আব্বাকে বুড়িমার চিঠি
বাগানের প্রিয় ফুলটি কেমন করে ঝরে গেল অবেলায়;
আব্বা, আপনার প্রিয় গানটির মতো প্রতিদিন আমিও
বার বার বলি— ‘তুমি আজ কতদূরে..’
কোন অন্ধকার ঘরে একলা একলা।
আমাদের ভোরের পাখিটা ভোরটাকে
অন্ধকার করে চলে গেলো কোন সুদূরে!
আব্বা শুধু একবার শুধু একবার শুনতে চাই—
বুড়ি করে আসবা?
একবার স্পর্শ করতে চাই আপনাকে—
. ‘আই লাভ ইউ আব্বা’।
আব্বা, আমার জন্যেই শুধু আমারই জন্য শেষবেলার
শেষ দেখাটা হলো না আপনার প্রিয় সাথীর সাথে;
নিজেকে যে ক্ষমা করতে পারছি না কিছুতেই—
করবোও না।
আব্বা, আপনি সেদিন কেন বললেন—
আজকে আবার আমাকে কোনে নিয়ে যাচ্ছ?
কেনো নিয়ে যাচ্ছ?
সেই তো রাজাপুরের বাড়িতে আপনের শেষ কথা
আমার কানে মনে সব সময় বাজতে থাকে।
যে রুমের ভিতর আপনি এই কথা বলেছিলেন
আমি আর পারিনি সেই আপনার প্রিয় রুমটাতে
. প্রিয় খাটে বসাতে।
আব্বা আমার বড় কষ্ট লাগে—কেন এমন হলো?
হাসপাতালের বারান্দায় আপনের শেষ কথা
জীবনের শেষ কথা
বছরের শেষ কথা—‘বুড়ি, আমাকে ধরো’।
আব্বা, আমার বড় কষ্ট আমি কেন তখন
আপনাকে টেনে বুকের ভেতর নেইনি!
হাত দুটি আপনে কেমন করে
দিয়েছিলেন এগিয়ে আমাকে।
আমি সেদিন বুঝতে পারিনি মানুষ এত নীরব
এমন নিরবভাবে চলে যাই! চলে যেতে পারে!
আব্বা, সাত বছরে আমি একবারও উচ্চারণ করিনি
আমি ক্যান্সারের রোগী—ক্যান্সারের সাথে
যুদ্ধ করে বেঁচে আছি—যুদ্ধ করে যাচ্ছি।
তার পরে—তার পরে—তারপরেও আব্বা—
মা বেঁচে থাকে—ছেলে মারা যায়
. জগতের উল্টা নিয়ম…
ফিজিওর কাছ থেকে যখন ফিরছি
আজ সকালে ফিজিওর কাছ থেকে বেরিয়ে
রাস্তা দিয়ে হন্ হন করে হাঁটতেই
চোখে পড়লো বিশাল দেহধারী একটা মেয়ে
সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে চলে গেল
. আমার ডান দিক দিয়ে।
বাম দিকে তাকিয়ে দেখি
একটা আধা বয়সী মহিলা
চেয়ারে বসে মৃদুস্বরে ফোনে আলাপ করছে;
হয়তো তার আপনজনের সাথে।
তার পোষা দুটি ছোট বড় কুকুর হাঁটুগেড়ে
তার পায়ের কাছে বসে আছে তার মুখপানে চেয়ে;
তার মাথার চুল অর্ধেক খোলা— মন্দ লাগছে না দেখতে।
পলক ফেরাতেই দেখি
অজস্র লাল ক্যামেলিয়া
সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে আছে।
কিছু শুকিয়ে গেছে, কিছু আধা শুকনা
কিছু বা একেবারেই তরতাজা;
কিছু ফুল আমার চোখের সামনেই ঝরেও পড়লো।
আবার সামনে তাকতেই দেখি—
একটা ছেলে তার দুই হাত সোয়েটারের দু’ পকেটে
ঢুকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
আর একটু আগাতেই দেখি—
ও ধার দিয়ে একটা মেয়ে মাস্ক পরা
দু’হাতে দুটি ব্যাগ;
তার পেছনে উঠতি বয়সের একটা ছেলে
পা দুটি মাটিতে না রেখে
কি জানি একটা কিসের ওপর দিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে।
বাসার গোটে আসতেই দেখি অস্ট্রেলিয়া পোস্ট অফিস
চিঠি হাতে অপেক্ষা করছে একজন চাইনিজ।
গেট খুলে তাকে জিজ্ঞাসা করি—
Do you want to come inside?
সে বললো—No Thanks..
ঘাড় ঘুরাতেই দেখি
চিঠির মালিক এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে;
আমিও ঢুকে পড়ি আমার বাসার গেটে।
সিডনির রাস্তার মোড়ে
রাস্তার মোড়ে দাঁড়াতেই দেখি— দূরে
একটা খেজুর গাছের মাথায়
তিনটা সাদা বক পাখি
একের পর এক ডানা ঝাপটাচ্ছে।
আর তাদের ভাষায় বলাবলি করছে কোনো কিছু।
বড়ই ভাল লাগছে, কারণ—
ঠিক তখনই নীলকাশের গা ঘেঁষে
লম্বাটে সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
দূরে বহু দূরে চলে যাচ্ছে একটা রকেট
অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে।
চোখ ফেরাতেই দেখি—
এক মা তার দু’বছরের মেয়ের
হাত ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে ফুলের দিকে।
মেয়েটির মাথায় লাল রঙের
ঝুঁটি টাইপের একটা টুপি
গায়ে লাল পশমি সোয়েটার
দেখতে বেশ লাগছে।
আর ঠিক আমার সামনে দিয়ে দ্রুতগতিতে
এক মা বাচ্চার ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে যাচ্ছে;
তার বুকের অর্ধেকটা গেঞ্জির ভেতর থেকে
. উঁকি মরছে।
পরক্ষণেই দেখি একটা ইয়াং মেয়ে তার
যত্নে পোষা কুকুরটারে
কোলে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার
চেষ্টা করছে।
ঠিক এমন সময় একটা স্পর্শে সবকিছু থেকে
চোখ ফিরিয়ে দেখি—
আমার মেয়ে চলে এসেছে স্কুল থেকে
যার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম—
যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।
মা-মেয়ের দিন যাপনের গল্প
ভোরের আলোতে জেগে ওঠে পাখিরা
পাখিদের কলতানে জেগে ওঠে পাড়াপড়শি;
ঘড়ির টিক টক আওয়াজে
শয্যা ত্যাগ করি আমরা দুজনে।
চোখ মুছতে মুছতে দুজনে ঢুকে পরি ওয়াসরুমে
পরে ফেলি শার্ট-প্যান্ট।
মেয়ে পরে সাদা শার্র্ট কালো প্যান্ট
আমি পরি কালো প্যান্ট কালো শার্ট।
চলে আসি দুজানে ডাইনিং টেবিলে
সে খায় সাদা ভাত
আমি খাই ট্যাবলেট।
খাওয়া শেষে দুজনে চলে যাই পড়ার ঘরে।
মেয়ে কাঁধে ঝুলায় স্কুল ব্যাগ
আমি পকেটে ঢুকাই চাবির গোছা,
মেয়ে চোখে পরে পাওয়ারফুল চশমা
আমি পরি সানগ্লাস।
আটটা ত্রিশে আমরা নীড় ছেড়ে
বেরিয়ে পড়ি স্কুলের পথে।
নিয়মের নিষ্ঠুর বেড়াজালে বন্দি
মানিক, আমার পরম বন্ধুদের সম্পর্কে কিছু কথা
কিভাবে শুরু করবো ঠাহর করতে পারছি না,
তোমাকে বোঝাতে পারবো কিনা জানি না।
মানিক, যে রাস্তার সাথে আমার মিতালি
যার সাথে প্রতিদিন আমার সাক্ষাত হয়
সে রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে আমার কতো
সব পরম বন্ধুরা
এরা কেউ আমার আপনার থেকে কম নয়।
তবে জানো কি
আমি ওদের নাম জানি না।
ওদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়
কখনও বেড রুমের জানালায়; কিচেনের জানালায়
কখনও বা লাউঞ্জ রুমের জানালায়
আবার কখনো চলার পথে।
তবে হ্যাঁ একটা নাম আমি জানি—
ওর নাম ক্যামেলিয়া;
আরো জেনে ফেলেছি যে শুধু লাল নয়
সাদা, ফর্সা, কালো মানুষের মত
এখানে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ক্যামেলিয়া আছে।
মানিক, এই মূহুর্তে এই ক্যামেলিয়ার জন্য
খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে মনটা বড় অস্থির লাগছে।
কেনো? তা জানো?
জানো না তো
শীতের শুরুতে যে ক্যামেলিয়ারা ছিল ভরা যৌবনা
শাখায় শাখায় পরতে পরতে কুঁড়ি আর কুঁড়ি,
সবুজ পাতায় সাজানো ছিল ডাল।
তা আজ বিবর্ণ শীতের মাঝপথেই
পুষ্পবর্ষণ হচ্ছে পথে পথে ক্যামেলিয়ার।
আর ক’টা দিন থাকলে কি ক্ষতি হতো?
বলো, কি এমন ক্ষতি হতো প্রকৃতির?
এটাই বুঝি প্রকৃতি
নিয়মের নিষ্ঠুর বেড়াজালে বন্দি প্রকৃতি,
মাঝে মাঝে মনে হয়
কেউ যদি নিয়মের পায়ে শিকল পরিয়ে দিতো!