আগুন অর্কেস্ট্রা
আগুন কি স্বয়ংক্রিয়, নিজে থেকে লেলিহান শিখা
নাকি কুণ্ডলীকৃত হিস্হিস্ গন্ধ-উৎসুক কেরোসিন
কিংবা পেট্রোলভূক দাউ-দাউ ছড়িয়ে পড়া উন্মত্ত বিকার এবং
প্রখর সময়জ্ঞান যার—কাক-ডাকা ভোরে বঙ্গবাজারের সহস্র
বস্ত্রবিতানে সোল্লাসে ছড়িয়ে পড়ে অর্কেস্ট্রা তার!
নিজে থেকে লাগে, না কেউ লাগায় তাকে?
নিরুত্তর সে প্রশ্নের ঝড় শান্ত হবার আগে বকেয়ায় কিনে আনা
কাপড়ের স্তূপ পুড়ে ছাই স্বপ্নীল ঈদের বাজার—
ঠাসাঠাসি দোকানগুলোর ভেতর নেই এতটুকু অবকাশ,
নিয়তি-নির্ধারিত অগ্নিসংহার, ‘হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে’
কপালের লিখন সঁপে দিয়ে বাণিজ্যে মাতোয়ারা ছোট পুঁজির দোকানদার
এবার হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদে! চোখের জল পর্যাপ্ত নয় অগ্নি নির্বাপণে;
ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো বিপদসংকেত বাজাতে বাজাতে আসে
হোস পাইপ জল ছুড়ে মারে অনেক উচ্চতায়, আগুনের নাগাল পাওয়া
কি সাধ্য তার—বহুতল ভবনের শীর্ষ স্পর্শ করা আত্মগরিমা যার!
আর এত জল কোত্থেকে পাবে—জলাশয় ভরাট করে ফেলা
রাজধানীর পাষাণ বুকে। রাস্তার পাশে নেই কোনো হাইড্রান্ট।
হেলিকপ্টারের পুচ্ছদেশে নড়ে জলের বালতি
ক্ষুধার্ত আগুনের মুখে মাত্র কয়েক ফোঁটা সান্ত্বনার বারি অপচয়…
আহা, ধ্বংসের কী অপরূপ লীলা! যে-ঐকতানে লাল-হরিদ্রাভ
আগুনের শিখা অপ্রতিরোধ্য উল্লাসে দগ্ধ করে সহস্র দোকান
কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাতাসে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রিলে-রেসের মতো
ছড়িয়ে দেয় মানুষের উদ্ধারচেষ্টা পরিহাস ক’রে—
পোড়া কাপড়ের ঘ্রাণ, গতরাত ক্যাশবাক্সে রেখে যাওয়া টাকা
পুঞ্জীভূত স্বপ্নের ছাই শত শত নিঃস্ব পরিবার এক লহমায়
বুঝে ওঠার আগে কোনো কিছু, ‘কোথায় দাঁড়াব আমরা
আমাদের তো হাতে আর কিছু নাই!’
আগুন ছড়িয়ে পড়ে বারো হাজার মাইল দূরে
আমার চোখের রেটিনায়, গভীর নিশুতি রাত ঘুম নাই
ভাবি, আমি কি পাঠাতে পারি উত্তর গোলার্ধ হতে
পরাক্রান্ত মেঘবাহিনী ঝরে যেতে অঝোর ধারায়
নিরক্ষীয় জতুগৃহের বিনাশী ক্ষুধায়!
আগুনের মসনদ
ট্রেনের সারি সারি জানালায় আগুনের পর্দা লেলিহান শিখা
অকস্মাৎ ঢেকে দেয় বাংলার নিসর্গে স্থির-বিমুগ্ধ চোখ
দ্রুত অপসৃয়মান গতির রেখায়—
আগুনের পর্দা সারি সারি জানালায়
আকাশের বিপরীতে বাতাস-সংকুল ধোঁয়ার কুণ্ডলী
মানুষের আর্তনাদ—ক্ষমতার আস্বাদ পেতে
ট্রেনের কামরায় প্রস্তুত হচ্ছে মনুষ্য-কাবাব
আমাদের পঞ্চবার্ষিকী নির্বাচনি উৎসব!
‘স্ত্রী ও কন্যা পুড়ে ছাই, আমাকে আর কী
উদ্ধার করবেন ভাই, এই আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে
ওদের জন্য মসনদ সাজাই!’
মন ভয়েজার
রাত পার হচ্ছে স্থবির আমাকে রেখে
দূরে কোথাও ভ্রমণে গিয়ে আমার মন
আটকে পড়েছে কোনো গভীর খাঁদে;
যেভাবে ভয়েজার আমাদের সৌরমণ্ডল
ছেড়ে নিয়ন্ত্রণহীন চলেছে অন্য কোনো
সৌরমণ্ডলের দিকে—আমি যতই ডাকি না কেন
সাড়াশব্দ পাচ্ছি না কোনোভাবে।
যেসব কাজগুলো চিন্তায় সাধিত হয়ে আছে
মনেরই তো করণকৌশল সেসব প্রতিভাত হবে
বস্তুজগতের পরিধিতে, কিন্তু কীভাবে যদি
মন-ভয়েজার উদ্দেশ্যবিহীন দূরে চলে যেতে থাকে?
শৈশবে একবার নদীপথে উদাসী বাতাস
নিয়েছিল কেড়ে মন, ফিরে পেতে পেতে
আলোকবর্ষ কেটে গেল, কৈশোর গড়িয়ে এলো
জটাচুল কানের দু’পাশ ঢেকে—বটের ঝুরিগুলো যেভাবে
কাণ্ডের থেকে মূলের অভিপ্রায়ে ঢোকে মাটির ভিতর—
অংকের খাতায় স্বপ্নখেকো শব্দগুলো প্রোথিত হতে থাকে
কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠার অস্বস্তিতে কাতর বয়ঃসন্ধিকাল।
উড়ে চলেছে আবারও মন-ভয়েজার
যতভাবেই ডাকছি তাকে, পারছি না ফেরাতে দেহের মাঝে
ক্ষুদ্র দেহ কেমন করে ধরবে অসীম মন?
বয়স পেরিয়ে চুলে যখন লাগল রুপালি রঙ!