ছোট করে
দেখছেন তিনি
দেখছেন বাইরের রূপখানি, দেখছেন বারবার।
কিন্তু তিনি কি দেখেন কিছু—
কি তার আসল রূপ,
কি তার তেলেসমাতি-ক্যারিশমার গোড়া?
বিজ্ঞানী নীরব; নির্বিকার টেলিস্কোপ তার।
বাইরে—ওদিকে, ওপাড়ায়, সে-গলিতে
ছোঁয়া লেগে মড়কের সচ্ছলতা হারাচ্ছে
লাখ লাখ শরীর ও মন,
লুটিয়ে পড়ছে কেউ
ঝড়কবলিত কলাগাছ,
অন্যেরা সন্ত্রস্ত;
এইসব সংক্রমণ, এইসব আতঙ্ক ও মৃত্যু
লাভগর্ভ তথ্য মিডিয়ায়;
আর যেখানেই লাভ বেশি,
সেখানেই মুনাফার অতিলোভী চোখ!
দ্যাখো, যারা ধর্মভীরু—তারা কেউ কেউ
ফেলে দিয়ে ঝাড়ফুক,
তুলে রেখে অভ্যস্ত ভরসা,
মনযোগী বিশেষজ্ঞ-পরামর্শে;
আর যারা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী—
ভুল করেও কোনোদিনও পা ফেলেনি
মন্দিরে
মসজিদে
প্যাগোডা
অথবা
গির্জায়,
সন্ত্রস্থ, তারও বেশি হতভম্ব,
দ্যাখো, তারা কেউ কেউ
সমর্পিত—
অলৌকিক অদৃশ্যের দরবারে
চোখ তুলে চোখহীন আকাশের দিকে।
গজবের আরশিতে আরো দ্যাখো—
শ্রেণীগত পক্ষপাত
মেরুকরণের দিন
নদীমাতৃক দুনিয়ায় নদীরা শুকায়,
আর ডাঙায় ফিরে আসে বোয়াল সংহিতা!
আধুনিক শকুনের চোখের আড়ালে,
কালুচাচা ভাগ করে
নিজের হাঁড়ির ভাত—
নিরুপায় পড়শির সাথে;
আর দূরে বসে রয়েছে লুটেরা—সম্পদের সিংহাসনে,
বাইরে থেকে বন্ধ তার
যাবতীয় দরোজা জানালা;
মড়কলাগা এ তল্লাটে
এখন কোনো মানিক মিয়া নেই;
মিডিয়াগুলো জগৎশেঠ
বেচে খায়—
সুন্নত আর নফল কাহিনী।
লাশ হয় যদু-মধু—আয়েশা-মমতা,
দশ, বিশ, অর্ধশত, শত;
শোকবাণী
আহাজারি;
আর মিডিয়ায় শিরোনাম—
গুটিকয় অন্য কেউ,
গুটিকয় অন্য কোনো নাম।
মহামারি চলে যাবে, রয়ে যাবে করোনাকাহিনি—
সরকারি নথিপত্রে,
হার্ডডিস্কে,
কারো কারো ব্যক্তিগত স্মৃতি-আর্কাইভে,
তথ্যে-উপাত্তে ঠাসাঠাসি;
কোনও একদিন হয়তো মাতাল হবেন
সর্বজ্ঞানী প্রফেসর—এইসব নিয়ে
ক্লাসে,
সেমিনারে,
পিএইচডি-র অভিসন্দর্ভ মূল্যায়নে;
পড়ে থাকবে চাপা কেবল মানুষের আসল অধ্যায়,
যেমন থাকছে চাপা আজ—
টকশোতে, ব্রিফিংয়ে, প্রিন্ট মিডিয়ায়।
যদি আমি মরে যাই
লকডাউন! লকডাউন! লকডাউন!
এই যে আপনাদের সবাইকে বলছি!
দয়া করে শুনুন! শুনুন! শুনুন—
শুনুন চন্দ্রিমা উদ্যানে বসে থাকা যুবক-যুবতী,
কান খুলে শুনুন বোটানিকাল গার্ডেনের
প্রেমিক-পেমিকা,
শুনুন, উঠোনে দাঁড়ানো বয়স্ক মুরুব্বিজন,
শুনুন—ঘামভেজা রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা,
একাত্তরের হানাদারের মতো মৃত্যু
এসেছে শহরে! মৃত্যু!
এখন সকলেরই বাসায় থাকতে হবে!
যারা বাইরে আছেন, প্লিজ, চলে যান
চলে যান—আপন আপন বাসায়!
ও ভাই কৃষক, ও ভাই দিনমজুর, দেখুন—
গাজা-দখলকারী ইহুদিবাদের মতো মৃত্যু
বাড়িয়েছে পা
শহর থেকে গ্রাম,
গঞ্জ থেকে বন্দর,
সকল রাস্তায়, সব হাটবাজারে, সবখানে;
আপনারা সাবধানে থাকুন! সাবধানে!
দয়া করে আমাদের কথা মেনে—
ঘরে অবস্থান করুন!
ঘরই আপনার দুর্গ!
ঘরই আপনার বাংকার!
মনে রাখবেন—
ঘরের বাইরে এলেই বিপদ!
এমনকি মারাও যেতে পারেন আপনি!
আমি শুনছি-শুনছি—শুনছি
আর মাঝে মাঝে আঙুল দিচ্ছি কানে
কিন্তু তুমিই বলো,
নজরুলসঙ্গীতের সুরভরা
তোমার কণ্ঠ শোনায় অভ্যস্ত এই কান—
আমি কতক্ষণই-বা বেঁধে রাখতে পারি!
শোনো বন্ধু, ক্ষুদিরাম না হলেও
নিজের মৃত্যু নিয়ে
অতোটা চিন্তিত নই আমি,
অনেক দিনই তো বাঁচলাম!
যে-উপমহাদেশ মাঝে মাঝেই
মৃত্যু-উপত্যকা হয়ে ওঠে—
কখনো যুদ্ধে, কখনো মড়কে,
এবং প্রায়শ দাঙ্গায়,
সেখানে পঞ্চাশ পেরিয়ে ছাপান্ন বছর,
প্রত্যাশা আরও বেশি হলেও,
একে কোনোভাবেই কম বলা যায় না।
তবু অন্যদের কথা ভেবে মেনে নিয়েছি—
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা;
তবু অন্যদের কথা ভেবে মেনে নিয়েছি—
কৃচ্ছ্রতা সাধন;
এখন আমি অটবির আরামকেদারা—
ব্যালকনিতে!
এখন আমি সনি টেলিভিশন—
ড্রয়িং রুমে!
এখন আমি পরিত্যক্তপ্রায়—
টিঅ্যান্ডটি-র টেলিফোন সেট—শোবার ঘরে!
তবু যদি আমি এই করোনাকালে মরে যাই,
দুঃখ নিও না বন্ধু!
ভেবে দেখো, পরিবহন চালু থাকলে—
আমি তো রোড অ্যাক্সিডেন্টেও
মারা যেতে পারতাম!
উন্নয়নের বাইপ্রোডাক্ট হয়ে প্রতিদিন
কত মানুষই তো মরছে-
বাসে, ট্রাকে, বাইকে, নসিমনে;
রাতে বাসায় ফেরার সময় আমি কি
মরতে পারতাম না—সার্বভৌম অন্ধকারের
গেরুয়া-ছোরায়?
ধরো, যদি আগামীকালই উঠিয়ে নেওয়া হয়—
নিষেধাজ্ঞা, কী এমন গ্যারান্টি আছে যে
আমাকে উঠিয়ে নেবে না যমদূত
লাল, কালো কিংবা হলুদ কোনো অছিলায়!
ধরো, যদি আগামী পরশু ডাক্তার হারুন
খুলে দেন তার ব্যক্তিগত চেম্বার
আর দীর্ঘ সিরিয়াল শেষে—
একটা সুযোগ পেয়ে যাই আমিও,
বলো, কী এমন নিশ্চয়তা আছে—
মহামান্য ওই ওষুধ খেয়েও শুকিয়ে যাবে না
জিম্মি হয়ে ওঠা আমার এই প্রাণটি?
অতএব, সবুর করো বন্ধু! সবুর করো!
তুমিই বলো, এই মুহূর্তে এর চেয়ে
ভালো বিকল্প আর কীই-বা আছে!
আমি জানি, তুমি বলবে, ‘সবুর করে আর কী হবে?
ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে তো
সবুরের গাছে আর মেওয়া ফলে না;
আগে বাঘে ছুঁয়ে-ফেলা মানুষও ফিরে আসতো
কখনো-সখনো;
তাই আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকতো
শুষ্কমুখ পরিবার-পরিজন;
এখন আর সেই বাঘের ভয় নেই;
কিন্তু রাষ্ট্র, ক্ষমতা, ধর্ম, উগ্রবাদ—
এসবে ছুঁলে আজ আর কেউ অপেক্ষায় থাকে না!’
তোমার কথা ফেলে দিতে পারি,
অতোটা মূর্খ নই আমি;
তবু সবুর যে তোমাকে করতেই হবে, বন্ধু!
তারপরও যদি আমি মরে যাই এই মড়কে, মরবো!
বন্ধু, তুমি তো জানোই—
সাম্যবাদের ষড়যান্ত্রিক পতনের পর,
বিশ্বজুড়ে,
লুটেরাতন্ত্র ফিরে আসে তার আসল চেহারায়,
দিন যত যাচ্ছে, ততই সম্প্রসারিত হচ্ছে—
তার প্রলোভের মাত্রা;
তাকাও কেন্দ্রে
তাকাও পরিধিতে
তাকাও আটলান্টিকে
তাকাও প্যাসিফিকে
তাকাও উৎসবে
তাকাও মিডিয়ায়
তাকাও বাজেটে
তাকাও বীমায়
সবখানেই তার থাবা, নখর ও দাঁত!
এমনকি কল্যাণমূলক মলমটুকুও
প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে—
‘মুক্ত ব্যবস্থায়
মাগনা কোনোকিছুই থাকতে পারে না।’
একথা ঠিক যে,
একটি মহান প্রাণের ছায়া আছে বলে—
এখনও এদেশে পুড়ে যায়নি—
খোলা আকাশের নিচে কাজ করা
প্রাণগুলো সবখানি;
কিন্তু অদূর ভবিষ্যৎ?
আমি শৃঙ্খলিত এক কণ্ঠ,
তবু তখন থেকেই চিৎকার করে বলে এসেছি,
ভাইসব! বোনসকল…!
এমন প্রেক্ষাপটে, আজ দুনিয়াব্যাপী
নেমে এসেছে
এক নতুন গজব!
সকলেই জানে, আমি বসে আছি ঘরে;
হ্যা, কোটি কোটি মানুষের মতো
আমিও ঘরবন্দি,
কিন্ত বসে নেই—যাকে বলে হাতপা গুটিয়ে;
অন্তত তুমি তো দিনরাতের আই উইটনেস—
মানুষের এই দুর্দিনে যারা
সমীচীন ভূমিকা থেকে দূরে রয়েছে—
লুটেরার-মুখে পরে স্বার্থপরতার মুখোশ
আর এলোমেলো টকশো,
অথবা কখনো গোরু মেরে জুতো দানের
প্রবাদকে লজ্জা দিয়ে
নিজেরাই ছবি হচ্ছে মিডিয়ায়,
আমি তাদের ফোরকালার মুখোশটি
দেখিয়ে দিতে চেয়েছি;
এই দেশে, যেখানে পিওন থেকে কেরানি,
লিফটম্যান থেকে দারোয়ান
তাদের বেতনের একাংশ দান করেছেন
দুর্গতদের ত্রাণ তহবিলে,
কেউ কেউ তুলে দিয়েছেন তাদের
উৎসবভাতার সবখানি,
সেখানে যারা ক্ষুধার্তদের
শূন্য থালায় পা দিয়ে চুরি করেছে
বিতরণযোগ্য খাবার,
তাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত স্লোগানের
অংশ হয়েছি আমিও;
আর অভূতপূর্ব এই প্লাবনে যারা মাঝি হয়েও
গুটিয়ে নিয়েছে নাও—
লংঘন করে জলদেবতার শপথ,
আর ডুবে মরছে অকালে—
নৌকার আশায় প্রাণ মুঠোয় নিয়ে ভাসতে থাকা—
জালাল-তুষার-আহসান,
প্রবাদের কণ্ঠ শুনে হতবিহ্বল দুর্গত জনপদ,
কেউবা বিভ্রান্ত সবখানি,
আমি তাদের উদ্দেশে রচেছি পরিহাসের পদ্য;
তুমি ভয় পাচ্ছ, তোমার ভয়কে
অশ্রদ্ধা করি না আমিও,
তবুও লিখতে চাই!
তুমি তো জানো—
আজ আমার কোনো চাওয়া নেই ব্যক্তিগত;
আমি চেয়েছি—
শুধু একটা ধাক্কা লাগুক ভাতঘুমে
শুধু একটু আঁচড় লাগুক অভ্যাসে,
শুধু একটু আঘাত লাগুক বিবেকে,
আর সকল দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে
তারা জেগে উঠুক—
পুঁজিবাদের পিতৃভূমেও যেভাবে জেগে উঠেছে
ক্যারোলিন-মারিয়া-রোজীনা-ডেভিডের মতো
বেশকিছু মানুষ।
দ্যাখো, আমার চাওয়া বৃথা যায়নি সবখানি;
আমাদের এই অভাগা দেশেই—
ইতোমধ্যেই এক বৃদ্ধ খালা, খালিদা বেগম,
তার হজের সবটুকু টাকা দিয়ে রচেছেন
মানবতার বাগান;
এক অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ আলী
তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে দিয়েছেন
জীবিকাহারা গ্রামাবাসীর হাতে;
মানবতার অ্যাপ্রন পরা একজন আশা
বাসায় রেখে দুটি কোমলমতি শিশু,
সেবা দিয়ে যাচ্ছেন উজাড় হাসপাতালে;
দ্যাখো, ক্রিকেট মাঠের এক ক্যাপ্টেন
কিভাবে তার সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে
দাঁড়িয়েছে দুর্গত মানুষের পাশে,
আর দেশবাসী দেখছে—
জনপ্রতিনিধিত্বের আসল রূপ!
আমাদের বেদনার্ত চোখের সামনে
যাদের কাজ তাদের না পেয়ে
করোনায় মৃতের জানাজা পড়াচ্ছেন
ইয়ং সরকারি কর্মকর্তা বদরুজ্জোহা।
‘আমরা সবাই রাজা আমাদের
এই রাজার রাজত্বে’!
যেখানে সবাই রাজা, সেখানে—
কিসের ইনসিডেন্ট কমান্ডার!
কিসের করোনা ক্যাপ্টেনস!
তবু তাকিয়ে দ্যাখো, দুর্যোগের উপকেন্দ্র
শীতলক্ষ্যার তীরে,
সম্মিলিত মোকাবিলা কারে কয়
সীমিত সুযোগের মধ্যেই
তা গড়ে তুলেছে স্থানীয় প্রশাসন।
চোখ খুলে লাইভে দ্যাখো—মাত্র দুটি টর্চলাইট,
তাই নিয়ে পথ দেখাচ্ছেন
অতল অন্ধকারে—
অসম সাহসী একজন মীরজাদীর দল;
আর ওয়াচ টাওয়ারে নির্ঘুম চোখ—
যোগ্য জননীর মন নিয়ে
একজন দিয়ে যাচ্ছেন—
শক্তি, সাহস ও প্রণোদনা। এবং হুঁশিয়ারিও।
আমার গলা ফাটিয়ে বের হয়ে আসে—
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’
দূরে, যেখানে ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রবাদশাসিত ইউরোপ,
সেখানে-
ইটালির নব্বই ছুঁই ছুঁই ডাক্তার গিরন,
মৃত্যু ছুঁই ছুঁই,
মৃত্যুর রাজ্যে নেমেছেন মৃত্যু-বিরোধী মিছিলে;
আর দ্যাখো, পাশের রাজ্যে,
শিল্পপতি আজিম প্রেমজীকে,
দ্যাখো, বলিউড বাদশা শাহরুখ খানকে,
দ্যাখো, কুঁড়েঘরের বাসিন্দা—
বিধায়ক শ্যামলী প্রধানকে!
তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে—
আশরাফুল মাখলুকাতের উজ্জ্বল উত্তরীয়টি
আজও শোভা পায়—
কোনো কোনো মানুষের গলায়
যেমনটা পায় বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবটি
জাহাঙ্গীর-রউফ-নুর মোহাম্মদের নামের পাশে!
করোনা-বন্দি এই আমি—আর কিছু নয়,
আঁকতে চেয়েছি—
এদেরই ছবি—দীপ্ত প্রাণের বর্ণমালায়।
এ অবস্থায় এর বেশি—
আমি আর কীই বা করতে পারি!
তাই তো বলছি বন্ধু, আমি যদি মারাও যাই—
এই করোনাকালে,
এ নিয়ে বেশি কষ্ট পেয়ো না!
রক্তে রাজশাহী সুগারমিল,
স্পন্দনে মেঘনার মোহনা,
টেলিভিশনে ঘোষণামুখর—
প্রফেসর আবু আবদুল্লাহর বাণী,
এসবের কোনোটাই তো অস্বীকারের জো নেই
যদিও আমি এসব প্রায়ই ভুলে যাই
লিখতে বসলে মাউস নিয়ে অভ্যস্ত আঙুলে!
মহাকালের আর্কাইভে চোখ মেলে দ্যাখো,
কোনো দুর্যোগই স্থায়ী হয়নি, এটাও হবে না,
অবশ্যই জয় হবে মানুষের—
যদিও জেতার পথে হারিয়ে যাবে অনেক প্রাণ
গতি হারাবে অনেকখানি—
একচোখা অর্থনীতির চাকা;
দু’একটি এলিট রাত্রি হারাবে ফোরকালার উল্লাস;
চুম্বন হারাবে অনেকগুলো গরিব-গরিব ঠোঁট;
মৃতের অবস্থানে, শোকবার্তার ধরনে এবং
মানসিকতার উলঙ্গায়নে,
এই মহামারিও দেখিয়ে দিয়ে যাবে—
আমাদের শ্রেণীচরিত্র,
এবং আরও বেশি এলোমেলো হয়ে পড়বেন
বিভ্রান্তির বাঁকে বসে ধূমপানরত উত্তরাধুনিক কবি;
তবু মানুষের ইতিহাস—
এগিয়ে যাওয়ারই ইতিহাস
‘অতীতের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ’
স্বর্গীয় এই বাণীকে সত্য করে তুলেছে—
স্বর্গলোকের কোনো দেবতা নয়, মাটির মানুষই
যদিও সে বিভক্ত, বিভাজিত এবং
মহামিলনের পথে নিজেই বিছিয়ে রাখে
আরববুড়ির প্রকল্প।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে আমি এখনই মরতে চাই না,
আমার কিছু ভালোবাসা বাকি রয়েছ এখনো,
আমি আরও কিছু ঋণ শোধ করে যেতে চাই,
আরও কিছু, আরও কিছু; আরও কিছু;
যদি মহামান্য যমদূত আমাকে
ওভারলুক করে যান—
তার অতিব্যস্ততার এই হলুদ সময়ে,
বাঁচতে চাইবো;
রাষ্ট্র নয়,
গোষ্ঠী নয়,
বাঁচতে চাইবো শুধু তোমার হাতটি নিয়ে হাতে।
আর এই মহামারিতে যদি আমি মরেই যাই—
তোমার প্রেম-প্রার্থনার প্রতিকূলে,
যে-আশঙ্কার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি—
একটু আগে,
দুঃখ করো না বন্ধু,
এটা তোমার বৈবাহিক নিয়তি বলে মেনে নিও।
শুধু বিশ্বাস রেখো অন্তরে,
যতদিন থাকবে তুমি স্বপ্নশাসিত এই দুনিয়ায়,
তোমার ভালোবাসা জড়িয়ে থাকবো আমি—
বসন্ত-সাঁঝে যেভাবে জড়িয়ে থাকে
বসন্ত বাতাস
তোমারি আদরে গড়া ব্যালকনির বাগান!