ক.
নূহের নৌকার মতো দয়িতার যদি দুটো চোখ
নিশ্চিন্ত নীড়ের মতো পেয়ে যাই কখনো নিলামে
কিনে নেব আমি তাকে সিক্ত প্রেম, হৃদয়ের দামে
যেখানে বিশ্বাস আর ভালোবাসা ছড়াবে আলোক
কখনো তোমার নীড় বিশ্বাসের একান্ত অভাবে
মানব নীড়ের মতো ঝড়ে তার ভাঙে কি হে পাখি?
ভেঙে যায় সেই নীড় যতনে যতই বেঁধে রাখি
নিবিড় নিশ্চিন্ত নীড় খুঁজি তাই পাখির স্বভাবে
পাখিরা যেমন করে নিজের কুলায় ফেরে রোজ
দিনমান খেটে খুঁটে অবসাদ ঝেড়ে ফেলে তার
শীতল করে যে প্রাণ, শঙ্কা—ভয় তাড়িয়ে সরোজ
নূহের নির্দেশ শুনে আমিও কি হব পারাপার?
নশ্বর নীড় তো নয়, খুঁজি আমি স্বর্ণ-সরোবর
প্রণত প্রবাল পদ্ম, প্রেমের জান্নাতে জাগা চর!
খ.
পৃথিবীর দিকে দিকে খোঁজে প্রেম আহত হৃদয়
অথচ সে পৃথিবীর কত প্রেম ওই বুকে জমা—
নির্ণয় করিনি আজো, খুঁজে তো না পাই সে উপমা
সে প্রেম হৃদয়ে রেখে পৃথিবী কি হয়েছে নিদয়?
সন্ধ্যার পাখির মতো ঘরে ফিরে শেষ হলে বেলা
দেখি, ততো প্রেম নেই, প্রয়োজন যদিও সতত—
প্রেমেও বৈষম্য তবে, নাকি সবই হৃদয়ের খেলা?
কে হারে, কে জিতে ঠিক বুঝা দায়, চাতুর্যের মতো!
যে প্রেম সৃষ্টির প্রতি, সেখানেও বৈষম্য প্রকট
যে প্রেম স্রষ্টার প্রতি, নিয়ত সে প্রশ্ন হয়ে রয়
তবে কি অপূর্ণ প্রেম সর্বত্রই রচে দৃশ্যপট?
তোমার নামেই বুঝি চিরন্তন প্রেম কথা কয়?
সে প্রেম পেয়েছো কোথা, কোন্ প্রতিপালকের কাছে?
দাও কিছু আমাকেও যা তোমার বুকে জমা আছে!
গ.
পাখিদের ফোটে ডিম নিবিড় উত্তাপ, ছায়া আর—
সীমাহীন ভালোবাসা, প্রেমের নিপুণ উষ্ণ ওমে
পাখিদেরও ভাঙে ডিম প্রকৃতির নিঠুর নিয়মে
অযত্ন, অপ্রেমে পচে সেই ডিম—সম্ভাবনা তার
পাখির ডিমের মত আমারও কি হৃদয়ের রঙ
প্রথা ও প্রকৃতি এক—অনন্তর খুঁজে ফেরে ওম
ভালোবাসা-প্রেমে পূর্ণ খোঁজে নীড়—সোয়ানের ফোম
শিল্পের সম্ভার কিংবা ঐশ্বর্যের আরেক আড়ং
বর্ণিল স্বপ্নরা যার শক্তি আর গড়ে সম্ভাবনা
নিবিড় উষ্ণতাপূর্ণ পরিচর্যা ছাড়া সেই ডিম
নষ্ট হয় নীড়ে তার নিয়তির সে কি বিড়ম্বনা—
ফোটে না পাখির ডিম—আগামীর আত্মার পিদিম!
প্রেমের উষ্ণতা পেলে কোনো ডিম ভাঙে কি হে পাখি?
সোনার ডিমের চেয়ে অমূল্য হৃদয়, তা জানো কি?
ঘ.
সুবর্ণ হাসির রেখা আমি যেনো গোলাপি দু’ঠোঁটে
ধরে রাখি নিরন্তর সুহাসিনী ভোরের মতন
এমন আহ্বান শুনি শুভার্থির কণ্ঠে অনুক্ষণ
চঞ্চলা চঞ্চুর ঠোটে যেভাবে হিরের ফুল ফোটে
সোনালি চঞ্চুর হাসি তুমিও কি কর বিকিকিনি?
দুঃখের আসল রূপ ঢেকে রাখো রূপালি হাসিতে
হিংসার হার্পুন রাখো বর্ণময় মুখের আর্শিতে
হাসির আড়ালে ইর্ষা ইতিপূর্বে আমি কি দেখিনি?
মুখতো মনেরই আর্শি—ফুটে ওঠে প্রকৃত স্বরূপ
বৈপরিত্য খেলা করে মানুষের রক্ত চলাচলে
মনের মুকুরে এক, মুখ তার অন্য কথা বলে
তোমার নীতির মত দিবসে আমিও থাকি চুপ
রাতের রোদন ধ্বনি যেনো বা তোমার দু’টি ঠোঁটে
ভাষা পায় হাসিহীন, যদি না হীরের ফুল ফোটে!
ঙ.
অস্থিরতা জীবনের বড় বেশি লক্ষ্যচ্যুতি আনে
অথচ স্থিতির জন্য মানবতা উন্মুখ, অস্থির
মানুষের ধর্ম জানি, শাশ্বত সত্যের পথে ধীর
সেই কথা তুমিও কি বলে যাও কবিতা ও গানে?
অস্থির বিশ্বের মাঝে জীবনের স্থিরতা দুর্লভ
অস্থির মনের মাঝে স্থিত হতে পারে নাতো প্রেম
তাই কিনা খুঁজে ফেরো স্থিতি আর গতির হেরেম
অথচ গতিও এক সাফল্যের দৃপ্ত অনুভব
সত্য ও প্রেমের প্রশ্নে আমি আজ তোমার মুরিদ
গেয়ে যাই সেই গান শিল্পের বান্ধব যেনো কোনো—
স্থির চিত্র হয়ে ওঠে সেই গানে রাত্রির অঙ্গনও!
অগ্নিরঙা ভোর এলে আসবে কি সোনাঝরা ঈদ?
স্থিতি ও গতির মাঝে সম্পর্কের সূত্র হলো স্থির
এরই মাঝে তুমি আমি লক্ষ্যপানে চলেছি অধির।
চ.
দূঃখের নির্যাসটুকু ছেঁকে নিয়ে তুমিও হে পাখি
ডেকে ডেকে সত্যিকার সুখের আকর হয়ে ওঠো
পৃথিবীর দূঃখ-তাপ নিজ ঠোঁটে নিয়ে মুঠো মুঠো
পিয়াসী সুখের সুরা কিংবা হলে অন্য সুর সাকি
নিজেকে সম্পূর্ণ করো আমরণ তৃষিত তিতির
বিবিক্ত চিৎকার থেকে ব্যথিতের বুকফাটা ধ্বনি
তুলে নিয়ে তারপর শুরু করো লোকজ গীতির
তোমার গানের সুর সুসুপ্ত শব্দের কোনো খনি?
তুমিতো কালের কবি এভাবেই হয়ে ওঠো জানি
সাপুড়ের মতো তুমি দংশনজনিত যতো বিষ
শুষে নাও, খুঁজে আনো কালের সকল শুভাশীষ
এভাবেই পূর্ণ হোক তোমার কাব্যের ডালিখানি
পৃথিবীর সব প্রাণী সত্যিকার সুখি হয়ে গেলে—
প্রশান্ত তোমার আত্মা এ উদ্যানে উড়বে ডানা মেলে?
ছ.
এখানে প্রেমের নামে বয়সের লুকোচুরি খেলা
এখানে অজস্র নদী বুকের গহীনে বয়ে যায়
প্রিয়ার আড়ালে প্রেত-প্রেতাত্মার ধ্বনি দিয়ে যায়
রহস্যের জটাজালে অনন্তর ক্ষয়ে যায় বেলা
তোমার তুতির কণ্ঠ আমাকেও করে সচকিত
সহসা চেতনা জুড়ে জেগে ওঠে তৃতীয় নয়ন
রহস্যের রেশটুকু যেনো কোনো নূরের বয়ন
অনন্ত প্রেমের পথে তারপর হয়ে উঠি স্থিত
কিসের বেদনা নিয়ে রাত্রিভর ডাকো অবিরাম
ঠোঁটে নিয়ে পৃথিবীর দূঃখ গ্লানি প্রবঞ্চনা ফাঁকি
তুমিও প্রেমের নামে প্রবঞ্চিত হয়েছিলে নাকি
রাতের আকাশে তাই ভেসে ওঠে তিতিরের নাম?
বোধের বিরল সুর তোমার তৃষিত দুই ঠোঁটে
ফুল হয়ে, প্রেম হয়ে বলো পাখি তবু কেন ফোটে?
জ.
আমাকে চিনি না আমি—এ আমার ব্যর্থতার দায়
নিজেকে চেনার মানে সৃষ্টির রহস্য জেনে যাওয়া
নিজেকে জানার মানে স্রষ্টার সাধক বনে যাওয়া
জানি না কিছুই তার রহস্যের রেশটুকু হায়—
তুমি কি তোমাকে চেনো, হে পাখি কালের কণ্ঠস্বর
প্রকৃত আত্মার রূপ দেখেনি যে অজ্ঞতর জাতি
তার কাছে একই রূপ দিন আর অন্ধকার রাতি
দিন ও রাত্রির রূপে তুমি কার শোনো কলস্বর?
তোমার সমস্ত সত্ত্বা কার ধ্যানে নিমগ্ন নিবিড়
আত্মার স্বরূপ খুঁজে তুমিও হে পর্যটক পাখি
প্রান্ত থেকে প্রান্তরের ছুটে চলা জাতি কি দ্রাবিড়
নাকি কোনো সাধকের সাধনায় মগ্ন সুর সাকি
আত্মার স্বরূপ খুঁজে আমি তাকে চিনতে যে পারিনি
অথচ আত্মার নামে জ্ঞানের আকাশ রিনিঝিনি!