আত্মহত্যার অভিলাষ
একদিন আত্মহত্যা করবো—
আমার মায়ের কবর ফুঁড়ে মাথা উচু করে দাঁড়াবে
এক কচি ডুমুর গাছ;
তার ডালে আনন্দে নাচবে ঠিকানাহারা এক ঘুঘু।
আমি নাচার আনন্দে নিজেকে খুন করে বসব একদিন
আমি বুনোঘুঘু হয়ে ফিরব মায়ের কাছে।
আমি একদিন আত্মহত্যা করবো—
বাবার ক্রন্দন কিংবা হাসিময় মুখ থাকবে না
বাবার শূন্য গোয়াল হয়ে উঠবে বিরানভূমি
তার আদরের ধানক্ষেত হবে এক পতিত জঙ্গল
আমি সেই জঙ্গলের বিছানায় ঘুমিয়ে রবো।
আমি বাবার মতো হাসব কিংবা কেঁদে হবো একাকার
আমি নিজেকে হত্যা করবো পরম যত্নে
গোয়ালের প্রিয় গরু হয়ে বাবার কাছে ফিরব।
একদিন আমি আত্মহত্যা করবো—
এই আমার গোপন অভিলাষ।
যখন আমার মৃত্যু হবে
যখন আমার মৃত্যু হবে,
ঘুমিয়ে থাকা দেহখানা নিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে
এগুবে একটা ভাড়াটে অ্যাম্বুলেন্স।
সাদা রঙের গাড়িটি ব্যস্ত হবে খুব
আমাকে নিয়ে পেরুবে সে পথের পরে পথ
হয়ত উৎসুক মানুষেরা কোথাও করবে কানাকানি
কে আছে ঘুমিয়ে, কার দেহ ফিরে যায় ভিটেমাটির বুকে।
যখন আমি জন্মেছিলাম সেদিন শ্রাবণের মধ্যরাত।
হয়ত আবারও কাঁদবে নিষ্পাপ আকাশ
বৃষ্টি হবে আমাদের টিনের চালে, বাঁশবাগানের পাতায় পাতায়
উঠোনের কোণে সজনে গাছটি জানান দেবে তার শোক
বুড়ো তালগাছটি হয়ত নুয়ে পড়বে কান্নায়।
এই নিদারুণ শহর, নিদারুণ মানুষের ঘোর
এখানে বেদনারা জেগে ওঠে দেয়ালজুড়ে।
এখানে মানুষেরা কেঁদে ওঠে সময়ে-অসময়ে
আমি মনে রাখব না এসবের কিছুই।
শহরের কোলাহল ছেড়ে ছুটব ভেজা মাটির টানে
দূর মাঠ থেকে ভেসে আসবে পচা ঘাসের ঘ্রাণ
আমাকে ডেকে ডেকে হয়রান হবে
কচুরিপানার কোনো এক কিশোরী ফুলটি।
হয়ত ঝোঁপের ধারে লুকিয়ে থাকা শালিকটি
ঝাপটাবে তার বিরহকাতর ডানা।
হয়ত ভয় পাবে দুরন্ত চড়ুই-
ডোবা জলে থমকে থাকবে কারও গৃহের রাঁজহাস।
যখন আমার মৃত্যু হবে
ডেকে উঠবে বাবার গোয়ালের আদুরে গরুগুলো।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মা আমার
হয়ত ঠাঁই দাঁড়িয়ে রবে বাড়ি ফেরার পথে।
আমার ফিরে আসার খবরে বাবা আমার
উঠে দাঁড়াবেন সাধের ধানক্ষেত থেকে
কাদামাখা শরীরে বাবা রওয়ানা দেবেন বাড়ির পথে
সূর্যের সোনালি আলোয় হয়ত চকচক করে উঠবে
বাবার চোখে লুকিয়ে থাকা গভীর জলের নদীটি।
আমি ভুলে যাব সব, মনে রবে না কিছুই।
আমি নির্ঝঞ্ঝাট ঘুমিয়ে রবো ভেজা মাটির বিছানায়।
যখন আমার মৃত্যু হবে
হয়ত সাদা পাথরের এপিটাফে খোদাই রবে
এক ব্যর্থ মানুষের নিদারুণ ইতিহাস।
কালঘুম
ঘুমিয়ে পড়ো নীরবে—
এখন ঘুমিয়ে পড়ার সময়
মনে রেখো না কিছুই—
বুকের গহিনে কে লাগিয়ে গেছে বিষের চারা!
কার দখলে হৃদয়ের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল
কার ইশারায় হলে তুমি ফেরারি?
মনে রেখো না এসবের কিছুই—
ঘুমিয়ে পড়ো বন্ধু নীরবে
এখন ঘুমিয়ে পড়ার সময়।
জাগাতে এলে কেউ, চিরঘুম ভাঙিও না আর
বুকের সিন্ধুকে লুকিয়ে রাখা দুঃখগুলো
শ্বেত পায়রা হলে উড়িয়ে নিও
একদিন শিশির ভেজা সন্ধ্যায়—
তার চিতায় একটা প্রেমিককে পুড়িয়ে দিও।
তুমি চুপ থেকো, কেউ না জানুক
আর্তনাদের কী যে করুণ সুর
বাজে বুকে অহর্নিশ।
কবেই দখলে গেছে তোমার হৃদয় পলিমাটি
অভিমানে কাউকে জানিও না সে খবর।
তুমি চুপ থেকো শুধু তার সুখের প্রয়োজনে
তুমি চুপ থেকো বোবা ব্যথায়, চাপা কান্নায়!
চুপ থেকো বন্ধু—
এখন ঘুমিয়ে পড়ার সময়
তুমি ঘুমিয়ে পড়ো নীরবে।