সময়
সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানো শূন্যতা শুধু।
এ এক শরীরী ভ্রমণ। দেহ থেকে দেহান্তরে, চক্রাকারে।
শূন্যতায় কোলাহল—বোবা অনুভূতি—দিনমান অস্থিরতা
শূন্যতায় ফিসফিস—কলকল ছলছল—স্বপ্নময় স্পর্শ।
একাগ্রতায়, আনমনে শুধু ঘুরিয়ে দেখানো নয় নিজেকে।
প্রতিবিম্ব অশরীরীর মতো চলমান।
অভিমান—অনুরাগ—ভালোবাসায় দীর্ঘ দিবস।
এ শুধু ভ্রমণ নয়। এক শরীরী যাপন।
মানুষ বা আত্মা বা শেষাবধি এ রকম কিছু
মানুষ মূলত দ্বিখণ্ডিত। আমি, আরশিতে প্রতিবিম্ব পড়ে যে আমার, সেই আমি এবং আমি। প্রবাহিত একটি নদীর দুটি শাখা। এক উৎস, তবে উৎসেই দ্বিভাজিত। বহমান দুটি স্রোতস্বিনী ঘুরতে ঘুরতে জনপদ, পাহাড়, অরণ্য, আকাশের নীলিমা, এইসব ছাড়িয়ে মিলে যায় এক স্থানে। অতঃপর মিলিত স্রোতের দ্বৈততা নিয়ে বয়ে যায় ভিন্ন নামে।
শরীর হলো কাঠামো। দুইটি নদীর। বহু পথ পরিক্রমায়, হাজার ইতিহাসের ভার কাঁধে প্লাবিত স্রোতকে গতিহীন করার নামই শরীর। বেগবান দুইটি নদীর সঙ্গম, পুরুষ বা নারীর রতিক্রিয়া নয়। এক ন্যাড়া পাহাড়। প্রাণশক্তিহীন। অসহায় কান্নার ঝরে পড়া জল। শরীর হলো অভিশাপ। শরীর মূলত ক্লীব। মানুষ বিপরীতে এর। দিব্য ও ঐহ্যিক সঙ্গমের মিলিত স্রোত। বাধার প্রাচীর পেরুনো একা এক ইন্দ্রজাল।
অরণ্যে মায়ামৃগ- দুই
আমি একটি নদীকে জানি। উচ্ছ্বল, আমার প্রেমিকা। তার সাথে যাবতীয় খুনসুটি আমাদের সান্নিধ্যকে নৈকট্য দেয়। রাত্রিময় স্বাপ্নিক অধ্যায় বোনা রূপালি শিশিরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঝিকমিক করে ওঠা ঔজ্জ্বল্যে পৌরাণিক কাহিনি জেগে ওঠে। আমি তার ওষ্ঠ চুম্বন করি। সামাজিক অহমিকার তপ্ততা ভ্রূকুটি করে তার ওষ্ঠ ভবিষ্যতের নির্ধারিত গন্তব্য জেনে আমার জ্বলন্ত মুখগহ্বরে যাত্রা করে। মাঝে খুব চুপচাপ, লাজুক, কখনো চুলে ইলিবিলি কেটে আদর করে।
আমি তার পৌরাণিক হৃদয় সাঁতরে বৈতরণী পার হওয়ার অপেক্ষায় ভালোবাসি।
দানবের মতো সূর্য চোখে, কখনো খুব নিঃসঙ্গ দাঁড়ায়। ভয়ের বর্শা এগিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে প্রিয়মুহূর্ত। আমি তার অসংখ্য লৌকিকতা থেকে খুব নিভৃত অনাড়ম্বর কিছু জানি। আমার শৈথিল্যে ক্লান্ত করে কি না জানা নেই। আলাদা অস্বচ্ছ ভূমিকায় তাকে জানি। সেই স্রোতস্বিনী, আমার প্রেমিকা।
ব্যক্তিগত
রাজা নয়, পারিষদ নয়। সামান্য বড়ে। চলাচল শুধু চৌষট্টি ঘরে। ডাইনে নয়, বাঁয়ে নয়, পেছনেও নয়, লক্ষ্য প্রতিপত্তিশালী পরিষদ দলের ভ্রূকুটি এড়িয়ে সীমাবদ্ধ চৌষট্টি ঘরে। সাদাকালো—যদিও সাধ থাকে আসমানি রঙে, নীলে। মরিচিকা—ভাঁড়ারে জমা শুধু করুণার রসদ।
ভেতরে অনন্ত গতি—পায়ে তবু গতি নেই। সীমানা ব্যাপৃত ছকবাঁধা এই আঁকানো ঘরে। চমৎকার, এই চলাচল, বদ্ধ পরিবেশে। দূরে বন্ধনমুক্তির ডাক। আরো এক প্রবল বন্ধনে, নারীরও অধিক কোমল পদতলে। লক্ষ্যভেদী এই চলাচল, সীমাবদ্ধতা, ভাসতে থাকে পথে।
কবিতা কিছুই বলে না
এভাবে জন্ম নিতে পারে একটি কবিতা
শস্যযভূমি ভরে যেতে পারে শব্দে—ছন্দে—অলঙ্কারে
যদি প্রশ্ন ছুড়ে দাও কিভাবে?
বলব না, কেননা—
কবিতা কিছুই বলে না, হয়ে ওঠে—
হয়ে উঠতে টানে না রমণীর শেমিজ
ছায়ার আড়ালে লুকানো মসৃণ তলপেট খাঁমচে খাঁমচে
হাঁটে না গোপন স্বপ্নে—শুধু হয়ে ওঠে।
যদি প্রশ্ন ছুড়ে দাও কিভাবে?
একজন পুরুষ অথবা নারী যেমন
নিজেকে সমর্পন করে হয়ে যায় আত্মার অংশ
টেলিফোনের তার চুইয়ে ঐশ্বরীয় বাণী ঢলে পড়ে কানে
স্তন থেকে গড়িয়ে দুধের ফোঁটা নামে শিশুর গালে
তেমনি মৃত মানুষের কফিনের পাশে
ইচ্ছার বলি হয়ে কবিতা শুয়ে থাকে
কিছুই বলে না, শুধু হয়ে ওঠে।
১ আগস্ট ২০০০
ব্রাত্যজনে কী কথা শোনালে সই বসন্তদিনে!
বন্ধুজনে প্রকাশিলে কিশোরীয বল্কল খুলে, খরতোয়া ভঙ্গিমায়Ñ
জমে ওঠা ঈদ-উদ্দীপনায়।
বাঞ্ছা ছিল, প্রকাশিব জলের স্বভাবে!
কী ছিল তোমার মনে, কব না সে কথা আজি এ বাদলদিনে, ভ্রমণে।
ভূতে ও ভবিষ্যে সেই প্রত্নছায়া এক উপচ্ছায়া হয়ে জাগ্রত পরাণে।
উড়ে উড়ে লিখে রাখা উত্তরে আজি পরাণ—বসন্ত দিনে, ছুঁয়ে;
রঙের উচ্ছ্বাসে কেঁপে, ঋণ বাড়ে উষ্ণ অন্তরঙ্গে; বাধ্যর্ক বুদ্বুদে।
শব
ঘুমের দূরত্বে শুয়ে। চলেছে চার বেহারার কাঁধে।
ধাক্কা বুঝি দিলো কেউ? ফেলে দেবে মুহূর্তেই
শ্মশানে, কবরগাহে…
একদেহ, দুহাত, দুপা, দুচোখে দেখার গভীরতা,
ভেতরে জমানো অন্ধকার অথই অপার।
পাঁচজনে একসঙ্গে একমুখি চুপিচুপি
বয়ে নেয় ভিন্ন চিন্তাস্রোতে।
রাত্রির আহ্বানে জেগে উঠে দ্যাখে—
হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেহ।
ফিরবে না। এইসব বাহকেরা ফিরে যাবে চেনা অধ্যায়ে,
আগুনের তাপ কমে এলে ওরা বিনিময়ে সংক্রমিত হবে
চক্রাকারে চার বেহারার কাঁধে।
করতলে তার মুখ
আমার ভেতরে প্লাবন। অবারিত স্বপ্নের বিস্ফোরন আপদমস্তক জুড়ে বয়ে চলে। কখনো প্লাবন। তার আমন্ত্রণলিপি বিলি হয়ে জাগায়। ব্যাখ্যাতীত, অবাধারিত, মুগ্ধ। দৃষ্টি চলে যায় গভীরে, ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া অবয়বহীন সবুজে। অতন্দ্র প্রহরী এখন, নিশিপাওয়া, দমকা হাওয়ায় নিভে যাওয়া দ্বীপশিখা। আমি অভ্রান্ত জেনে গুটিগুটি পায়ে মমতায় ছুঁই শৈশবমোড়ানো তার মুখ।
দেহের ভঙ্গিমার কাছে দুদণ্ড শান্তি, চুল তার কবেকার হাওয়ায় উড়ে যায় মেঘের আঙিনায়। আর ক্ষণিক মুহূর্তগুলো আগামীর শুশ্রুষা হয়ে ভেসে ওঠে ক্রমশ অন্ধকারে ধাবিত নদীর চর হয়ে।
প্রিয়তমেষু
এ ঘোর অরণ্য তীরে একা বসে ভাবে প্রেমদাসে।
প্রতিধ্বনি তুলে পাখি উড়ে যায় দূরের আকাশে।
প্রকাশিতে আজ তার বড় কৃপণতা—
মেঘের আড়ালে যথা ঢাকা পড়া চাঁদের কিরণ।
গোধিকা তালাশে গিয়ে ব্যাধবেশে, ব্যর্থ
ঘরে ফিরে ভাবে—
চকিতের ভ্রমে, পলকের ফাঁকে
পিঞ্জিরার পাখি উড়ে গেছে বুঝি সুদূরে, তিলকপুরে।
কী পাপে কল্পনাতাপে হইনু বন্দি ফাঁদে
আমি ব্যাধ আজি এ প্রবাসে।
করো অধিষ্ঠান দেবী, এ ভাঙা মন্দিরে—
মুক্তাবিন্দু হয়ে বেড়ে ওঠো ক্রমে আমার এই ঝিনুক শরীরে।
যেমতি ফুল্লরা যাপে মধুঋতু কালকেতুসনে অরণ্যনগরে।
আপাতত গ্রন্থের শেষ কবিতা
আমি ছাড়া নিমগ্ন পাঠক আর নেই আমার
ঘুলঘুলিতে আসে যে চড়াই প্রতিদিন
তার কাছে জেনেছি শীতের বার্তা।
দূর দেশে শিকারী নেমেছে, হাতে বন্দুক
জমিনে, আলেতে লেগে আছে রক্ত
সেইসব ফেলে আসা রাত্রিদিন
কারা যেন বলা নেই কওয়া নেই
লিখে দেয় সূর্য নেমে যাবে তার আগে আগে
প্রাকৃত ভাষার মতো হরফে হরফে।
প্রভু, আমি ছাড়া আমার আর কোনো পাঠক নেই
পাতায় পাতায় শুধু প্রশ্নবিদ্ধ বাতাস
সময়ের মতো ভারী। যাকে টেনে টেনে
নিঃশব্দে চলেছি অন্তহীন পথে। আমি ছাড়া আমার
আর কোনো নিমগ্ন পাঠক নেই। শাশ্বত সত্যের এই
সামনে দাঁড়িয়ে মন সব বোঝে।
বোঝে বৃন্দাবন দূরে নয়। বসে থেকে থেকে সময়
কাটাবার মতো অবসর পাওয়া যাবে
তারাদের মতো হেঁটে হেঁটে আকাশ পাড়ি দেবার
স্বপ্ন গেঁথে দেবো বালিকার স্লেট-পেন্সিলে যেদিন।
তুমি ছাড়া আমার আর কোনো নিমগ্ন পাঠিকা নেই
তোমার কাছেই জমা রেখেছিলাম আমাদের প্রস্তাবিত শিশুর হাসি।