সুলতান, আমাদের সুলতান গো
চিত্রার জলের জলজ ঘ্রাণ মধুমতিতেও ভাসে গো
কালিগঙ্গার ঢেউও ভেঙে ভেঙে
আছড়ে পড়ে মধুমতির উজানে।
সে কী মায়া গো! কী মায়া!
কস্মিনকালেও এদের প্রেম মরে না,
মরে না গো! মরে না…
মাছিমদিয়ার প্রেমিক লাল মিয়া দুনিয়া ঘুরে ঘুরে খোঁজে প্রেম
চোখে তার কত শত রঙের বাহার
মনে তার কত সুখ! কত সুখ, সুখ গো!
সুখ কই? সই কই? প্রাণ কই, প্রাণ গো!
প্রাণে তার মাছিমদিয়া, মাতা-পিতা
আর তার আগ-পিছ যত আওলাদ
চিত্রার বয়ে চলা জলের নহর,
মাছে প্রাণে ভরা গ্রাম, গ্রামের ডহর
সবুজে সবুজে মাঠ, মাঠের কিষাণ
লাঙল, হালের গরু, মাটির আদর,
কিষাণীর পুরুষ্ট স্তনযুগল,
তরুণীর মায়াচোখ মহাকল্লোল,
শাপলা-শালুকে ভরা মায়াজল—চিত্তহারী!
মন তাঁর অস্থির, অস্থির গো!
কতশত শ্রেণীপাঠ—প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অমিত ভূগোল!
এসবে ডুবে গিয়ে তল অবধি;
তবু তার মন খোঁজে মনের অতল
সেই মনে কারে দেখে, কারে দেখে গো!
লালমিয়া প্রেমময় প্রেমিক যিনি
প্রকৃতির রঙ নিয়ে এঁকে যান তিনি
ক্যানভাসে আঁকা যত স্বপ্নের জ্ঞাতি
তবু দেখি মনে তার বড় আঁতিপাঁতি
কার লাগি গো! কোন টানে গো!
পিকাসো, দালি যারা পৃথিবীখ্যাত
কিংবা ব্রাক, ক্লিদ রঙে বিখ্যাত
তাদের ছবির সাথে, তাদের ছবির পাশে
হেসে ওঠে মিয়া ভাইর ছবি!
সে হাসিতে মন তার ভরে না গো?
ভরে না গো! ভরে নাগো মন!
‘প্রেম যদি ভরে এত সুধা গো
তবু কেন হৃদয়ে ক্ষুধা গো…
সে কেন চলেছে বয়ে ব্যথা ভার’
কী ব্যথা তার গো? কোন্ ব্যথা তার!
লাল মিয়া লাল মিয়া গো!
সব ছেড়ে ফিরে এলে চিত্রার পাড়ে
সেই মায়া, সেই প্রেম, সেই ছায়া গো!
চিত্রা-গঙ্গা বা মাছিমদিয়ায়
তোমার পূর্বপুরুষ শত বছরের
মাঠে মাঠে ধান ছিল, জলে ভরা মাছ
গাভীর দুধের নহরে ছিল কৃষাণীর স্নান
সুখ ছিল অঙ্গের সৌষ্ঠবে—পিতা ও মাতার
সে সব গিয়েছে কবে সামন্ত থাবায়
তারে তুমি ভুলে যাবে? ভুলে যাবে গো!
এমন ভুলের ভারে কতদিন আর?
লালমিয়া ফিরে আসে মাছিমদিয়ায়।
এমন দায় বুঝি থাকে শুধু তারই—
মনের জগতে যিনি চির সম্রাট, সুলতান যিনি
সুলতান গো! আমাদের কৃষকের সুলতান গো!
চিত্রের সুলতান গো! সে যে চিত্রের চিত্রি সুলতান গো!
সামন্ত নিয়েছে কেড়ে কৃষাণের ঘর
ভুলে গেছে এ মাটি আপন না পর
সুঠাম দেহ আজ অভাবে অভাবে
কৃষকায় দুর্বল, দুর্বল গো!
লাবণ্যে ঠাঁসা ছিল কৃষাণী উলান
মুখ তার কৌমুদি ছিল একদিন
নিতম্বের দোল ছিল কত মনোহর
আজ তা শুকিয়েছে শাসনে শোষণে।
অভাবে মাতার সেই দেহবল্লরী,
প্রেমময় চোখমায়া চোখের ভাষা
হারাতে হারাতে সে ক্ষীণকায়—হাড্ডিসার গো!
সুলতান রাজত্ব নেন রঙের ক্যানভাসে
মনের দ্রোহ থেকে রঙতুলি ধরে—
এঁকে যান কত রূপ কত গাথা—স্বপ্ন নির্মাণে।
নিজের লোকজ ধারা নিজেরই রঙে
আনেন ফিরিয়ে তিনি কৃষাণ কৃষাণীরে
সামন্ত বা পুঁজি—যত আগ্রাসন
ভেঙে দেন দিন দিন তুলির আঁচড়ে
কৃষাণ কৃষাণী তাঁর অতিকায় দেহে
ভেঙে দেবে সবলে পুঁজির শাসন
এমনই স্বপ্ন তার, কী স্বপ্ন গো—
এই দেশ সেই দিন হবে কৃষিরাজ
কৃষিরাজে সুলতান—কৃষকই হবে
হবে, হবে তারা সুলতান! সুলতান গো!
আরও পড়ুন: বকপাখিদের গ্রাম ॥ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল