কাতারবন্দি বৃক্ষগুলো নত হচ্ছে। নত হচ্ছে পাখিসম্প্রদায়। আর—
মানুষের হৈ-হুল্লোড়ে কাঁপছে হৈমন্তি হাওয়া। কেউ ধ্বনি তোলে
ডাকছে তার প্রভুর নাম। যাদের কোনো প্রভু নেই,
কিংবা যারা এর আগে মেনে নেয়নি কালের দাসত্ব, তারাও
নত হচ্ছে মাটির কাছে, কেউ কেউ ছড়িয়ে দিচ্ছে অগ্নি-অনুরাগ।
মাটির সানকিতে খুব ভোরবেলা, যারা সাজিয়ে রেখেছিল
বিশ্বাসের তন্দ্রাস্বর, তারাও সূর্যের সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছে
ঘাটে। জল আর শালুকের মিলন দেখে কেউ কেউ ঢেউসূত্রে
আঁকছে প্রার্থনামুখী প্রেমিকার ছায়া।
যারা শৈব নয়, অথবা যারা তান্ত্রিক—
সমান্তরাল বৃক্ষের কাতারে তারাও হয়ে যাচ্ছে যোগী-যোগিনী
এবং পৃথিবীকে ডেকে বলছে; তুমিও বাজাও সহজিয়া সুর
শঙ্খের চিত্ততলে জড়ো হোক মানুষ—শুধুই মানুষ!
এখানে আর কোনো বিভাজন নেই। এই গ্রহালয়ে জীব
কিংবা জড়ের মুখোমুখি যে ক’টি তারা জেগে আছে
তারা সবাই খুলে দিচ্ছে নিজ নিজ ক্বলবের কোটরা
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে আয়ু,
. উড়ছে অগণিত গোলাপের নাম।
একদা কিছু শীতল বৃষ্টি ঢুকে পড়েছিল যে নামের মোকামে
সেখান থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসছে রুহের শিবত্ব
যারা এর আগে এই ব্রহ্মাণ্ডে ছিল, অথবা যারা আসবে বলে
রয়েছে প্রতীক্ষায়; তারাও পড়ছে সৌরচিত্রণের কাহিনী—
গলায় পরে নিচ্ছে চন্দন শোভিত রুদ্রাক্ষের মালা।
ঘোরের তপস্যাই মানুষের প্রথম এবং শেষ গন্তব্য—
কথাগুলো লেখা ছিল যে পর্দা ও পুরাণে,
নদীগুলো করছে এর অন্বেষণ। পুরাণের অষ্টাদশপর্ব
পাঠ শেষে ঋষি জেনে নিচ্ছেন তার নিয়তি।
বাকিগুলো পড়া শেষ করে বরাহ পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ
এবং পদ্ম পুরাণের পঞ্চান্ন হাজার স্লোকের ভেতর
জমে উঠছে মহাদেশের সকল বরফ, সকল আগুন
গভীর রাতের সাথে গড়ে তুলছে তার আদি সম্পর্ক।
‘সম্পর্ক’—তৃষ্ণার অন্য নাম।
আরও স্পষ্ট করে বলা যায় ঘুমার্ত চোখের আড়ালে
লুকিয়ে থাকে যে জ্যোতি, পিপাসায় কাতর হলে
মানুষ তা ছড়িয়ে দেয় গোটা পৃথিবীর শরীরে।
যে পৃথিবী একদিন ছিল অগণিত বৈরাগীর ভিটে,
যে ধরণী মাতৃহীন হয়ে অযুত বছর আগে শুধুই
খুঁজেছিল তার সন্তান। অবিশ্বাসগুলো সাজিয়েছিল স্তরে স্তরে।
সাধুরা সেই অবিশ্বাসের মন্ত্রগুলো জানতো। তাই;
তারাই এই বিশ্বনগরের নাম দিয়েছিল উদয়পুর।
বৈষ্ণব, মারেফত, তরিকত সকল তত্ত্বকে জমিয়ে রেখেছিল
মানব-ইল্লিনে। সিজ্জিনে গেলেও দেখা পাওয়া যাবে
কোনো বন্ধুর! এমন রস-রহস্য খুঁজে তারা ঠিক
করেছিল দ্বিতীয় মোরাক্বাবা।
নদীরা ধ্যানের অনুকূলে যে মায়া রেখে যায়,
মানুষ সেই মমত্বকেই ভাবে নিজেদের আখড়া।
জমে থাকে,জমিয়ে রাখে খুচরো আনা ও আমিত্ব—
তারপর তা ছড়িয়ে দেয় মাটিতে। তামার তন্ত্রগুলোকে
নিজের জীবন বিধান মেনে লিখতে চায় খণ্ড খণ্ড
ভূগোলের এপিটাফ।ছায়াগুচ্ছগুলো পাশে পাশে হাঁটে।