ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত: ১
তখন ঢেউ মৃদু। এক টুকরো বাউল কচুরিপানা ভাসছে। ভরসা ডানা থেকে ডানায়। পাখিকে ভ্রমণ বলি। বলি ইহকাল। যে ট্রেনখানা এইমাত্র স্টেশন ছাড়ল সেটি মূলত গন্তব্যপাগল। ট্রেন এবং পাখি হাত ধরাধরি করে উড়ছে। স্থির হয়ে বসো। বাতাসে মৃদু ঢেউ। ট্রেন, পাখি, প্রাণ, কোনোটিই যথেষ্ট নয়। মাইক্রোলেন্সের নিচে বিন্দু বিন্দু রক্ত পরস্পর পরস্পরের নিকটে আসার উত্তেজনায় কাঁপছে। দৌড়ে যাই ট্রেনের দিকে। থমকে যাই পাখির দিকে। কচুরিপানার নিচে জল কাঁপছে। কেউ কারও কাছে আসতে পারছে না: না রক্ত, না প্রাণ। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে ট্রেন ও পাখি। তখনও কচুরিপানার নিচে ঈষৎ কম্পনশীল। মায়ের পেটের ভিতর প্রথম ট্রেনজার্নি করেছিলাম আমি।
‘হাহাকার’ শব্দটির অর্থবিস্তারী সম্ভাবনা: ১
আমার চোখ হা করে তাকিয়ে আছে ‘হাহাকার’ বরাবর।
‘হাহাকার’ ভাসছে। যেভাবে খসে পড়া গাছের পাতা
ভাসতে থাকে বাতাসে। খয়েরি ও খসখসে। শিরাওঠা।
আমার চোখের ভেতর একটা আস্ত সমুদ্র ঢুকে পড়েছে। তা না হলে
আমি কেন দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রসীমায় কাঁপতে থাকা শূন্যতা, গতরাতের
খুন হয়ে যাওয়া নির্জনতা। নির্জনতাগুলো গান হয়ে গাছে গাছে ঝুলছে।
শিশিরের ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ছে স্মৃতি। নৈঃশব্দ্যের ছবি আঁকতে গিয়ে
এঁকে ফেলেছি সিগারেট, একটা শিরাওঠা খসখসে খয়েরি পাতা,
মোঘল আমলের ময়ূর। আর তখন চারদিক অন্ধকার করে
চিতোয়ানের ফরেস্টে বৃষ্টি নামল। ঘন+গভীর। আমাদের ‘যমজবৃষ্টি’।
শূন্য
শূন্য একটি ধারণার নাম। এর কোনও অর্থ নেই। শূন্যের আশেপাশে কিছু থাকতে হয়। গণিতের নিয়মে তুমি যদি নিজেকে শূন্য ধরে নাও, তাহলে তোমার পাশে আমি অথবা আর কেউ না থাকলে শেষাবধি তুমি শূন্যই থেকে যাবে।
আকাশ শূন্য। আকাশ শূন্যতা ভালোবাসে না; খুঁজে নেয় পাখি, মেঘ অথবা পতনশীল বৃষ্টি ও বরফ।
আমি খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছি; মৃত্যুর মতো আর কোনও শূন্যসংখ্যা আছে বলে জানা নেই আমার। শূন্য নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সব সময় একটি সংখ্যা খুঁজছে; পক্ষান্তরে খুঁজছে আমাকে।
চাষিপুত্র
তুমি কি ঘুমিয়ে ছিলে ঘাসের বিছানায়? পাখিদের পালক ছড়ানো জল।
এইভাবে চাঁদ গিয়েছিল ভেসে; আমরা ফিরছিলাম শহরের দিকে
আমরা চার পুরুষ, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম।
তুমি ঘুমিয়ে ঘাসেদের পাঠশালায়
হাতের কনুইয়ে বসে আছে প্রজাপতি; মাথার নিচে
হিমালয়ের চূড়া থেকে নেমে আসা একখণ্ড প্রাচীন পাথর।
পাথরের গায়ে লিখে রাখি চাষমন্ত্র। ফসলের বংশলতিকা।
প্রাকৃত ঈশ্বর: ১৭
তোমার স্নায়ুর ভেতর আমার বিষণ্নতা প্রবাহিত করি
প্রাবাহিত করি অজস্র ফুলে ভরা বিকেলের তীব্র কণ্ঠস্বর
এতটা দীর্ঘ স্মৃতি কিভাবে বহন করবে তুমি?
কিভাবে রাতের ফুলগুলি ভেজা জোছনায় ভিজে উঠবে আবার!
আমার যন্ত্রণার ফলগুলি পেকে উঠবে এই জোছনার বর্ষায়
এমন সাজানো জোছনা কী করে আঁকলে তুমি?
গ্রামের ওই তালপুকুরের ধার ঘেঁষে মরা বাতাস ভেসে থাকে।
ফুটেছে শিমুল ফুল। মেয়েগুলি দলে দলে আসবে আজ
খোঁপায় কষ্টের নীল ফুল গেঁথে।
এতটা সময় ধরে এতটা নীল স্মৃতি কিভাবে বহন করেছ তুমি?
প্রাকৃত ঈশ্বর: ১৪
কিভাবে ঘুমিয়ে থাকে শান্ত বিকেল
পরিচিত শান্তি নিয়ে বুকে।
তোমার স্তনের রং বিকেলের ঘুমের মতো নীরব
নীরবতার বিন্দুতে বিন্দুতে জমে থাকে হিম স্বচ্ছকণা।
আমি ছুঁয়ে দেখি সেই হিম অনুভূতি আর
সেই শ্যামল মেয়েটির আশ্চর্য স্বচ্ছ বুকের মিষ্টি মৌনতা।
এইসব মৃত জীবনের গল্প
বাবলা গাছের ছায়ায় বসে ভাত খায় খোকা; মা তাকিয়ে থাকে। স্কুল থেকে ফিরে মাঠে যায় খোকা; মা তাকিয়ে থাকে। খোকা শহরে যায়; মা তাকিয়ে থাকে। খোকা ভবিষ্যতের দিকে যায়; মা তাকিয়ে থাকে। খোকা ভবিষ্যত খোঁজে; তালাবদ্ধ ভবিষ্যত।
নীরবে সহে যাও, ভুলে যাও মায়ের মুখ; আমার বাংলাদেশ। আর দেখ, আমাদের বাবারা তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।
চিতায় পুড়ছে শঙ্খ, প্রেমিকার শঙ্খচূর হাড়; দুগ্ধপোষ্য শিশু অথবা বিধবাদের রোদে ঝলসানো পিঠ; কৃষিজীবী নর অথবা নারী; শিরাওঠা হাতের কব্জিতে ক্লান্তি অথবা জোছনাশুদ্ধির গান, দীর্ঘচন্দ্রমাস। রাতের যৌনতায় পুড়ে যায় শরীর; চিতা জ্বলে দাউদাউ; শঙ্খের ধ্বনি ভেসে আসছে রানুদের বাড়ি থেকে। নদীর ওপাড় থেকে ভেসে আসছে কাকবন্ধ্যা-প্রভাত। দিগন্তের শেষ রেখায় মিলিত হয় শাদা বক তার প্রেমিকার সাথে। যৌনতার তৃপ্তি নিয়ে ভেসে থাকে দিগন্তের আভা।
এইসব মিলিত অক্ষর, এইসব মিলিত সংগীত; অথবা এইসব জীবনের গোলপাতারেখা মিশে আছে শিলাধ্বসের দেহে, নদীর জলে। অথবা মৃত জীবের জীবাশ্মে মিশে আছে আমাদের ঘামতৃপ্তি।কী এমন অর্থ আছে এইসব ব্যর্থ মানুষ, অথবা মৃত হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন?
পাটরচনা: ১
এইখানে সুলভমূল্যেশস্যবীজ শস্য-আত্মা, দেহকাঠামো বিক্রয় হয়।
রৌদ্রবৃষ্টি বারান্দা হেঁটে হেঁটে কিষাণেরা বেলা করে
হাটখোলা তেমাথায় গিয়ে ভিড় করে। জিরাতে জিরাতে
কাটা-তামাক ধোঁয়ায় জিহ্বা আলজিহ্বাতালুকণ্ঠবুক খানিক
পুড়িয়ে নেয়। এখন পাট মৌসুম,
কৃষকপুত্র, পাটবীজ
কিষাণের ধমকে ধমকে লিকলিকে সোজা হয়ে ওঠে।
ওরা পাট সম্প্রদায় খুউব
প্রতিবেশী প্রিয়; বান্ধব-বৎসল আর
দেহে দেহ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে।
ওরা সবাই সহমরণে বিশ্বাসী বেশ এবং পরজন্মের জন্য
সর্বদাই উদগ্রীব। কৃষক ঈশ্বর ওদের জীবনগাথা কণ্ঠে নিয়ে
পচাডোবা দেহ থেকে জন্ম দেয়সোনারঙা আঁশ
পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়।
যোজনগন্ধা নক্ষত্রেরা মরে যায়: ৭
চৌদিশ সমূহ বিপদ, দুর্মুখ দুষ্টকথা দুর্মূল্য বাজার। রেলগাড়ি গড়ায়; রেলপাত গেঁথে থাকে মৃত্তিকাহৃদে। একজীবন রেলগাড়ি গড়ায়; ভাটকবিতা মুখে মুখে। রেলজানালায় ফুটে আছে ভাটফল বিকেল। এলাহি ভরসা পার করো আমাকে দয়াল রেলরজনীর রাত। বুদ্ধপত্নী গোপী কাঁদে বুকে নিয়ে বালকপুত্র। প্রবজ্যায় গেছে স্বামী—চাঁদশাসনের রাত, চুপি চুপি ফাঁকি দিয়ে ষোড়শী ভার্যা। সীতাকুণ্ড পাহাড়, মাধবকুণ্ডে নামে জল, জলপ্রপাত। মৃৎদেহ গড়িয়ে আবেগ ভরসা ভয়াল হলে সাধনা সাধে ভজনকথা—মাদুর পেতে দিয়েছি সাধু, আচল পেতে দিয়েছি, বসো এইবেলা।
রাংচিতা গাছে কামাভাব জেগে উঠলে রাঁড়রমণী রাতের আয়োজনে গা ধোয় ধোপাদের ঘাটে। রাইকিশোরী একলা হাঁটে ভীষণ বিজন বাগান, রহম কর শীতলা দেবী। স্বপ্নাদেশ আসিতেছে ধীরে মেঘদেশ থেকে। চৌদিশ সমূহ বিপদ, শিশুপ্রকৃতি সমাকর্ষণে কাঁপে। হেলেঞ্চার বনে বনে উড়ে গেলে ফড়িং, হেরেম রমণীর আঁচল খসে পড়ে হেফাজতহীন বেআব্রু। হীরামন গান গায়। হেঁতাল বৃক্ষের ঘ্রাণ সইতে পারে না সাপ, লিঙ্গ প্রতীক। ও আমি কিভাবে ফাঁকি দেই দেহরস নারী নদী ফুল পাখি মৈথুন-বিকেল; এখনি নামবে, ভীষণ তস্কর রাত।
রাতভর রেলগাড়ি গড়ায়; রেলগাড়ির গতির মতো ধীরে গড়ায় শরীরী ব্যাধি। বুদ্ধ বৃদ্ধ হলে বুদ্ধপত্নী ভুলে থাকে কামকথা বিষব্যাকুলতা—এই দেহ শুকালে সাধু কী সাধন সাধিবে এমন বিজন দেহে।
বিজ্ঞানের সপ্তমী গণিত: ১
তারপর সন্ধ্যা। সন্ধ্যার চোখে সময়ের জীবন বিন্দু।
জন্মের কোলে মাথা রেখে মৃত্যু আসে
মৃত্যুর মতো এত দীর্ঘ অপচয়ের পর ঘুম ভেঙে
ভেঙে ফেলি ঈশ্বরের মূর্তি।
নগরের নারী অভিসারে গেলে
গর্ভবতী জোছনার শরীরে নামে বাউল বাতাস।
উর্বর মেঘ, গর্ভবতী মেঘ
এখনও কিছু কিছু মানুষ গল্প শোনে
ঈশ্বর আর ইবলিশের গল্প। নির্বোধ।
আগামীকাল আবারও সূর্য উঠবে আর
আজকের রাতের মতো প্রতিটি রাতে
বৃদ্ধ নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে। বীর্যক্ষয়, বীর্যপাত
ফলবতী জরায়ু জঠর কাঁপে, জন্ম উত্তেজনা লাল।
দ্রোহের আগুনে চোখ বুজে আসে
ঘাই হরিণীর নাভিঘ্রাণে রতিরস বিভোর মানব-মানবী
সবুজ পাখি উড়ে যায় আকাশের নীচু তলা ঘেঁষে।
আকাশের নীচে অনাহার, ভেঙে গেছে উপাসনা ভয়
মন্দির মসজিদ গীর্জা।পরজন্মের লেবাস পড়ে হেঁটে যায়
কুৎসিত পাদ্রীর দল।
আকাশের পালকে ভাসে পবিত্র মেঘ। মানুষেরা পাশাপাশি দাঁড়াও,
বৃষ্টিরা নত হলে লাঙ্গলের ফলায় গেঁথে নাও জীবনের ঘ্রাণ
এখানেই বিউগল বাজুক। বিজ্ঞানের সপ্তমী গণিত।
মানুষেরা পাশাপাশি দাঁড়াও। জেনে নাও জলের দহন
ভাসাও ভেলা, সপ্তডিঙা মধুকর। অথবা পদব্রজ ভ্রমণ
অথবা অনার্য দ্রাবিড় ঐরাবতের ঐশ্বর্য নিয়ে
ঘোড়সোয়ারের বল্ল¬মে গেঁথে ফেলোপৃথিবীর বিপরীত গতি।
আর আমরা প্রস্তুত হবার পূর্বেইহারিয়েছি যুদ্ধের অধিক
আধখানা চাঁদ হতে পারতো আমাদের হাতিয়ার।
সময় বিনাশী দেবতা ধেয়ে আসে। উত্তাল সমুদ্র
মল্ল¬যুদ্ধ। ফুসে ওঠে সমুদ্র। বক্ষজোড়া কম্পন
জন্ম নেবেই এবার জলজ জীবন, শ্যাওলায় মোড়ানো।
কাকতাড়ুয়া রৌদ্রু, অঙ্কুরুদ্গম
রৌদ্রু আমাদের ভ্রাতা, সমুদ্রের গর্জন আমাদের সংগীত
পরিব্রাজক বাতাস আমাদের পথ দেখাবেন
আমরা বসতি স্থাপন করবো। উপকূল
উলবন্ত উপকূল খুঁজছি আজও লক্ষ সহস্র সহস্রাব্দ যাবৎ।
অতঃপর নদীদের জন্ম হলে
হাজারটা অগ্নুৎপাত সূর্য বছর হিমযুগ লাভাস্রোত ফসিল
ডায়নোসর আমাদের প্রতিবেশী
অতঃপর মেয়েটা ঋতুবতি হলে
ঋতুস্রাব আনন্দ উৎসব
গভীর অন্ধকার রাত্রি হাসছে
নৃত্যরত আদি মাতার দুধাধার দুলে দুলে ওঠে। হাসছে শিশু,
একটা পেট মোটা পাইথন একটা মানুষের বাচ্চা গিলে নিলো।
মাতাশাসিত পরিবার। রমণে বংশবৃদ্ধি
বলিষ্ঠ পুত্র হোক বংশবাদক
আহা পুত্র! শিকারে বেরুবার পূর্বে
এসো আমাকে, আরও একবার
অন্তত দিনের নান্দীপাঠ হোকআমাকে আলিঙ্গনে রেখে
এসো গর্ভ সঞ্চার করি; নতুবা আমরা মাত্র পাঁচজন
আমাদের ছিনিয়ে নেবে মৃত্যুতুল্য কুৎসিত দেবতা
অথবা বরফ পাহাড়ের ভূমিধ্বস।
ঐ দেখ শ্বেতভল্লুক, মাদি ভল্লুকের সাথে মাতে শৃঙ্গারে।
ওহে পুত্র, আলিঙ্গন সুখের উত্তেজনা শরীরে না মেখে
যেতে নেই শিকারে। এসো বিদ্ধ করো আমাকে
কামনার তীব্র আঘাতে।
শৃগালের চিৎকারে রাত্রি কেঁপে ওঠে। পাড়াগার নিশুতি আলিঙ্গন।
ভয়। ভুতেরা নাচতে থাকে বাঁশের মাথায়।
শিমুলের ডালে অশুভ পেঁচা ডাকছে
আমাদের সন্তানের কাঁচা মগজ খুঁটে খাবে
আমাদের মেয়েদের অসতর্ক প্রহরে।
রাত বাড়ছে। আমরা ঘুমোতে পারি না। পৃথিবীটা অনেক বড়ো।
বড়ো বড়ো দালান মাঠ নদী অথবাসমুদ্র জেগে থাকে;
কোজাগর রাত, বুড়ো একটা শিঙওয়ালা অজগরের পিঠে কাঁপে
সিংহভাগ পৃথিবীর মানুষ। আরপবিত্র পুস্তকের অক্ষর মৈথুন। অপজীবন। অপচয়।সংশয়। বিশাল মানব জনম কবরে লুকায়।
কবরের ওপারে মিথ্যা। বালু, বালুঝড়। দাবানল দাবাদহ দমদম এয়ারপোর্ট। এপাড়েই নৌকা রাখো। শক্ত রজ্জুতে বেঁধে মানব দেহ।
প্রাচীন একটা অসভ্য পাইথনের মাথায় কাঁপে
সংখ্যাগুরুমানুষের সংসার। সিংহভাগ জীবিত পৃথিবী।