পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে আমি ক্ষমা করে দিলাম আর যে সমস্ত মানুষের অভিযোগ আছে আমার দিকে তাদের ক্ষমা নিতে চাই না। নিজের ভেতর যে কাঠগড়া আছে তার ওপর দাঁড়াব…
তুমি তোমার চুলের স্বাধীনতার কথা বলছ আর আকাশ জরিপ করে এসে আমি কান দুটোতে গুঁজে নিয়েছি চামচিকা আর বাদুড়ের লতানো ডানা। তোমার চোখের স্বাধীনতা, পায়ের স্বাধীনতা চেয়ে বসে আছ গোঁয়ারের মতো। স্বাধীনতা চেয়েছ নূপুরের। আমি শান্তি ভাঙা ডাক দিয়ে এইখানেই, এই পৃথিবীতেই হেঁটে চলে যেতে চাই।
পৃথিবীর বিরাট মুখ। হা করে মুখটা আর বন্ধ করল না, সবাই ঢুকে যাচ্ছে এই বিরাট হা-এর ভেতর। আহা গিরিবালা! প্রাণে নেমেছে বাতাসের নামতা, আয়ুর নামতা, স্বাধীনতার নামতা। বাতাস ভালো নেই, আয়ু ভালো নেই, স্বাধীনতা ভালো নেই যন্ত্রণার যাঁতায়।
আর কী কী জিজ্ঞাসা বুনে দিলে এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না। লাল আলো, সবুজ আলো, অন্ধকার আলো জীবনের হাঁটাচলার গহীনেই গুছিয়ে রাখতে চাই। এসো, যদি একটা ফুলের বাগান করা যায়, নাকফুল বিক্রি করে সোনার টিয়ে কেনা যায়।
প্রাণসী, জীবন একটা আমরা পেয়েছি, পৃথিবীরই এই এক সময়ের গর্তে। কিন্তু এই কি জীবন? এই কি একটা জীবনের মতো জীবন, যে জীবনের ভেতর দিনরাত চরিতেছে লাল তেলাপোকার আয়ু?
আমি রজনীগন্ধার আত্মা ছুঁয়ে দেখার আর বকুলের আত্মা ছুঁয়ে দেখার যে কথা বলতে চেয়েছিলাম, তা তোমার মনে আছে হয়তো। ঝগড়া করার বয়স পার হয়ে গেলেও, দিন রাত আলো জ্বলে উঠলেও তেমন আর ফল নাই জীবনের লাল ভাত খেয়ে। কেন যে দেখা হয়ে যায় একজনের সাথে আর একজনের? আবার দেখা হয়ে যায় হঠাৎ বহুদিন পর, তখন মনে পড়ে যায়—হৃদয়ের ভেতর দিয়ে নিশ্চয়ই একদিন সাপ হেঁটে গেছিল পুর্ণকলার দিকে।
আমি তোমাকে আর কখনো জাম অপবাদে দণ্ডিত করব না। এসো, ভাত খাও আর কিছুটা শান্ত হলে জামরঙের শাড়িটা পরে নিও, বহুমাইল হেঁটে যেতে হবে। সকাল সকাল সূর্যটা ধরতে পারলেই হয়। তুমি বললে—সবাই যাচ্ছে স্বর্ণনগরের ট্রেন ধরতে আর তুমি কি না সূর্যের মধু পান করতে চাও। তা হোক গিরিবালা। আমি ভুলিনি সেই ড্রেন, সেই ডিসেম্বর, সেই আগুন, সেই কবরের মন আর আমাদের জীবনের যোগফলের লালবাতি। তুমি কেমন আছ? তুমি কেমন থাকতে চাও? তুমি যেমন আছ তেমন যদি থাকতে চাইতে তা থাকতে পারতে না। যেমনভাবে—তুমি যেমন থাকতে চাও তেমন থাকতে পারবে না।
গিরিবালা, হাসপাতালের বেডে যেদিন ধান বোনার স্বপ্ন দেখেছিল কৃষক আর তাদের বুকগুলো গুলি খেয়েছিল ইউরিয়া সারের বস্তা হাতে পাওয়ার আগে, তখন কিন্তু তুমি কান্না থামাতে পারনি। আমি বলেছিলাম—মানুষদের স্বপ্ন দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এখানে। ঈশ্বর ক্যাপসুল আর ট্যাবলেট বোনার ক্ষমতা দিত, তোমার মাথায় মাথাল দেখে হাসতে হতো আমাকে। কলমকমল থামুক তোমার।
থাক, আর বলব না কোনো ক্রোধের কথা। হাঁটব ওদিকে, ওইদিকে, ওইদিকেরও ওইদিকে। এসো, গরম রাতটাকে জুড়োতে দিই।
জামরস দিয়ে যতই তুমি কালি বানিয়ে দাও আমাকে, তা দিয়ে আর লিখব না একবিন্দুও। মানুষের ঘর পুড়ছে বোমায় বোমায়, মুখ পুড়ছে এসিডে এসিডে, বুক ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছে, আমি কালি নেব সেখান থেকে। আর পৃথিবীতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্মশানগুলো থেকে সংগৃহীত বস্ত্রতে লিখতে চাই তোমার নাম, আমার নাম, পৃথিবীর নাম, ধর্মগ্রন্থের নাম, বুশের নাম, সমস্ত কিছুর নাম, সমস্ত অকিছুর নাম, সমস্ত বিচ্ছুর নাম। চুল বেঁধে নাও।
গল্প করার দিন পার হয়ে গেছে, একথা আমি স্বীকার করব না। পাখি সব উড়ে গেলে তাদের বাসায় যেসব ডিম থেকে যায় আর বাতাসেরা সেসব ডিমের গায়ে অক্সিজেন মাখিয়ে দিয়ে সরে পড়ে, তা কেউ দেখতে পায় না। এই যে বাতাসের অক্সিজেন মেশানের ষড়যন্ত্র, এটা প্রতিহত করবে কে অক্সিজেনহীন এই পৃথিবীতে? অক্সিজেন অভ্যস্ত করানোর এই ষড়যন্ত্র বাতাসের না থাকলে মানুষেরা বাঁচত।
আমেরিকার চেয়ে, বৃটেনের চেয়ে আমি তোমার ওপরই বেশি রাগতে পছন্দ করি। তোমার কাণ্ডজ্ঞান! বলিহারি বালা! জিতেন কাকার রক্ত লাগবে—বলতেই তুমি এক মগ জামের রস এনে হাজির করলে। তোমার এ কাণ্ড দেখে বুকের ভেতর মধু চরে—আহা, আমার গিরিবালা যদি ঈশ্বর হতেন এই পৃথিবীর তবে কত সুবিধাই না হতো। জামরস শরীরে নিয়ে বেঁচে যেত সব রক্তক্ষরা, রক্তঝরা মানুষ।
সেদিনতো রাত পোহায়নি, তবু তুমি ডাক দিলে এক মহান নেতার কণ্ঠস্বরে—উঠরে পাখিরা সকাল করে দে। গিরিবালা, পাখি কি আর তেমন করে আছে যে, সকাল করে দেবে যখন-তখন। কিছুদিন পর সকালই হবে না এই পৃথিবীতে। পাখির মাংস প্রিয় হয়েছে মানুষের, পাখির ডাক আর প্রিয় হয়নি। বৃক্ষের ওপর ক্রোধ হয়েছে মানুষের। বৃক্ষ খুঁজতে যেতে হবে বৃক্ষ যাদুঘরে। পারবে এতটা পথ হাটতে? পারব না বলে চুলের বেণী ঝট করে ঘুরিয়ে চলে গেলে হবে না।
তোমার প্রিয়কাজ কী? একথা বলতেই কিছু না বুঝেই বললে—চুম্বন করা, তোমাকে চুম্বন করা। তোমার প্রিয় কাজ কী? এই প্রশ্ন তোমার মুখ থেকে সমাপ্ত হওয়ার আগেই তোমার স্তনের দিকে, তোমার বেণীর দিকে, তোমার যোনির দিকে চোখ চলে গেছে। কিছু না বুঝেই উত্তর করেছি—চুম্বন করা, তোমাকে চুম্বন করা। আর কোনোদিন আমরা প্রিয়কাজ করব না। ইরাকের রাস্তায় মৃত চুম্বন পড়ে আছে। আফগানিস্তানের রাস্তায় মৃত চুম্বন পড়ে আছে। আফ্রিকা আর এশিয়ার রাস্তায় মৃত চুম্বন পড়ে আছে। সমগ্র পৃথিবীর পথে পথে পড়ে আছে মৃত চুম্বন। এসো, সেসব চুম্বন কুড়িয়ে কুড়িয়ে কবর দিই। চুম্বনের কবর।
থেকে থেকে বলে উঠছ—জ্বলছে। কী জ্বলছে গিরিবালা? প্রশ্ন করলে আর উত্তর দাও না। তোমার বুক? বুকের ভেতর? বুকের ভেতরের ভেতর? বুকের ভেতরের ভেতরের ভেতর? বুকের ভেতরের ভেতরের ভেতরের ভেতর জ্বলছে? গলা ঝাঁকি দিলে শুধু বলে উঠছ—জ্বলছে! সময়ের গানে আগুন লেগে গেছে, তাই যদি ধরে নিই আর কুকুরের শিশ্ন চুষে চুষে নিজেদের ভেতর তাদের সিমোন নিয়ে নিতে পারি তবে জন্মাতে পারব উপযোগী কিছু প্রাণী। থাকবে এর ভেতর? বমি করে ফেললে পৃথিবীর মসৃন ত্বকের ওপর একথা শোনার পরেই। থাক, আর বলব না কোনো ক্রোধের কথা। হাঁটব ওদিকে, ওইদিকে, ওইদিকেরও ওইদিকে। এসো, গরম রাতটাকে জুড়োতে দেই।