সাগরিকা ট্রেন
সাগরিকা, একটি ট্রেনের নাম
পোড়-খাওয়া এক দুপুরে ট্রেনে চড়ে
কোলাহলময় এই শহরে প্রথম ঢুকেছিলাম
বাবার হাত ধরে স্টিশনে রেখেছিলাম পা
বিশীর্ণ শহর, বিপন্ন প্লাটফর্ম
আজও চিৎ হয়ে পড়ে আছে। শতপদী কেরার মতো
সিঁটি বাজিয়ে আসে-যায় জং-ধরা রেলের বগি—
মানুষ ওঠে, মানুষ নামে
পিতা হাত ধরে হেঁটে যায় দুরন্ত বালক
একপাশে হাত পাতে কালের ভিখেরি,
আর পাশে পকেটমা; সুবিধাজনক মুহূর্তের প্রতীক্ষায়—
ইতিউতি গণিকার ইতস্তত বিচরণ,
এরমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি আমি, অসাড় বুক;
জনস্রোতের মৃদৃ আঘাত সইতে সইতে
একটা মুখ খুঁজে বেড়াই—
খুঁজে ফিরি চিরচেনা এক হাসি গমক,
বাবা! নেই!
কেউ নেই;
আমি বিষণ্নপাথর
আর কষ্টে কাতর হয়ে…
ফিরে যেতে চাই সোনালি শৈশবে,
বাবার হাত ধরে আবার
নামতে চাই দীর্ঘশ্বাসের ট্রেন থেকে
হারিয়ে যেতে চাই অচেনা শহরের বাঁকে
বাবা, তুমি ফিরে এসো
চেয়ে দেখো তোমার
রক্তের ফোঁটারা বুক চিতিয়ে ডাকে!
আজকাল ঘুমের ভেতরে প্রায়ই শুনি
বিগত দিনের বিক্ষোভ
আমার শহরাগমন ও পঞ্চাশ টাকার স্মৃতি
মনে পড়ে যায় তক্ষুনি
চিরচেনা খেলার মাঠ
একতলা স্কুল ঘর
আর একটি বিশুদ্ধ গ্রাম
পেছনে ফেলে
যেদিন এ শহরে ঢুকে পড়লাম
সেদিন আশীর্বাদ ভিন্ন
আমার গরিব মায়ের
আর কোনো ওশাত ছিল না
বাবার ঘামে ভেজা
আর অর্ধ শ্যাওলাযুক্ত
পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ছিল
আমার শূন্য হাতের খুঁটি
ওই টাকার কাঁধে ভর করেই
আমি দাঁড়াতে শিখেছি
তাকেও খুইয়ে ফেলেছি একদিন
ইদানিং পাঁচশো টাকার চকচকে নোট
যখন কৈ মাছের মতন
খলবলিয়ে ওঠে পকেটের কিনারে
কিংবা চনমনে হয়ে ওঠে নতুন মানিব্যাগ
তখন চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়
একটি পঞ্চাশ টাকার নোট
ঘাম আর শ্যাওলার মধ্য থেকে
যেন বেড়িয়ে আসে সূর্যের দ্যুতি
আমি চুপসে যাই, পৃথিবীর তাবৎ নীরবতা
মুহূর্তের মধ্যে গুমোট পাকিয়ে আসে
বড্ড একা হয়ে যাই আমি, ভীষণ একাকী।
তখন মনে হয় একটি সাগরিকা ট্রেন
আমার চারপাশে সিঁটি বাজিয়ে ছুটছে
আমি তার আওয়াজ শুনতে পাই!