পৃথিবী আর আমার সন্তানেরা
আমার সন্তানেরা বড় হচ্ছে হুটোপুটি লুটোপুটি করে। এমন চঞ্চল আর এমন ঝগড়াটে আমি আর দেখিনি কোথাও।
একদিন একটা ভূগোলক কিনে আনলাম বাসায়।
আমার হাতে ভূগোলক দেখে তারা জিজ্ঞাসা করে—‘বাবা গো, ও বাবা, এটা কী গো বাবা?’
বললাম—‘এটা পৃথিবী।’
‘বাবা, আমি পৃথিবী নেব’—বললো একজন।
‘বাবা, আমিই পৃথিবী নেব’—বললো আর একজন।
সে কি তাদের হুড়োহুড়ি, কাড়াকাড়ি।
বললাম—‘থাক বাবারা, রাখ। এটা আমার কাছেই থাক।’
পরদিন,
এক সন্তান এসে বেশ বড়মানুষি কণ্ঠে বললো—‘বাবাগো, দেখবেতো এসো, তোমার এক সন্তান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুতছে পৃথিবীর মুখে।’
তাড়াতাড়ি নুনুটা প্যান্টে গুঁজতে গুঁজতে এসে, সেও হাঁপাতে হাঁপাতে বললো—‘বাবা, ও-ও আগেই মুতেছে পৃথিবীর মুখে।’
পৃথিবীর উপহার
[পৃথিবী আমাকে প্রশ্ন করছিল। আমি উত্তর করছিলাম।]
—তোমার প্রিয়ফুল কী?
—গোলাপ।
—তোমার অপ্রিয় ফুল কী?
—গাঁদা।
—তোমার প্রিয় রঙ কী?
—লাল।
—তোমার অপ্রিয় রঙ কী?
—হলুদ।
পৃথিবী আমাকে একটি হলুদ গোলাপ এবং একটি লাল গাঁদা উপহার দিয়েছে।
ঘোড়ার গাড়ি আর মানুষের গাড়ি
তুমি যে বলো, ঘোড়ার গাড়ি, একথা কি ঠিক কথা?
তুমি যে বলো, গরুর গাড়ি, একথা কি ঠিক কথা?
ইচ্ছে করলে ঘোড়াটা আর ইচ্ছে করলে গরুটা কি এই
গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যেতে পারবে আর এক
কোথাও?
তুমি বললে, ঘোড়ায় টানে বলে ঘোড়ার গাড়ি।
তুমি বললে, গরুয় টানে বলে গরুর গাড়ি।
ফেরার সময় বললাম, চলো আমরা মানুষের গাড়ি
চড়ে বাড়ি ফিরে যাই। তুমি জিজ্ঞাসা করলে, মানুষের গাড়ি
মানে?
উত্তর দেওয়ার আগেই বিষণ্ন তুমি বুঝতে পেরেছিলে
রিকশার কথা। তুমি বিষণ্নভাবে হাসতে হাসতে বললে,
মানুষেরা বুদ্ধি জানে বটে। ঘোড়া দিয়ে টানিয়ে নেয়
আর বলে ঘোড়ার গাড়ি, গরু দিয়ে টানিয়ে নেয় আর
বলে গরুর গাড়ি কিন্তু মানুষ দিয়ে টানিয়ে নিয়ে
মানুষের গাড়ি না বলে, নিজেকে কেমন করে
বাঁচিয়ে নেয়।
স্কচটেপ মারা পৃথিবী
বাসায় ফিরে—
রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, স্কচটেপ দিয়ে জোড়া দিচ্ছে বসে বসে ভীত ছোট্ট মেয়ে আমার। চুপি চুপি পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ পিছন ফিরে আমাকে দেখেই ভয় পেয়ে যায় আরো। ভয় পেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে তার মুখ।
বলি—‘কী হয়েছে মা?’
মেয়ে কেঁদে ওঠে আর বলে—‘বাবা, টেবিলের ওপর থেকে পড়ে গিয়ে পৃথিবীটা ভেঙে গেছে।’
স্কচটেপ দিয়ে জোড়া লাগানো পৃথিবী এখন টেবিলের ওপর।
কাঠওয়ালা ঈশ্বর
‘কাঠওয়ালা, ও কাঠওয়ালা, বাড়ি আছ?’
‘কে? কী চাও?’
‘কাঠ চাই। খাট তৈরি করব। যীশু আরাম নেবে। ঈশ্বরপুত্র আমাদের প্রাণের যিশু।’
[কাঠওয়ালা ২৫টি তামার মুদ্রা গুনে নিলো]
‘কাঠওয়ালা, ও কাঠওয়ালা, বাড়ি আছ?’
‘কে? কী চাও?’
‘কাঠ চাই। ক্রুশ তৈরি করব। যিশুকে গাঁথব। শয়তানপুত্র আমাদের ঘৃণার্হ যিশু।’
[কাঠওয়ালা ২৫টি তামার মুদ্রা গুনে নিলো]
পাগলা ফুলের ঘ্রাণগান
হাটে হাটে সাপ খেলা দেখাতো সাপওয়ালা। নিজ থেকে লোকটা ছোবল খেতো। নাগিনীর খেলা। সুন্দরী নাগিনীর খেলা দেখতাম আমরা। দারুণ উত্তেজনা। আমাদের একটা হাত আর একটা হাতে ছোবল মারতো। আর সাপুড়ে বেশ বীরভাব নিয়ে সুন্দরী সাপের ছোবল খেয়ে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠতো। এসব বড় বড় স্মৃতি খুব ছোটবেলার।
বড় হওয়ার পর আরও কত খেলা দেখেছি, কত খেলা খেলেছি, শুনেছি কত খেলার কথা। এই যেমন, প্রজাপতি খেলা, মাছ-পুকুর খেলা, ইঁদুর-বিড়াল খেলা, যুদ্ধ-শান্তি খেলা, জন্ম-মৃত্য খেলা। বড়বেলার স্মৃতি বড়ই ছোট। প্রাণজুড়ে থাকে না, প্রাণ ভরে থাকে না। এসব খেলা প্রাণ কামড়ে ধরে থাকে। রক্তাক্ত করে। এসব খেলায় প্রাণ ঘেমে ওঠে, রক্ত কেঁপে ওঠে জ্বরে।
বিরাট ফুলবাগানের পাশে আমাদের ছোট বাড়ি। জানালা খুলতে ভয় পেতাম। কারণ, ওই বাগানের করবীগাছে প্রতিবছরই একটি করে পাগল ফুল ফুটতো। ওই পাগল ফুলের করুণ কান্না আমি সহ্য করতে পারতাম না।
ওই পাগল ফুল তার গানঘ্রাণ আমাকে দান করে চলে গেছে।
তুমি এক অনন্য শান্তির হরিণী
পৃথিবীর ভেতর তুমি এক অনন্য শান্তির হরিণী
গায়ে লেখা বিচিত্র শান্তির দাগ
আর আমি, এক ভয়ঙ্কর দাগ নিয়ে
পুরো শরীরজুড়ে তোমার কাছে হাজির হয়েছি এক বাঘ হয়ে
পৃথিবীর ভেতর তুমি এক অনন্য শান্তির হরিণী
দুঃখ আমার, তোমার জন্য হরিণ হতে পারিনি
তোমাকে সভয়হৃদয়ে ক্ষমা করে দিচ্ছি
একটা মাকড়সার জাল ছিঁড়ে ফেলেছিলাম আমি। তারপর অনুতপ্ত হয়ে মাকড়সার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে মনস্থ করি আর মাকড়সাটাকে সে কথা বলি। মাকড়সাটা আমাকে বলে—‘মাফ চাইছ ভাল কথা কিন্তু আমার পা ধরে তোমার মাফ চাইতে হবে না। তোমাকে আমি সভয়হৃদয়ে ক্ষমা করে দিচ্ছি।’ ‘পা ধরে মাফ না চাইলে স্বস্তি পাব না’ বলে আমি জোর করেই তার পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তার একটি পা ছিঁড়ে চলে আসে আমার হাতে।
বিয়ে
গতকাল একজন খুনি আমাকে হত্যা করতে এসেছিল।
সে আমার সাথে বসলো, হত্যা সর্ম্পকে অনেক আলোচনা করল, চা পান করলো।
লোকটা বেশ ভদ্র।
আমাকে বললো—‘আমি আপনাকে হত্যা করতে এসেছি,
হত্যা করলাম। আপনি বলুন, আমি খুন হলাম।’
আমি বললাম—‘আমি খুন হলাম।’
লোকটা রক্ত মাখা ছুরি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো—‘ধুয়ে নেবেন।’
সেদিন থেকে আমি খুন হয়ে আছি।
নিষ্ঠুর
বললাম—চললাম, আমাকে ফেরাও।
বললো—শুনলাম, যেতে চাইলে যাও।