বেগম রোকেয়া আমারই মায়ের নাম
তুমি বসে আছ স্থির—শীতলপাটি। দরোজাগুচ্ছ বোবা তাকিয়ে আছে—পালিশ-করা কামরায়। বারবার অন্ধকার উঁকি দিচ্ছে—আলোর জলসায়। শুধু দীর্ঘ শূন্যতা ছাড়া—এখানে আর কিছুই নেই। তুমি হেলান দিয়ে দেখছ—চাঁদের রহস্য—বলাকার উড়াল—কামদেবের শিশ্নকাব্য—রতিদৃশ্য—চেয়ারের হাতলে ঝিমধরা লাটিমের জিকির-জিকির গোঙানি!
চশমা সিগারেট চা-কাপ জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল—ঠোঁটে-মাখা পিঁপড়ের হর্ষধ্বনি—গড়িয়ে-গড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে সোফার কোমর চুঁইয়ে—কেট উইন্সলেটের নগ্নদৃশ্য—ডুবে যাওয়া টাইটানিকে—এখনো সাঁতার কাটছে। গ্লোরিয়া স্টুয়ার্টের চোখ বন্ধ হয়ে আসে—গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে আটলান্টিকে। এইভাবে ছুঁয়ে ফেলি স্মৃতির মিউজিয়াম—ছুঁয়ে যায় আদি-অন্ত জীবনের ফেনা-ফেনা উল্লাস।
তুমি কী দেখছ—বুকের জমজম আয়নায়—আমি চলে গেলেই বুঝি—হাসতে থাকবে খেলনাপুতুলগুলো! পোশাক খোলা হলেই বুঝি—পাথরের মূর্তিগুলো গাইতে থাকবে—প্রেমের কোরাস! তখন তুমি কেমন করে খুঁজবে—আয়নামতির ঢেউ! কেমন করে জ্বলে উঠবে—মায়াবী চোখ! কেমন করে ধরে রাখবে—রাতের আকাশ! কেমন করে সাজাবে—ফুটে থাকা ফুলগুলো—আরতিমঞ্চে!
আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে—দেখে ফেলি আমারই সহজাত খেলা। দেখি ডিঙি আর জাহাজের তেমন তফাৎ নেই। তোমরা কী নিয়ে মেতে আছ—জলে ডুবে যাওয়া গাছের মতো—বাজি রেখে পুরাণ পুঁথিঘর! বুকের বোতাম নাড়তে-নাড়তে—তুমিও হও নিশিরানি।
একসময় যাওয়ার সময় আসে—সক্রেটিসের জবানবন্দিতে—ঝুলে থাকে প্রভুর বরফকল। গির্জার দেয়াল ডিঙাতে পারলেই বুঝি—বিচারক হয়ে যাবে ঈশ্বর! তাকিয়ে থাকে কেউ-কেউ ঘুমিয়ে পড়ে—কম্বলের নিচে—উষ্ণতার ঘরে—খেলা করে দু’টি কানাই পাখি।
আমি তবে যাই—যাই সিমিয়ান পাহাড়ে…তুমি উঠতে চাও চূড়ায়—কিন্তু বারবার পড়ে যেতে থাকো—পরাজিত প্রাসাদের মতো। এবার যেতে পারো দিকশূন্যপুর—যাও—তোমরাও যেতে পারো নাগরপুর—খেয়াল রেখো—বেগম রোকেয়া যেন হয়—আমারই মায়ের নাম।
মিত্রগুরু কবিতাশ্রম
টয়লেটখানায় দেখি পৃথিবীর মুখ। বেসিনে গন্ধ ছড়াচ্ছে দেহের উত্তাপ। গুরুজিস্টেশনে শিষ্য-শিষ্য হুইসেল। আর কোনো কন্ট্রাডিকশন—মেনে নিতে চাই না—মনে তো আরও দুরূহপাঠ্য—রঙিন বালির নদীদ্র পাহাড়।
কবিতা দাঁড়িয়ে আছে নির্ভয়ে বিচারকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে—মিত্রগুরু আশ্রমে ৫০০০০০ ভোল্টের বিদ্যুৎকেন্দ্র খোলা। ক্যাবলে-ক্যাবলে শব্দে-শব্দে সঙ্গম…
হলভর্তি দর্শক। ভাদ্রের তালনীরবতা। মেডিটেশন চলছে। কেউ গান গাইছে। কেউ নিচ্ছে টেঁটাযুদ্ধের প্রস্তুতি। ব্যাকরণবিদ থামাতে পারছে না মূর্খের লবণহীন তর্ক।
আর আমি ভাবছি ভাবছি ভাবছি—কবিতা অনেকভাবেই হয়ে যায় অগোচরে। ভাবনাগুলোকে ভাবনাগ্রস্ত না-করে—খুব সহজে সাজিয়ে নিলেই তৈরি হয় হরেকরকম ডাইমেনশন; যা রুমালে গোলাপ হয়ে ফোটে—পাখি হয়ে ওড়ে।
আমার ভাবনাগুলো উড়তে থাকে—মহাশূন্য থেকে আরও মহাশূন্যে; আরও আরও আরও মহা মহাশূন্যে। কখনো বুকের সরোবরে সাঁতার কাটে—মালার্মের রাজহাঁস। চোখের করিডোরে বিশ্রামরত—মিল্টনের প্যারাডাইজ লস্ট—আর সোফিয়া লরেনের হিল্লোলিত নিতম্বে—উড়তে থাকে ইবসেনের নোরা। অতপর উত্তপ্ত হুইস্কিতে গলতে থাকে—কবিতার অনন্ত শরীর…
সাপলুডু ও মিথ্যা প্রেম
বকছি—নাকি বকাচ্ছ; রাগছি—নাকি রাগাচ্ছ; বকাগুলো শিশু; রাগগুলো বকের গলা। মেয়েটি কী বলছে—ছাতা-ছাতা বিবাহগন্ধা রাত! প্রাণীগুলো সাঁতরাচ্ছে—বাবু কি এখনো বাথরুমে! লাক্স ডুবে যাচ্ছে সুইসখালে। স্যামন মাছ উত্তপ্ত কড়াইয়ে হাসছে—সমুদ্র আর উত্তাল হবে না। অগ্নিপাহাড়ে নিঃসঙ্গ হাঁটছে—সুইসাইড নোট।
তুমি কী করছ—রান্নাঘর ডাকছে বুঝি! —তুমি ঝুলে থাকো; স্তনে দৃষ্টি দিয়েছে—অপুষ্ট লম্পট বাদুড়—বললে কবর খোঁড়ার আগেই। ঝুলন্ত গাছগুলো—ব্যাবিলনের ঝাড়বাতি। ইউক্যালিপটাস সন্ধ্যায় আসে আর যায়—পাহাড়ের ছায়ায় তারা কারা! নাটক-নাটক তামাশা—রোদ-রোদ ছায়া—ঝড়-ঝড় ঝড়ঋতু কুয়াশা—ঝর-ঝর ঝরঋতু শ্রাবণধারা—অঝোর বৃষ্টি-বৃষ্টি ঘরমুখর সংসার। রোদচশমা পকেট উপছে ঝরে পড়ছে। বেজির আঙিনায় তাসবিবির লুকোচুরি খেলা। সাপলুডু জাতিসংঘের ড্রয়ারে।
ওরা বোঝে না—ওরা জানে না—ওরা শোনে না…মাথায় উড়াচ্ছে ছাই-ছাই শব্দ। উড়ালসেতু ঘুমিয়ে আছে। পাশবাড়িতে পাশবালিশের—কুতকুত হাসি। তোমার মিথ্যাগুলো—মেট্রোরেলে উড়ে-উড়ে যাবে—আঁকা-আঁকা গোলার্ধ থেকে—বাঁকা-বাঁকা গোলার্ধে। সেনানিবাস থেকে উড়িয়ে দিয়েছি—তোমার মিথ্যা প্রেমের সংলাপ।