ইনডিগো ফুল
দুলে ওঠে খসখসে পেলব পাতায় হলুদ কুঁড়ি, নির্ভরপ্রবণ লতাগুল্ম। কিশোরী শিমফুল কর্ণদুল।
পাখিদের প্রপাত। পাতার আড়ালে ঘুঘু, কার্ডিনাল কার্নিভ্যাল।
নয়নতারায় লুকিয়ে থাকা অবুঝবেলার হৃদয়গাঁথা গল্প। রোদের বেহালায় নাচে ইনডিগো ফুল।
এসব দেখা-অদেখা নতুন নয়, নতুন করে গার্হস্থ্য আবিষ্কার। আলোর মাঝে ঘূর্ণিত পুনরুত্থান।
ঢলে পড়া বোধে ঝুলে থাকা নির্মম নিঃশ্বাস।
আয়ুর ভ্রমর পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে বিচলিত ফুসফুসে জোগায়
বেঁচে থাকার উপলব্ধি।
বিধির শেকলে পরাস্ত চেতনার দেয়াল। প্রসূন ছায়াখেলা কর্পূর।
আততায়ী বাতাস জানান দেয় বাণীর মতন
ভীষণ বদলে গেছি আমি ও আমার মতো বিপর্যয়ী মানুষেরা।
বিকেল অবসাদে ঘণীভূত সন্ধ্যার নিস্তেজ সূর্য অতি নিকটবর্তী ‘পড়ো তোমার প্রভূর নামে’ যপযাপন।
মর্মপতন অনিবার্য আশ্রয়।
রোদ রমণী পুষ্পগান
দগ্ধ দিনের চৌকাঠে পুষ্পরাজির রঙিন মদিরা
বোগেনভিলা, টিউলিপে প্রজাপতি, ঘাসের ফড়িং
জলচ্ছ্বাসের নদীর ছুঁই ছুঁই আকাশ
বিহঙ্গডানায় উড়াল আকাঙ্ক্ষার তরঙ্গ
এক গ্রীষ্মপথ দৃশ্য খোলে, গুচ্ছ গুচ্ছ রোদের মেঘে
দূরের আকাশে কেমন সাঁতার তোলে বহুবিধ প্রশ্নস্বর।
হাওয়ার শেকল ভেঙে উড়ে গেছে দ্রোহী পাখি শোকার্ত গল্পগুলো বৃক্ষের চোখে স্থির দাঁড়িয়ে
ছায়া ভর করে অবাক চোখে, মৃদঙ্গ হাওয়া শিল্প,
মুঠোমুঠো প্রসন্নতায় খেলা করে ইনডিগো বোধি।
তোমার কণ্ঠে ধ্বনিত মধুরতম কথাগুলো লুব্ধসুধা হয়ে ফিরে আসে কানে কানে
আমি আজন্ম নতজানু পার্বণবিলাসী প্রাচীন সুখে
প্রদক্ষিণরত অতিনবতারা প্রেম আমার জগৎজান্নাত।
অণুজীবকাল
দিনের প্রারম্ভে সকাল বেজে ওঠে মুহুর্মুহু
জানালা কেঁপে ওঠে নিজস্ব দিনলিপিতে
জনশূন্য স্ট্রিট, অ্যাভেন্যু, কফিনের যান
ক্ষীপ্র গতিতে তীব্র সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলো
কিছুক্ষণ পরপর জানান দেয় জরুরি অসুস্থতা
পৃথিবীর আকাশে নবঋতুর আগমন
চুইয়ে চুইয়ে জল ঝরছে বসন্তের কচি পাতায়
বৃক্ষ-পাখিদের আতঙ্কহীন দিন
অবাধ বিচরণে যে মানুষেরা লিখেছিল মৃত্যুহীন আমলনামা
আজ তারা নিয়েছে ঠায় অন্তরীণ শোকের আগুনে
চিরবিচ্ছেদে নিঃশ্বাস বিষদাহে পৃথিবী থেকে নিয়েছে বিদায়
সব কথা হারিয়ে সনদে মৃত্তিকার কালোফুল
প্রিয় কেউ হাসপাতালঘরে চেতন-অচেতনে
করছে আহাজারি
আমি জলমগ্ন, আমি নিমজ্জিত হচ্ছি ক্রমাগত না।
আমার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে।
আমি বাঁচতে চাই। বাঁচতে চাই।
এইসব মর্মান্তিক খবরগুলো জমা হবে ইতিহাসের কোষে
কাঁদে পরাভূত আশা, অণুজীব ফুসে ওঠে
অপেক্ষারা ক্লান্ত দিয়েছে উড়াল অনির্দিষ্টকালের পথে
বেদনারা বড় হতে থাকে জ্যামিতিক হারে
বন্দি থেকো ঘরে। দেখা হতেও পারে।
কেটে গেলে মহামারী উত্তাল। বিদায় নিলে জীবাণুকাল।
কনফেশন ওডস্
পাতায় ঘেরা ফুলের ম্লান মুখ, মেঘহীন মেলানকোলি।
চিবুক ছুঁয়ে অনুষ্ণ বাতাস, জলে উপুড় আকাশের ছায়া
চোখের তারায় বিবরা মৌসুম, ধ্রুব আনমনা
কোথাও শব্দহীন ভাঙচুর হচ্ছে। কনফেশন ওডস।
অন্তর খুলে শুনি প্রার্থনা সঙ্গীত, উইদআউট ট্রাম্পেটস্।
বিরামহীন শহর, কোলাজ কোলাহল, বর্ণিল শপিংমল
আভিন্যু, স্ট্রিট পার হয়ে পাথরের অট্টালিকা
শোকবাহী দাঁড়িয়ে সুদর্শন ভাস্কর্য
শৌর্য নিঃসঙ্গতায় হেলান দিয়ে উন্নত শির
দীর্ঘ পথ সংকল্পবদ্ধ, তৃণঠোঁটে উপবাসী অভিলাষ
বৃক্ষশাখায় আশ্রিত পাখি সদ্য ঘনীভূত আঁধারে
অতপর কিচমিচ করে বলে ওঠে ‘আমি নিরাপদ’, ‘এ পৃথিবী নিরাপদগৃহ’।
তোমাদের কাছে যারা অভিশাপ, পৃথিবীর কাছে অনিবার্য অস্তি
বিদ্বেষ-বিষে বাজে ক্রুর অন্ধকার, ছদ্মবেশী রন্ধ্রহীন
মাটির শেকড়ে পর্বত আগামীকাল আশ্লেষী উদগ্রিব
সম্মুখবর্তী নরপিশাচের তাণ্ডব নৃত্যে ক্রোধ বেজে চলে
জন্ম-মৃত্যুর সরল কাহিনি অগোচরে মহাকালে ঝরে যায়।
ইঙ্গিতপ্রসূত কার্নিভ্যাল
একপশলা নেশাতুর রোদে পাখিরা পোহায় উত্তাপ
খুব বেশি মনে পড়ে।
বর্ণবিভা হলুদ ঝরাপাতার পথে জ্বেলেছিলে দুই চোখের মায়া-জ্যোতি আগুন
প্রলোভিত হাওয়ায় বেজেছিল যতিচিহ্ন স্পর্শকাতরতা
হয়তোবা নেমেছিল বৃষ্টি নিভৃত কথার জীবনে
গুচ্ছ মৌসুম-রমণ বেদনায় ফুটেছিল নিবিড় উচ্ছ্বাসে
বড় বিলাসী চাওয়ার এ যোগাযোগ অনাহুত আবৃত্তিক
তথাপি দৃশ্যগুলো দেয়ালে আড়াল হলো; ইঙ্গিতপ্রসূত সন্তাপে
পৃথিবী রঙে সাজে, মেতে ওঠে উৎসবসমাজ ঈর্ষামগ্ন
নদীর ধারঘেঁষে নির্জনতার ভাঁজ খুলে অধিকৃত আঁধার থেকে
বিন্দু সন্ন্যাস বিষাদের কণা কুড়িয়ে জমিয়ে রাখি ললাটের পর্বভাগে
এমন বিস্ময় দৃষ্টি মেলে হিম-ক্রন্দনে জেনেছি যাপনহেতু কার্নিভাল
এই সামান্য ভ্রমের দিন, নদী-মেঘলায় জীর্ন ধ্বনিতে কবিতা হয়ে নাচে
হায় একাকীবোধ, নতমুখী উপসনারত দৈবপ্রণোদনায় বাঁচো
বিপুল আকর্ষে ছুটে আসে মন্দির শরীরে মর্মার্থ প্রেম-সঙ্গীত
বোঝোনি? প্রাচীন নৈঃশব্দ্যরা গন্তব্য ছুঁয়ে আছে
কতটুকু উপশম? শূন্যবৃত্তে সাজানো বিনাশীবিজয়?
অনন্তের উপেক্ষা, তৃষ্ণার্ত অপেক্ষার ভ্রূণে।
বৈশাখ নামচা
পায়ে পায়ে পিছু ফেলে আসা বিস্তীর্ণ পথ সমতল
আগমনী বার্তা পাখিদের কোরাসে সমুদ্যত বৈশাখ
মেঘের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রোদের নতমুখ প্রস্থান
আকাশের কিঞ্চিৎ দৈর্ঘ্য নিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ভাস্কর।
ভেবেছিলাম আঁকবো বিম্বিত তোমার নবান্ন মুখ
অসমাপ্ত সে ইচ্ছে পান করবে নিসর্গ চারিদিক
তুমি-আমি মুখোমুখি দূরতম পরস্পরের দৃষ্টিপাঠে
আমি চেয়ে চেয়ে মিলে যাবো বেলাশেষে
গোধূলির নৈঃশব্দ্য নেমে আসা অবধি।
হৃদয়ে অনুরণন শৈশব অলিন্দে দুলে ওঠা
আমার সহস্র বিচ্ছেদ পার্বণ
সেই কবেই হয়েছে পুরাতন আচ্ছন্ন ঝরাস্মৃতি।
আমি অরণ্যময় হবো, না হয় ফুটবো লু-হাওয়ায়
নাগরঙ্গ বুনোফুল হয়ে
সব চাওয়া নাই যদি হলো মিলনামুখী স্রোতাশ্রয়
তবুও বিদীর্ণ আকুলতায় কেন স্বেচ্ছা এ পরাজয়?
গন্তব্যপথ ও কিছু সঙ্গী
চোখের তারায় ইঙ্গিতবহ খেয়ালি দিগন্ত বিলীন
মৌনী মন্থর, শিথিল কণ্ঠে মাধুকরী গীত
রৌদ্রস্নাত শিশিরের শুভ্র জলে বিম্বিত পুঁথিমালায় আবৃত রত্ন গ্রীবা,
যুগপৎ কৌতূহলী অন্বেষণ
একমুঠো দৈব উত্তাপ, শূন্যসার শাখায় শাখায়
ফিকে আলোর গুনগুনে ঝিনুক মেয়েটির নুপুর পা পড়তেই
আদ্রমন্ময়ী মেঘপন্থী দিন মদির হলো অতর্কিত।
নিঃসঙ্গ মেয়েটি কিছু নিঃশর্ত সঙ্গীর দেখা পেলো
দু’পারের আকাশ, সৌরভী বাতাস
শির দোলানো ফুল, কিচিরমিচির পাখির ঝাঁক
বনবাসী প্রজাপতি মেলে দিলো বর্ণিল পাখনা
অদূরেই গতিমন্ত হলো নদীর ঢেউ খেলানো জল
প্রসন্ন হলো চিত্ত অবারিত পাহাড়ি প্রান্তরের
আহ্লাদী হলো সামন্ত হৈমন্তিক ঝরাপাতাগুলো
মেয়েটির লিরিক্যাল আঙুলগুলো স্পন্দিত হলো
ঘাসের গালিচায় একান্তে
অতপর রচিত হলো বিপুল বিস্ময়ের আত্ম অনুবাদ।
হাওয়ার রাজ্য মন্থর
আগন্তুক এক আকাশ দেখি, কী দীর্ঘ নিসর্গচারিতা
চোখদুটো বিস্ময়ে নিবদ্ধ সংবেদনের কাছে
হার আর জিতের অগ্নিদগ্ধ জমিনে
আলোর তরঙ্গে হেসে উঠি বৃত্তান্ত হাওয়ার ডাকে।
এসো তবে শুনি, শুনি কোকিলের কুহু সবাক
বিদায়ী সূর্য কবিতার থালায়, এসো কুড়াই শব্দ
প্রজাপতি অদৃশ্য হয় পক্ষান্তরে অন্তিম ছায়াসঙ্গে
মনের ভেতর জেঁকে বসে নৈঃশব্দ্যের পরাগায়ণ
একটু পরেই মনে পড়বে
কত কাছে থেকেও তোমার, আমি কতদূরে।
জলসঙ্গীত
কালো মেঘ সবটুকু জলকে বিষণ্ন করে দিয়ে
হাওয়ায় শীতার্ত সন্নিবিষ্ট
স্কাইলার্ক বেষ্টিত জলজানগুলো ডানায় উড়ে
শিষ্ট ঢেউয়ে ইস্ট রিভার অন্তরঙ্গ
অটাম সিজনের অনন্ত রূপ আজ্ঞাবহ
চিকচিক জ্বলানেভা রোদ এসে ছুঁয়ে যায়,
ধূসর দীর্ঘ ছায়ারা প্রস্থানরত
কম্পমান জল তীরঘেঁষে নিকটবর্তী
আজ দিনটি গম্ভীর না হয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল হতে পারতো
পাতাহীন ডালপালা সবুজে করতো স্নান
রোদের সরোদে পূর্ণাঙ্গ হতো এলোমেলো এক ঝাঁক শীতল বোধ।
বোধনামা
একটি ছিল ফটক, বাড়ির বাইরে যাওয়ার পথ
সবুজ পাতার পাল্টে যাওয়া অসুখ সংযোগে
মৌসুমের হারানো বেদনার সুবাদে, বন্ধ জানালায় অতিনিবিড় হয়ে
থেমে যাওয়া নদীর কাছে যেতে চাইলাম।
অটামদিনের সাঁঝবেলাটা যেন মৌন-গাঁথুনি
অপহৃত অনুভবের, আকণ্ঠ জাপটে ধরা ভগ্ন সময়
মন্দগতির এই প্রহরে আগলে ধরা ধূসর চাঁদের নাগাল
পাখপাখালিবিহীন এ চরাচর এখনো যদি ফিসফিসিয়ে বলে
কনকনে তিরতির বাতাসে মিহিসুরের মতো
একটি নগণ্য আঁধার তোমায় দিলাম
হাত পেতে নাও হোকনা দেহ অসাড়
তুমি জেগে আছ, দৃষ্টিসীমার বিরোধ বোধনামায়।