গ্লাস ভর্তি নীল ছায়া
গ্লাস ভরা মদ। ওরা পান করে, অবিরাম ঝিমাতে থাকে; আমি দেখি। ওরা আবোলতাবোল বকে, চিৎকার করতে থাকে; আমি শুনি। সকল নারীকে তারা বেশ্যা বলতে থাকে, মুখের রেখাগুলো বিকৃত হতে থাকে; আমি হাই তুলি। তারা রাজা-বাদশা’র মতো ভাবে থাকে, ভাবলেশহীন বিড়বিড় করতে থাকে, রাজ্যহীন-মুকুটহীন সম্রাটের মতো পড়ে থাকে এলোমেলো ছায়ার গর্তে; আমি নির্বাক হয়ে যাই মাছের মতো।
ছন্নছাড়া পিঁপড়ের তৃষ্ণা, এবড়োখেবড়ো গাছের চোখ, উস্কোখুস্কো বাতাসের শরীর শুয়ে আছে গ্লাস ভরা মমতায়। এ-শহর ঘুমিয়ে গেলে কিছু রূপালি ইলিশ উঠে আসে পিচঢালা রাস্তায়, কিছু শব্দ উড়তে থাকে একুরিয়ামের শূন্যতায়; আমি ডুবে থাকি কবিতার পিপাসার্ত কুয়াশামগ্ন গহীন লিরিকে। ওরা পান করছে বিড়ালের ওম, শিয়ালের লালা, কুকুরের স্তন; আমার চোখ গলে-গলে পড়ে ঘুমহীন রাত্রির মোকামে।
গ্লাস ভর্তি বালি ফেনা নীল মলম, চুমুকে-চুমুকে জাদুর রস; তাদের কপালে ফুটেছে জাদুফুল। বাক্সে-বাক্সে জমা হচ্ছে ছাইচাপা আগুন, ঘাড় বেয়ে নামছে উত্তপ্ত তরল, কানের কোটরে প্রেমের সংলাপ; চোখের ভিতর ঘামের লবণাক্ত ঝাঁঝালো নিদ্রাশ্রম। তোমাদের গ্লাস ভর্তি প্রেম, চুমু, কাম ও বেওয়ারিশ লাশ; আর তোমাদের গ্লাসের সীমানা পেরিয়ে আমি বোবা মাটিতে ফুটাই মানুষফুল।
ফালুদার মেলোড্রামা
আইসক্রিমের মতো ঠাণ্ডা তোমার মুখ
তোমার চুলে কৃত্রিম বাতাসের সংসার,
তুমি আগের চেয়ে মসৃণ-মনোলোভা হয়েছ
কিন্তু ভিজে গেছে তোমার একাকি বালিশ;
ছেলেটি আগুনের ঢেউ—মেয়েটি বৃষ্টির ছোঁয়া
তুমি কি নির্জন পাহাড়ের শব্দ শুনতে পাও!
আমি বাঁশি হয়েছি তোমার সিথানে,
আমরা ‘তুমি’ হবো সমুদ্র-স্নানে;
তোমার যাপিত জীবনে পুঁটি মাছের হইচই
তুমি কি কখনো স্বপ্নে সূর্যসন্তান দেখেছো!
ফালুদার বাটিটি এখনো তোমার অপেক্ষা করছে
তোমার নামে গেঁথে আছে মেরি ওলস্টোনক্রাফট;
অঙ্কটা এখানেই শেষ না—মেলোড্রামা চলছে
তুমি রেগে গেলে জাহাজের ডেকে রাত্রি নামে
বলটি ঘুরছে সারা মাঠজুড়ে—নির্বোধ দর্শকের হাততালি
তোমার নির্মিলিত চোখে থোকা-থোকা কাজলফুল
তোমার মৌন কপালজুড়ে দীর্ঘ কথোপকথন
বাম হাতের ঘড়িটি টাইম স্কয়ারের জীবন
তুমি যা নিয়ে এত ব্যস্ত আছো—উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
তা কোনোদিন শুনতে পাবে না; আমার করতলে তোমার চড়ুইভাতি খেলা।
হারানপুরের গান
পুনর্বার তোমাকে আর চিনতে চাই না
আর যেতে চাই না পুরাতন পুকুরঘাটে
আর চাষ করতে চাই না স্যাঁতস্যাঁতে জমিন
আর ফুল কুড়াবো না প্রাচীন বেলতলায়
ভোরে-ভোরে জাগবে না ময়নামতির চর
তুমি চলে গেলেই—সারা আঙিনাজুড়ে সূর্য উঠবে
টিউবওয়েলের লেদার আর নষ্ট হবে না
কদমফুল হাসতে থাকবে অনাবিল দুপুরে
আমাদের নদীতে জোয়ার আসবে মাসে অনন্ত তিনবার
অনাগত শিশুরা মিথ্যার আশ্রয়ে বেড়ে উঠবে না
বুকের পিঞ্জরে যে-পাখি বাসা বাঁধে, সে-পাখি
গান গেয়ে-গেয়ে ঘুমায়—সে আমার একলা পাখি
তোমার জন্য আকাশের প্ল্যানশিটে নিঝুম ভোর নামে,
তোমার জন্য একজন খুনিও ফুলের বাগান সাজায়;
যে-তুমি হারানপুরের গান—সে-তুমি বহুদূরের ছায়া
তোমাকে আর জ্যোৎস্না দেখাবো না ব্লু-ম্যারিন ছাদে,
এখন তোমার জন্য অপেক্ষা করবে তাঁতীবাজারের কসাই;
চাপাতির ধারালো ঠোঁটে রক্তাক্ত হবে তোমার লকলকে জিহ্বা।