বাল্যকাল
বাল্যকালে অনেক মানুষেরই চিঠি লেখার অভ্যাস থাকে
হতাহত ক্ষুধার পোশাক নিয়ে লিখে দেয় নিয়ম মাফিক দিন
আড়ালে অতি যত্নে তুলে রাখে ভরপুর রোদ্দুর
কিংবা সোহাগী সন্ধ্যার মোলায়েম স্পর্শ।
করুণ কপাট খুলে আলিঙ্গন করে পতিত রাতের সুরত
যেন আগামি কোনো শীতে আকিকা হবে তার—
বাল্যকালে কোনো পত্র লেখকের সাথে দেখা হয়নি আমার;
এমন কি যাদুর বালিশেও মাথা রাখিনি কোনো রাতে
হাত ভরতি ভাংগতি ঘুম নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম পুরো গ্রাম
আবার দূর থেকে নিজস্ব এসব ঘূর্ণি দেখতাম
যেন নিজেকেই নিজে খাচ্ছি সকাল-বিকাল;
তবু বিস্তর ফারাক থাকতো আমার আর আমার মধ্যে
নিজেকেই নিজে লিখতাম, অথই ব্যথার বাদ্য—
অজানা খদ্দেরের হাতে তুলে দিতাম দিন
অনাথ আলোর কাছে বৈশাখী অসুখ।
সেসব নত হওয়ার দিন চলে গেছে
অবাধ নাচে গ্রহান্তরিত হয়েছে অবাক পত্র-সকল
বাকী ঘৃণায় জপ্টে আছে বাহারি ঠোঁট বিহার—
রঙের কুঠারে তবু থেকে গেছে আম বাগানের দুপুর,
বালক বেলার ঘোষিকারা প্রচারিত আছে
শুয়ে থাকা নদীর বাহুদেশে—
বাল্যকালে সব মানুষেরই একটা রেডিও থাকে;
নিয়ম করে খুশবু ছড়ায় কোলে-পিঠে—
বাল্যকালে অনেক মানুষেরই খুন হওয়ার অভ্যাস থাকে…
আঙুলের প্রেম
বাতাবী লেবুর মতোন সুন্দর তুমি। শরীরে কোর্মার তেজ। ঠোঁট জুড়ে নাচের ক্লাস। চৌদিকে ফুটছে কান্নার মই। শুক্রবারের মমি হাতে অতি অস্থির। ধুলো ও পথের মধ্যিখানে স্বতন্ত্র মন—ছুটছো উজান বৈঠায়। কোথাও নেই আমাদের বৃদ্ধা সময়ের ছবি। কেবল বিধবা বাদ্য বাজছে হাটে। আমাদের দেখা হবে ফের—নোতুন কোনো লজ্জার হাটে। কুঞ্চিত শৈশব থেকে বিকিয়ে দিবো ছাড়ানো-ছিটানো দুপুর। নৃত্য পাগল সন্ধ্যা। আর বৃত্তান্ত মূখর সকাল। কোথাও কোনো ক্ষুধার ঘ্রাণ থাকবে না। আমরা পকেট বোজাই ইচ্ছা নিয়ে ফুটপাতে বসে যাবো সহোদরা থালার মতোন। যেন কাছাকাছি কোনো সেতার গুরু ডাকছেন আমাদের।
উপযুক্ত চোখ পেলেই ছুটে যাবো দরজায়। ফুটফুটে অন্ধকারে খুঁজে নিবো পরস্পর দূরত্ব। আলোর অপেক্ষায় ভরপুর ঢেউ কাঁধে ছুটেছি তুমুল…
আতর
গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ, পুরো অরণ্য—
কোথায় পুড়ছো তুমি?
আমাকে দেখো
ভিজে সবুজের মতোন হেঁটে যাচ্ছি
কবরের গভীরে!
মস্তিষ্কে অবাক ক্ষত
আড়ালের ফুটপাতে ভুল—
ওগো মিহি চুমুর সন্ধ্যা
আমার কবরে ফুল হয়ে যাও
পতিত চিন্তার মই জুড়ে লিখে দাও
সত্য বাহিত মন্দের মুখছবি
চুপচাপ শুয়ে থাকি আঁকাআঁকির চাদরে;
নাকের অভ্যন্তরে মমির জাহাজ
আমাকেও নিয়ে যাচ্ছে ভোরে
অন্তহীন যাত্রায় তুমিও থাকো
আমিও পুড়ে যাই কিছুটা
সরল সুগন্ধিতে ভরে উঠুক আমার দরিদ্র কবর!
চশমা
পৃথিবী থেকে সুখতারা দেখা যায়
মনের মাঝে থাকা তোমাকে দেখা যায় না
তুমি সুখের অসুখে থাকো
নাকি অসুখের সুখে থাকো
কোথায় খুঁজবো আমাকে; তোমাকে ছাড়া—
দূর থেকে আকাশ দেখা যায়
কিংবা
যাদুর নোট খেলে বিস্তর
উড়ে উড়ে মিলে যায় নীলে…
সুখ
অসুখ
দেখা যায় না কিছু;
জমজ অন্ধকারে ডুবে থাকো তুমি!
কাছাকাছি পথে পরিষ্কার মৃত্যু দেখা যায়
দোলনায় নেচে ওঠে উৎসব
আমাদের ব্যথা দেখা যায় না
চিন্তার সবুজে লেপ্টে থাকে জ্যোৎস্না
বেহুলা বোশেখ অঙ্গার হয়ে যায় ।
মেগাসিটির ক্ষুধা
মা জানেন মেগাসিটিতে ধুলো মেখে বসে আছে এক কিশোর
যার থুতনির নিচে জমে আছে পিনপতন গ্রাম,
নতুন পোশাকের ঈদ
কিংবা
লক্ষ্মীপূজার যাত্রা, বিস্তর সংলাপ।
মায়ের শাড়ি জানে, বাইবেল রেখে মৃত্যুর কাছাকাছি শুয়ে আছে দিন
কোরআন-হাদিস নিয়ে ঘুম ভেসে যায়; দূরত্বের মেঘে—
মা জানেন ইশকুল ফেরত রোজিনা’র কলম ছাড়া জীবনের উচ্ছ্বাস,
আমি শহুরে বাঘ;
দাঁতহীন থাবায় লজ্জিত হই,
পড়শিরাও গোপনে বলে নখহীন উল্লাসের ফসফরাস।
মা জানেন কলুইয়ের নাক জুড়ে রঙিন বিকেল—
সূর্যেরা ঘরে ফিরে যায় একা;
হুতুমের পাখনায় রেইনট্রি দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরের চারপাশ।
ধুলোর উঠোনে ইশকুল ছিঁড়ে নিজস্বী বানাই—
গাছে গাছে লিখে দিই তাজা ভাতের ক্ষুধা
মর্দ কোরাসের না’ত।
মা জানেন মধ্যরাতে পোশাক খুলে হারাই আমি
নিজের কাছে, মায়ের কাছে নত হই—
নিমগ্ন হই পাইক-প্যাদাহীন পাথুরে পথে।
পেটের পাটাতনে মা ও আমি লিখে রাখি সময়ের ঘষামাজা
হাতের রাতে রেখে দিই শখের জীবন।
কাস্তে হাতে নেমে যাই নিজস্ব খতিয়ানে;
ডবস্তর ফুটপাত,
আড়ালের কোলাহল
কেটে কেটে ক্লান্ত সবাই…
মা ও আমি; আমি ও মা—রসের আগুনে যতো পুস্তানি গুছাই
তার কোনো পৃষ্ঠায়ই ‘তুমি’র মুখছবি থাকে না।
উজ্জ্বল উচ্ছ্বল রচনা সমগ্রে গোছানো নিদ্রায়
প্রবাহিত হয় মা—কেবল মা;
কেবল একখণ্ড শহুরে কিশোরমুখ!
রমণীয়
রাত-দিন কেবলই অসুখের সাথে দেখা হয়
আবাসন সংকটে থাকা অসুখ
আমার বাড়ির পথ জানতে চায়
হাসি-ঠাট্টায় এড়িয়ে যাই।
ভুলভাল কিছু বলে ছিন্নভিন্ন যন্ত্রণা
লুকিয়ে রাখি।
মগজের হাতকড়া খুলে উহ্য হই;
আবার ভ্রম বিক্রি করে নতুন খদ্দের খুঁজি—
মুহূর্তের জন্যও মনে থাকে না
আমিও অসুখ
ভাগাভাগি করে বেঁচে আছি বহুকাল…
সহ্যের কৌটায় নিজেকে নিয়ে ঘুরি
ধুলো-বালি, মখমলের শান দেওয়া দিন
হাতে থাকে আরো অনেক খুচরো মাজার ;
কোথাও কোথাও এমন সব খাল-বিল সামনে এসে যায় যে
মনে হয় তুমুল ঘৃণায় গোসলে নেমে যাই,
ইচ্ছে মতো ডুবাডুবি করে মুখে হাসির পেলব মাখিয়ে রাখি…
মালিক বিহীন শীতের মতো শাদা হয়ে উঠি
ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জুতোর মতো হেঁটে যাই
শান্তির নৌকা পর্যন্ত—
কোথাও বিড়াল ফোটে না
রঙে রঙে ফর্সা হয়ে ওঠে ওষুধের ঘুম;
কেবল অসুখ—সুখের চারপাশে জড়িয়ে থাকে, নির্ঘুম।
ভাগাভাগি হয় না কোনো বেহুশ…
নজরুল ও সরকার বিষয়ক
সে ফোন রাখার পরপরই আমি শাহবাগ গেলাম। আজিজ সুপার মার্কেট, যাদুঘর, ছবিরহাট, টিএসসি ঘুরে কাঁটবন চলে এলাম। ভাবলাম ভুল করে তুমি ঢুকে গেছো হাকিম চত্বর। আবার উল্টোপথে নীলক্ষেত হয়ে কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, হাকিম চত্বর হয়ে নিজের দিকেই হাঁটতে লাগলাম। কোথা থেকে উদ্ভ্রান্ত নজরুল এলো। চোখ বাঁকিয়ে বললো, ‘চল আমরা দুজন একই কবরে ঢুকে যাই।’
ভাবলাম কথাটা মন্দ না। তবে তার আগে আর একবার খুঁজে দেখা যাক। নজরুল বললো, ‘আমিও তোমার সাথে যাবো।’ আমি না করলাম না। তাকে ‘সে’ বিষয়ক গদ্য থেকে এক আজলা পাঠ করে শুনালাম। নজরুল কোনো উত্তর করলো না। আমাদের ‘সে’ ছাড়াও আরো হাবিজাবি কথা হতে থাকলো। দেশ-রাজনীতি-মুক্তি ও রবীন্দ্রনাথের বিছানা পর্যন্ত। আমাদের আলোচনায় সরকার প্রধানের সৌন্দর্যও বাদ গেলো না। মনে হলো এটা কোনো সংসদীয় বৈঠক! আমি কৌতুহলি হয়ে নজরুলের কাছে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কিছু প্রশ্ন করতে চাইলাম কিন্তু সে ঘোরগ্রস্থ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে সরকার বিষয়ক আলোচনায়ই সাচ্ছন্দবোধ করছেন। আমি কোনো ক্রমেই তাকে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামাতে পারলাম না। অকারণেই ভীষণ কান্না পেতে লাগলো। দেয়ালে দেয়ালে লেপ্টে যাচ্ছিলো কান্না। সে এবং তার মুখ। বিবিধ ফোনালাপ। সংকোচে নজরুলের কাঁধে হাত রাখলাম। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম, মাঝ রাতে কান্না পেলে আপনি কি করেন?
প্রেমিকের ভাষা
প্রেমিকের কোনো নিজস্ব ভাষা নেই
নেই কোনো কাঁটাতারের ফ্রেম
সে পাখির মতো উড়ে
উড়তে উড়তে নিজেকে ছাড়িয়ে যায়
নিজের থেকেও হারিয়ে যায় কখনো কখনো;
আবার ফিরে আসে ভালোবাসার কাছে
সে ভালোবাসার ভাষায় কথা বলে।
দূরবীন দিয়েও তুমি খুঁজে পাবে না তার চোখ
সে শুয়ে থাকে, বসে কিংবা দৌড়াতে থাকে
রোদ্দুর, শোক কিংবা কবরের পাশে
কোথাও স্থির থাকে না; চলে যায় উড়ে
নিজস্ব গন্তব্যে।
প্রেমিকের কোনো দেশ নেই
নেই কোনো পাসপোর্ট, নেই নিজস্ব ভাষা,
সে ভালোবাসার ভাষায় কথা বলে
কোনো সীমানা আটকাতে পারে না তাকে
চোখ, নিমগ্নতা এবং রহস্য ঘিরে থাকে সে
তার কাছে পৌঁছে যাওয়ার ছাড়া আর কোনো পরিভাষা নেই
সবখানে সে একই ভাষায় কথা বলে
সব দেশে প্রেমিকের ভাষা এক এবং অভিন্ন
সবখানে সে ভালোবাসার ভাষায় কথা বলে…
শীতের অভিষেক পর্ব
বিছিন্ন দ্বীপের মতোন সেজেগুজে বসে আছো
গুল্মলতা, সমুদ্র, অস্থিরতা বেষ্টিত হয়ে।
তোমার নিমগ্নতার ছুরি অনবরত কেটে যাচ্ছে
চিন্তার পরিচ্ছেদ;
আর যত অমবস্যার যতিচিহ্নে জপ্টে ছিল
রোদবাহিত তৃষ্ণার ফটোগ্রাফ
তাদের মুখছবি লেপ্টে আছে চোখের অপর পৃষ্ঠায়।
তুমি বসে আছো; সুখবর জড়ানো হাড়গোড় নিয়ে
মযূর লিপ্সা ছুঁতে পারেনি তোমাকে
অবিরাম হাঁটছো কান থেকে কার্তিকের উৎসবে।
চেনাজানা মন্তর গড়িয়ে নামছে শীত
অবুঝ কোর্তায় আটকে রেখেছি সয়ম্বরার অসুখ
যেন পরিপাটি কোনো দুঃখ বাড়ৈ দৌড়ে পালাচ্ছে হাটে—
আবার ফিরে আসছে; ক্লান্ত শব্দের মতোন
রাতের হাটু অব্দি শুয়ে গেছে টানটান।
ওই যুগে বসে থাকো চুপচাপ—
লেপ্টানো ক্ষুধায় তোমার নাম খোদাই হচ্ছে।
আমিও মিইয়ে যাচ্ছি নতুন কোনো দ্বীপে…
ক্ষুধা
তোমাকে ছুঁয়ে ফেলার বেদনা লেপ্টে থাকে শরীরে,
বিস্তৃত বিভ্রম ও মন্থর মহল্লায় কবুলের গর্গল হাঁটে
উজ্জ্বল দুপুরের ধ্বংসাবশেষ প্রবাহিত হয় সন্ধ্যা অবদি
থইথই করে ডাক দেয় তুমুল অন্ধার
শতাব্দীর রোগশয্যা থেকে বেখেয়ালে কেঁদে ওঠে কেউ।
কে ? মুসকিলের লজেন্স মুখে হাসি ভাসে
অস্থির তুফান ছুটে শিশির মগ্ন শীতের বাগানে
আমার মগজে তুমি; আলো বহুল মুদ্রিত হাততালি
রহস্যমুখে ডুবে যায় নির্লোভ—অসহ্য মন্ত্রণা আহার।
নেশাতুর সন্ধ্যা; রাত্তিরে ফোঁপানো মিথ্যায়
ঢেকে যায় বিস্ময় কোরাস। আলেয়ার মুকুট ভয়ে
নুয়ে আসে লাঙলের কফিন। রাত শেষে
কথাকাতর স্পর্শ আবার সয়লাব হয়ে যাবে?
ডুবিয়ে দিতে উহ্য নাবালক; উল্টানো খই ফুলের
নিবেদিত কিশোরী মুখ—ক্ষুধার্ত বাতাসে ভাসাবে পরম।
লেপ্টে থাকো কৌরবালিঙ্গন, সংগ্রহ ছুতায় চুপচাপ প্রচারিত হও;
ব্যথাসুখের তন্দ্রাগ্রস্ত অসুখে সজ্জিত করি নিখুঁত চুমুদল।