আদিম রাক্ষসের হাট-বাজার
ফুরিয়ে গেছে সূর্যের সলতে!
ঘুমন্ত প্রকৃতি কুকুরকুণ্ডুলী পাকিয়ে আব্রুহীন নারী এবং নির্লজ্জ পুরুষের গল্প বানায়। কেন্নো-দম্পত্তির গল্প দিয়ে কখনও ইতিহাস রচনা হয় না। তবুও, তারুণ্যের দহলিজে হিংস্র ইতিহাসের জড়াপুটলি। লাশের তক্তপোষে সভ্যতার ইমারত!
রক্তপাত পৃথিবীর ইতিহাসকে পবিত্র করেছে নাকি কলুষিত করেছে,—তার তাত্ত্বিক কিংবা আত্মিক বিশ্লেষণ অস্ফূট ছায়াঢাকা সূর্য-গলানো ব্ল্যাকহোল; তবু, রক্তপাতই জন্ম-মৃত্যুর প্রধান দেউড়ি।
মনুষত্ব এবং পশুত্বের অবাধ দোস্তি সময়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় বেঢপ বোঝা, খাপছাড়া আবেগ টেনে নেয় যৌন-তামাশার পথে,—এর কিছুই জানে না যে; সে জ্ঞানী বটে, তবু তার সীমাহীন অজ্ঞতা। একরত্তি আলো তার কাছে ভূতের আলখেল্লা নচেৎ দৈত্যের সুদীর্ঘ বাহু। নক্ষত্রের ইতস্তত বিচরণকে সে মনে করে আদিম রাক্ষসের হাট-বাজার এবং নরোম ফুলের পাপড়িকে ভাবে ফ্রাস্কেনস্টাইনের দানব; ফলে, শুভ্র-সতেজ মেঘের বালিয়াড়ি তার কাছে ভাসমান কাফন, বাতাসের হিসহিস তরঙ্গধ্বনি গোখরার তপ্তশ্বাস।
পাখির উদ্যত ডানার শব্দে যে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, উড়ন্ত আকাশ তো তাকেই ভেঙ্গে পড়বার হুমকি দেয় বারবার!
বর্জ্রের শিলাখণ্ড যে গিলে খায় পরম বিক্রমে, বিজলি তাকে কুর্নিশ ঠুকে প্রবল সম্ভ্রমে। ঝড়ের পাকবাঁধা ধুলোর চহট যার কাছে সিগ্রেটের ধোঁয়া, ধূসর মেঘের আস্তরণে গেড়ে নেয় যে আজন্ম বসত, তার কেন বৃষ্টির ভয়, ক্ষয়িষ্ণু রাত্রিকে কেন সে মনে করবে ড্রাগনের জিভ?
সময়ের বাঁকা চোখ
তসবির মালায় আটকে থাকা পৃথিবীর বুকে,
রাখালবাঁশির সুর, ঘেটুগান আর মারফতির বড় দুঃসময়;
তাই মৃত-রমণীর নিথর দেহের মতো বর্ণিল রাত্রিতে—
ক্ষেত্রের আলে সমাহিত হয় আবাদজীবীর শস্য-আখ্যান
ঈর্ষার উত্তাপে ঝলসানো হরিৎপ্রান্তরে এখন প্রজন্মের বসতি
বিবেকের রুদ্ধ বেদীতে প্রেতোৎসবের শঙ্খনিনাদ
ফলে, চক্ষুষ্মান অন্ধজনেরা কখনোই দেখেনি—
শুক্ল-রাতে গর্জে উঠা চাঁদের জোয়ার!
প্রেমপ্রস্তাব এবং…
—তোমার ভ্রূ দুখানা উল্টো ঈদের চাঁদ, সত্যি বলি; নয় তো কথার ফাঁদ।
—চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে, আমারও আছে তাই; পথ ছেড়ে দিন আমি এখন বিদ্যালয়ে যাই।
—সুন্দর তুমি, কচুরি ফুলের মতো, কচুরির বুকেও থাকে জলের ক্ষত।
—কচুরি হলো জলের ঘাস, বেদের মতো ভাসে, নিত্য-নতুন বন্ধু ছেড়ে যায় কেবল আর আসে।
—পুকুরজলে রাখলে বেঁধে কচুরিও পোষ মানে; সহজ কথা, বলো কে না জানে?
—আমি যে চাই মুক্ত আকাশ, বদ্ধ জলাশয়? আমার কি তা সয়?
—প্রেম কি কারো আকাশ কেড়ে নেয়? প্রেম তো আরও নতুন আকাশ দেয়।
—বাহ! কত্ত চাপা জানো, চাপা কি ভাই ব্যাংক-মুনাফায় আনো?
—মিথ্যা দিয়ে খুশি রাখার আগে, হেমলক যেন পড়ে আমার ভাগে।
—এমন করে বলছ কেন, আমি মানুষ তুচ্ছ; আমার চেয়ে অনেক ভালো চড়ুই পাখির পুচ্ছ।
—নিজকে যে তুচ্ছ ভাবে, বড় ভাবে না; আমি তাকে প্রণাম ঠুকি, সেলাম করি পা।
—ছি ছি! এমনি কেন বলো, দেবার মতো আমার আছে কী, আমি হলাম কষ্টে-কাতর, ব্যথার অতিথি।
—কষ্ট কিছু আমার কাঁধে দেও, আমায় তুমি তোমার করে নেও।
—না না, এ যে ভীষণ রকম পাপ, প্লিজ; আমায় করুন মাফ।
—প্রেমকে যারা আখ্যা করে পাপ, তারাই প্রেমের সাধক, অন্যেরা যে কেবল তবল বাদক।
—পারবো না গো পারবো না; প্রেমের অংকে আমি অনেক কাঁচা, আমার পক্ষে সম্ভবই না এসব নিয়ে নাচা।
—কাঁচা হলেই পাকতে পারে, জীবন ছবি আঁকতে পারে।
—প্রেমে থাকে লজ্জা এবং ভয়, এসব কিন্তু আমার জন্যে নয়।
—ঝড় যে থাকে কালো মেঘের খামে, বিজলি দেখে বৃষ্টি কি তাই থামে?
—এত্ত কথা কোথায় যে পাও তুমি, কাঁপন তোলে বুকের বেলাভূমি।
—তাই! হাতে যদি সময় থাকে একটু কোথাও যাই?
—উফ! আমার যে কী হলো! ওকে, সমস্যা নাই, চলো…
বনসাই জীবন
একটা স্বেচ্ছাচারী মেঘ খঞ্জনের মতো উড়ে এসে
শুভ্রতার প্রকোষ্ঠে জন্মানো প্রত্যাশার উপসর্গগুলো
বারবার লণ্ডভণ্ড করে দেয়
নিভৃতচারী স্বপ্নেরা সারভাইকেল ডিস্ক প্রল্যাপ্সে আক্রান্ত
তাই অতীতচ্যুত বনসাই দিনগুলো বৃন্দস্বরে বলে উঠে-
স্ত্রৈণ-জীবন নগ্ন ট্রেনের বগি
তারপরও প্রাকৃতিক ইথোপেনের স্প্রে
দিব্যি বেঁচে আছি; হয়তো-বা ভালও আছি—
একজন বিপ্রতীপ মানুষ হয়ে
ক্রমশ
ক্রমশ বড় হয় শহর, ছোট হয় গ্রাম।
পাথরের কাছে হেরে যায় মানুষ
মাটির গন্ধ এবং নদীর উচ্ছলতা—
ধীরে ধীরে ছিঁড়ে যায় যুগের বন্ধন
ক্রমশ খাটো হয় পৃথিবীর বহর
দীর্ঘতর হয় বিদ্বেষের কালো রেখা
ফুলের কোমলতা, পাখির কোলাহল
ক্রমাগত থেমে যায় শিল্পের স্পন্দন
তবুও পথচলা থেমে থাকে না কারো
অস্ত্রের আঘাত থামাতে পারে না জন্ম
ক্ষণকালের বাধা, হাজার রকম ধাঁধাঁ-
শুদ্ধ আলো রুদ্ধ রেখেছে কোন কালে?
দাঁড়িয়ে আছি আলো-আঁধারির গ্রীবায়
বাতাসি পর্দায় দুলে উঠবে সেই মুখগুলো-প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আর বছরের পর বছর-বাদশা সোলায়মানের মতো ক্লান্তিহীন দাঁড়িয়ে আছি একা, ভীষণ একাকী-পদতলে গজিয়ে ওঠা শিকড় ঝাপটে ধরেছে তাবৎ বিশ্ব-তবুও খুঁটিহীন, নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী-আলোর আদতে নিঃসীম অন্ধকারের গিরিগুহায়-প্রতিদিন অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস আমাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায়-শরীর ঘেঁষে ছুটে চলে কত সতী এবং শয্যাজীবী নারী-চোখ খুললেই সাধু-সন্ন্যাসীর পেছনে চোর-ডাকাতের দঙ্গল আমার চোখের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে-কত দস্যু-জানোয়ারের সাথে যে রাত কাটিয়েছি আমি!
বহুবার আমি স্তম্ভিত হয়েছি মান-হুঁশহীন মানুষের রঙ্গলীলা দেখে-আমারই চোখসম্মুখে সর্পদংশনে নীল হয়েছে লক্ষ্মীন্দর-বৈধব্যের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে বেহুলা-বহুকাল উৎফুল্ল মানুষের পেছনে দাঁড়িয়ে আমিও অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছি এবং দুঃখী মানুষের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও অবিরাম কেঁদেছি কত কত রাত!
আলো-আঁধারির প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে রাধা আর কৃষ্ণের প্রেমলীলায় মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ইয়াজিদের নির্মমতায় আমি শঙ্কিত হয়েছি যুগযুগ ধরে।
রোদ, বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ আমাকে কখনোই নতজানু করতে পারেনি-আমার চোখের অগ্নিতে পৃথিবী পুড়ে ছাই হয়েছে বহুবার-তারপরও কুটিরশিল্পের মতো স্বপ্নীল অঙ্গদগ্ধতায় বেঁচে আছি আমি! কোথাও দেখিনি চিরপ্রত্যাশিত সেই মুখগুলো!
আজও ফেরেননি আল-আমিন উপাধি নিয়ে জগৎশ্রেষ্ঠ একজন মোহাম্মদ, আজও ফেরেননি অস্থিমজ্জা উৎসর্গ দিতে একজন দধীচি-অহিংসবাণী, জ্ঞানের প্রদীপ এবং বিপুল আত্মপরিচয় নিয়ে এক একজন গৌতম বুদ্ধ, যিশু খ্রিস্ট, সক্রেটিস আবার ফিরে আসবেন কখন-এ প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছি, এই বর্ষার রোদনে; গ্রীষ্মের উত্তাপে এবং শীতের কুয়াশা চোখে নিয়ে…