মেঘমন্ত্র
আলস্য জাপটে স্বপ্নের মেখলা ছড়িয়ে পড়ে
বাজিকর নারীর কোমরে
অসময়ে বৃষ্টি আসে
জলমেঘ রূপের দিকে চোখ সরে যায়
শ্রাবণের পালিত কন্যা বৃষ্টির উপনাম
নিঃসঙ্গ যজ্ঞসূত্রে ওর পুষ্প কাঁপে শিহরণে
আদিবাসী গ্রাম, হাঁটা পথের ধারে বিরানে
(রজঃগুণে এই রয়ানি কালে)
কাছে ছিল তার গ্রীষ্ম বাতাস
এলো চুল, ধূলি ঝড়, দমকা হাওয়ার দল
ব্যাগ ভর্তি স্কুল বই
লাফিয়ে লাফিয়ে চলা মৃদু খরগোশ
অকৃতদার স্মৃতিরেণু তাকে ছুঁয়ে গায়
গেরস্থ গলায় ঐকাহিক অভিধান।
শরৎ সন্ধ্যার ভয়
এই মাত্রই দেখা এই মাত্রই জানলাম
এতো নয়, এখনো চোখ তুলে তাকালেই
অর্থ যোগ করে অর্থ যোগ হয়—
রহস্যময় ; চুলে ঝড়, আবছা জলের রঙে চোখ
স্মরণ হয় নতুন করে
যেন ভাষা ছিল কী?—হাসি, কথায়
ভূমিহীন মেঘের আস্তর, বৃষ্টির ঘর
শূন্যলতা জড়ানো পা… মধুর মিথ্যা সময়
নিশি ডাক
মধ্য রাত; হেমন্ত বাতাস নতুন এসেছে তল্লাটে।
বন্ধু রাস্তাগুলো নিয়ে গল্প-গুজব সেরে
এইতো এলাম। এলোপাতাড়ি বৃক্ষমালার
জলজ আদর সংগ্রহ করা দূরের একটা পাখি
আনন্দ সংগীত গায়।
শুনে কপাটের তালা খুলে হাট করে দেই। বুঝি
কেউ ফিস ফিস করে দরজা খুলে দিতে বলে
ফিরলেও কে লুকিয়ে থাকে এ কোণায় ও কোণায়!
ডেকে নিয়ে যায়; রক্তে ঢেউ জাগে…
থিকথিকে আঁধারের বুড়ি রাত, কাকভোর,
প্রায়শ তটস্থ পা বের হয়ে যায় খিড়কি খুলে
বন্ধু রাস্তাগুলোর সাথে দেখা হলেই বুকের মাঝে
শেষ রাতে ডাকাত পড়া গেরস্থ বাড়ির হৈ-চিৎকার!
কোলাহলে ব্যস্ত হওয়ার আগে গল্প করা যাবে আজ।
যেন সুঘ্রাণ, জীবন থেকে সৌভাগ্য উড়ে যায়
পিতা তার সূত্র ধরে মাটিতে নামান
হারানো ঘুড়ি। অথবা পুত্রই এসেছে কাছে
বন্ধু যার দিয়েছে সন্ধান, অনির্দিষ্ট দুঃখে।
মুষ্ঠিতে নতুন আঙুল, ভিক্ষার চাল, কোমল রৌদ্র
পায়ে পায়ে ভীড়, স্বপ্ন থেকে দূরে
হারানো স্বপ্ন ঘুরপাক খায়—
না শোনা সংগীতে। বিস্মৃত মানুষের নাম
যেন সুঘ্রাণ, জীবন থেকে সৌভাগ্য উড়ে যায়!
বনস্পতি মন ফিরে ফিরে পায় তামাদি খামার
পুরানা সন্ধ্যায়, ক্ষেত্রদেবীর রূপে।
চিত্র প্রদর্শনী
মনে করো, এটি একটি ছবি। বড় শিরীষ গাছ রহস্যময় ছায়া ফেলে
আমিনাবাদের দিকে নড়ছে বাতাসে। দক্ষিণ দিক তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত বসতিহীন।
গ্রামে পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পের চেয়েও বড় একটা মাঠ জোৎস্নায় থৈ থৈ। নির্জন।
পৌনে ন’টার দিকে ধুলট ফসলে ভরা ক্ষেতের আলপথে দু’জন তোমার বাড়ি যাই।
অপু বিশ্বাসের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী তুমি, মনমোহিনী।
চাঁদপুর থেকে সন্ধ্যার শেষ ট্রেনের হুইসেল কান্নার শব্দ হয়ে দূরে মুছে যায়।
সেবার লঞ্চে বাড়ি ফিরে যাওয়ার রাতে কত কী ভেবেছি।
সদা সতর্ক, আতঙ্কিত বুনো চোখ প্রেমিকের মুখে স্থির হলে
শান্ত কাজল দিঘি সন্ধ্যার মমতায় ভেসে উঠে নাগরিক অবিশ্বাস মুছে দেয়।
সন্ধ্যা
জমিয়ে রেখেছি পরে দেখব বলে,
পরে দেখা হবে। আজ এই বিকেলের সোনালি মেঘের রঙ
তোমার কাছে পৌঁছে চলে যাবো।
মনে হয় মৃত্যুও কাম্য কিছু নয়, প্রাণের উত্তাপ ছেড়ে
চলে যাবে কেউ। আশাহীন অভিমানে
এমন কি হেমন্তের শিশিরও কিছু বলবে না ডেকে।
দীর্ঘশ্বাস মথিত এই উদ্যানে বিকেলে কে হেঁটে যায়
ঔষধি পদক্ষেপে বিষণ্ন প্রবীণ গাছের হেলে পড়া ছায়ায়!
ঘ্রাণে ঘ্রাণে পুষ্প হাসে। রূপের পাশে দুঃখী চন্দ্র।
আলগোছে মনের শুকনো নালায় নালায়
শিস কেটে উড়ে উড়ে যায়। সেও কি তোমাকে চেনে!
সে কি জানাবে কিছু তবু অজানা সংযোজনে? সন্ধ্যায় সন্ধ্যায়
বিপন্ন আলো হবে আরো একাকীত্ব বিধুর নিঃশ্বাসের সমান!
এক বর্ষা সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটের ঘটনা
বারান্দা ছেড়ে ছোট্ট নর্দমা সৌখিন এক লাফে পার হয়ে—
শেষ-মেশ একটি রিকশা পেয়ে গেল মেয়েটি;
আঁধার বৃষ্টির সন্ধ্যা। মাঝপথে ক’ফোটা বৃষ্টি ধন্য হলো
তাকে ছুঁতে পেরে!
পিছে ভূত-চোখে চেয়ে আছে মুগ্ধ আজিজ মার্কেট
দোকানের বইগুলো সুখে আছে আজ,
জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে র্যাকে।
ঝড়-বর্ষার রাত, শাহবাগে বন্ধুরা কেউ নেই।
মেসে ফিরে যেতে আজ ভয়ঙ্কর ম্যানহোল,
গোড়ালি ডোবা নর্দমা-চুপচুপে ভেজা শার্ট-পাজামা
প্রথমেই সিগ্রেটসহ চা,
মায়া হবে নিঃসঙ্গ আজিজ মার্কেট
একটি রিকশা শেষ-মেশ পেয়ে গেল মেয়েটি
যে এই অপূর্ব রঙিন বর্ষা সন্ধ্যায়
তাকে লেক সার্কাস নিয়ে যেতে রাজি।
নিঃসঙ্গ শিশুর প্রতি
এই নিদারুন নাগরিক শোকে তুমি ছুঁয়ে থাকো পাখি মা।
চঞ্চু বাড়িয়ে দাও। চোখ মুছে দাও।
কণ্ঠে দাও চুমুর আনন্দ ভরা পিপাসার নিবারণ।
তুমি উড়ে, পাখা ঝাপটায়ে উড়ে- দ্রুত ফিরে আসো আমার কাছে;
আমার কান্না শোন পাখি মা।
তোমার ভালোবাসা ছাড়া পরিচিত কিছু নেই।
বাড়ির মধ্যে একটা অচেনা ফুলগাছ
সন্ধ্যা বেলার বৃষ্টিচ্ছটা মুখে, বাতাস উড়ায় ভুল
ক্ষরস্রোতা খালে এক হাতলের দোদুল্যমান সাঁকো
গোড়ালি ডোবা নতুন পানি, পেরিয়ে গিয়েও তাকে মনে রাখো
পা-পিছলানো কাদা, আমি এই গ্রামেই থাকি। পুরানো বাড়ির ঝোঁপে
একটা বন মোরগের বাসা, তার দিকে চোখ রাখি
আর, এহেন বর্ষায় অনাগ্রহী ময়ূরটিকে দেখে মনে পড়ে—
বাড়ির মধ্যে একটা অচেনা ফুলগাছ ;
সবুজ ময়ূরী শত্রু ভেবে যাকে ভয় দেখায়
আর, শীত-হেমন্ত আসার আগে তোমার কাছে পৌঁছতে বাকি।
বেগুনি ফুলের রঙে তরুণী উপাসিকা
ছোট্ট গেরস্থ অগ্নি ঘিরে বেগুনি
ফুলের রঙে ফুটেছিলো তরুণী উপাসিকা
পুরানো পৃথিবীর ধর্মকথা সজ্জিত জীবন তার বুঝিনি;
— যেনো কখনো ফুল নয়—প্রাচীন ভারতের অচেনা গ্রামে
আজগুবি ফুল কিংবা, একটিও চিনি না এমন জংলি বাগানের
বিষণœ চোখের মালি, সম্মিলিত ঘ্রাণে মাখামাখি
ব্যাকরণহীন নাজুক হৃদয়ের দেশে
স্নেহময় বাতাসের মতো মেয়ে বুকে
বৈজ্ঞানিক আলোর ঝলকানি, দুর্বোধ্য মমতায়
ফিরে পেতে চায় ঈশ্বরের সমান বয়সী আদিম পাহাড়
অভিজ্ঞ বৃক্ষের ইতিহাস ওড়া পরিবেশ কথা দেয়—
তোমাকে ঈশ্বর করে, তোমাকে অগ্নি—কুসংস্কার
মেনে নেব।
উৎসর্গের ভৌতিক রাতে তোমাকে অর্ঘ্য দেব
যে দুর্যোগ রাতে কেবলই স্বজন হারানো, কেবলই—
নিসঃঙ্গতার নিঃশ্বাস
ঈশান কোণের মেঘ চোখ মুছে দ্রুত উড়ে যায়
প্রাত্যহিক পায়ের শব্দ ভ্রমণসঙ্গী ও বিকেল বেলার অস্বস্তি
সূর্য ডোবার আগে আগে কানা গলির শেষ মাথায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে
রাস্তায় জমে থাকা তিরতিরে জল ও গোপন পলক শুধু
এ খবর জেনে সমব্যথী হয়। বুক-ভারি ঈশান কোণের মেঘ চোখ মুছে
দ্রুত উড়ে যায়। কু-লী পাকায় এবং মিশে যায় অস্তিত্বহীন রাতের অন্ধকারে
– যেন, ফেরত আসা চিঠি। উদ্ভিদহীন বালুচরে রোদে খাক তামাটে-ত্বক জেলে!
বহু নদীর পলিমাখা পুরানো মাছ, ব্যস্ত হাতে টানানো রশিতে উল্টানো।
টুপটাপ ঝরে পড়ে- নোনাজল, সাথে আঁশটে গন্ধ, ঢেউয়ের স্মৃতি…
নারী মাকড়সা
আমাকে ফুসলে যে এই পাহাড়ী-জংলা-শহরে নিয়ে এসেছে
সে আসলে এক নারী মাকড়সা। পরে তার ছড়ানো ছিটানো গোপন ও প্রকাশ্য
পাতা জাল দেখে বুঝেছি।
যদিও ততক্ষণে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি কোলাহল থেকে
সত্যি বলতে কি অনেক কথাও বলে ফেলেছি।
- আদিম ফুলের জংলায়: ফয়সল নোই, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, প্রকাশক: বাংলা বই, পরিবেশক: প্লাটফর্ম, মূল্য: ১৫০ টাকা