সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কবিতা ॥ মাসুদুল হক
কান্না
মেয়েটি কাঁদছে। সামনে আগুন
উঠানে তুলসীগাছ;
পেছনে আজানের ধ্বনি। উড়ছে ধোঁয়া
এই কান্নার কোনো ধর্ম নেই!
বৈপরীত্য
প্যালেস্টাইন,কাশ্মির কি পশ্চিমবঙ্গে
মুসলিম মার খেলে সে চোট লাগে আমার অঙ্গে
তালেবান জিতে গেলো আমি জিতে যাই
অথচ একই হাওয়া, জলে ও ভাষায়
হাটে বাজারে ও ভিড়ে
ধানের ক্ষেতে
নদীর ঘাটে
হালখাতায়
বৌশাখের প্রথম দিনে
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
পাটে ও পাতায়
একই স্বভাবী খাদ্যে
নজরুল রবীন্দ্র লালনে
ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি মারফতি গানে
কবিগানের তর্কে পাশাপাশি থেকে
রক্ত লালা ও শরীরে মিলেমিশে
আমরা বাঙালি হলেও
তবু হিন্দু আর মুসলমান!
হিন্দুপাড়া-২০২১
চেনা মুখ অচেনা হয়ে যাচ্ছে।
আগুনে পুড়ে থমথমে মুখে
তাকিয়ে আছে হিন্দুপাড়া!
পোড়াগন্ধে
আবার ম্যাজিক দেখিয়ে চলে গেলো
. জাদুকর।
মনের ঘর থেকে আনন্দের ধারা
ঠোঁটের অভিব্যক্তিতে
হিন্দুপাড়ার মানুষ ফুটিয়ে তোলা যে নামে
সেই হাসিটুকু গুম করে
সম্প্রীতির মঞ্চ থেকে
আগুনে ও হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো জাদুকর…
মানুষ এখনো সর্বহারা
সাঁওতাল বাড়িতে বাঁশের আগায় থাকে ঝাড়ু
মুসলমান বাড়িতে চাঁদ-তারা
হিন্দু বাড়িতে তুলসীগাছ
খৃষ্টান বাড়িতে যিশুর ক্রুশ
বৌদ্ধদের আছে ধর্মের চাকা!
প্রকৃত মানুষের কোনো বাড়ি নেই;
মানুষ এখনো সর্বহারা!
ধর্ম
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি
মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব
আর ধর্মের নামে যা চলছে
তা কেবলই সংস্কার
মৌলবাদের চাপে মনুষ্যত্ব আজ
বড় ক্লান্ত;
জেগে উঠেছে সংস্কার
মসজিদ-মন্দির ভেঙে
যে যার ধর্মকে বড় করতে
তাই বুঝি মানুষ তুলেছে হাতিয়ার!
ভাগের চালচিত্র
১৯৪৭
হিন্দু বলে হিন্দুস্থান
মুসলমানের পাকিস্তান
বাংলার কেউ নাই
নেতাজি শুধু পোস্টারে
২০২১
ভূগোল পেরনো কঠিন
দেশ ভাগের ছটাক
পরে থাকে তত্ত্বের পাল্লায়
কুমিল্লায় ওজন মেপে
আগুন লাগে পীরগঞ্জে
ভোট জোটে ত্রিপুরায়!
সকল প্রশংসা মানুষের
সকল প্রশংসা মানুষের!মন্দিরের চূড়ায়
সর্বভূক পাখিটি গোমাংস ঠোঁটে বসে পড়লে
আরো একটি দাঙ্গার খসরা লেখা হয়ে যায়
হনুমানের কাছে কিতাব পড়ে থাকলে
হিন্দুপল্লীতে আগুন লেগে যায়
সকল প্রশংসা মানুষের! ধর্মসভায়
শান্তির কথা শ্রবণ করে
প্রতিবেশী শান্তির ঘরে আগুন লাগায়
সকল প্রশংসা মানুষের! পূর্বে
লাগা আগুন, নির্বাচনের আগে পশ্চিমে যায়
সম্প্রীতি ॥ অলকা ঘোষ
সুবোধ সুশীল মুগ্ধ প্রীতি সন্নিধানে
সম্প্রীতি লালিত বক্ষে ধন্য ধনে-মানে।
সমপ্রীতি ভালোবাসা সৌহার্দ্য সম্মান
সহ্য ধৈর্য লোকাচার ত্রাণ প্রতিদান
সামাজিক দেয়া নেয়া ত্যাগে বাড়ে মায়া
শুদ্ধ প্রেম স্বার্থহীন যাচে শান্ত ছায়া।
দেশে দেশে হানাহানি ধর্মে কোলাহল
ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই ভাঙিছে অর্গল,
অকপট বিশ্বাসের মূলে সন্দিহান
হিংসা দ্বেষ আস্থাহীন, পর্বত প্রমাণ
অস্বস্তি অশান্তি বর্ণভেদ অনাচারে
মানুষে মানুষে শ্রেণী ব্যবধান বাড়ে।
মলিন বিরস আজ কেবা শঙ্কাহীন?
নিরেট কপট হাতে বন্দি শক্তিহীন
আভিজাত্য হারিয়েছে ভীত সমপ্রীতি,
ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, লোকাচার রীতি
অন্ধ সুখ মত্ত, শিরে ভেঙে পড়ে ছাদ
ধানপোড়া গন্ধ ভাসে, শুনি আর্তনাদ!
শিশুর ক্রন্দন, নারী কণ্ঠে হাহাকার!
সন্দিগ্ধ অন্তরে কান পেতে হারাবার
ভয়ে চুপ থাকি। নেই মধুর সুবাস
উষ্ণ হৃদয়ের পাশে কবিতায় বাস
নেই তার আগেকার স্নিগ্ধ ভালোবাসা
ভুলে গেছে কাছে টানা হারিয়েছে ভাষা।
সম্মোহিনী ভাবহারা রিক্ত বনবাসে
প্রেমিকেরা মত্ত সম্প্রীতি চাষাবাসে।
অভিধান খুলে দেখা ভুল যদি হয়
নিরীখে নির্যাস খোঁজে সন্দেহ সে নয়।
কোথায় পাবে সে মান সম্প্রীতি আহ্বান
সম ভালোবাসা প্রেম সমান সমান?
আহ্লাদিত সম্প্রীতি আবেগ উচ্ছ্বাস
বিষাদিত ক্ষুণ্ন আশা ভুলেছে বিশ্বাস
চলে গেছে ভেসে দূরে জলে বিসর্জনে
অভিমানে অন্ধ চোখে ম্রিয়মান মনে।
হিরোশিমা নাগাসিকা জ্বলেছে অন্তর
ভিয়েতনামের কথা? সপ্ত নৌবহর
জালিয়ানোয়ালাবাগ নাইট কে চায়?
রানি এলো নগ্নপদে শোধ করে দায়
সাতচল্লিশের ভাগে কত পায় কেবা
একাত্তরে বীর যোদ্ধা করে দেশ সেবা।
মিছিলে সামিল কে সে জলপরী রূপে
স্বর্ণ রৌপ্য কুঠারিকা নিয়ে জলে ডুবে
যায়, সামনে দাঁড়িয়ে কবি নজরুল
সাম্যের ঐক্যের গানে ভেঙে দিতে ভুল।
আমি ভালো তুমি মন্দ উত্তম অধম
চিরকাল ব্যবধান বাড়ে হাসে যম।
ধর্মে দ্বন্দ্ব ভোলে নাই যুগান্তের শাপ
যাতনার মর্মমূলে ফণা তোলে সাপ।
বৈরী বাতাস শেষে অরুণ উদয়
সম্প্রীতি জাগুক হেসে মানব হৃদয়।
পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া ॥ গোলাম কিবরিয়া পিনু
শ্রমজীবী মাঝি ও জেলেরা
. নদী ও জলের সাথে যাদের একান্ত সখ্য,
যারা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায়
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমিষচাহিদা মিটিয়েছে!
. তারাও আক্রান্ত!
তারা তো শুধুই নিজের ভিটেয়
প্রকৃতির আলোবাতাসের অধিকার নিয়ে
. বাঁচতে চেয়েছে!
মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বস্বান্ত হয়ে
. সীমান্তের ওপারে গিয়েছে শরণার্থী হয়ে
আবারও এসেছে ফিরে নিজের পোড়ামাটিতে,
এসে অবশিষ্ট কিছুই পায়নি!
তারপরও তিল তিল করে—খড়কুটো যোগাড় করে
শ্রম ও কষ্টের বিনিময়ে
. জীবনকে সাজিয়ে তুলেছে!
ওদের মাছের সাথে দই খেতে পারছো বলে তুমি
তাদেরই ওপরে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছো আজ?
. কাণ্ডজ্ঞানহীন মূঢ়তায়!
ওদের পোড়াচ্ছো!
. পোড়াচ্ছো বিবেক!
. পোড়াচ্ছো সংবিধান! পোড়াচ্ছো মুক্তিযুদ্ধ!
চপেটাঘাত আইনে—থাপ্পড় মারছো শান্তিকে!
মানবতা আর সভ্যতার বুক ছিঁড়ে
লবণ লাগিয়ে দিচ্ছো—বিষপিঁপড়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছ!
কার আর্তচিৎকারে শোনো শুধু?
ফরজ কাতারে ॥ আজিজ কাজল
ছুতা নিয়ে করো চুরি আট কুঠুরি নয় দরজা
মুশকিল আসান করো ভুল ফাঁরায় তুলো ছিপ
নিজ ঘরে মওকা ভুলে পরচুলে দাও গরজা
মধু চাক ফুলে ঢুলে ভারি হলে, মেরে দাও টিপ
বারোমাস প্রকৃতির কুলে থাকি পেয়েছ যা সোনা
নিজ চেতনে ভুলে যাও, ফাঁকা আলোয় দাও টোপ
পুনঃবার কেন ঠেলে দাও, বলো মারো শত টোনা
নিজ পায়ে ফেলো কুঠার, নিজ ডালে তে মারো কোপ
হবে না সমাধা কোনো, যদি থাকো ভুলে সিন্ধু দান
ফুরেনি নিজ স্রোত-গান, ধীরে বয়ে যায় হাওয়া
নিজের পিড়েতে করো চান আবারও খুলো ধাম
আসিবে নুরে খনি, আগে করো নিজ ঘরে নাওয়া
বিবেক দরিয়া মাঝে, হসন্ত মেরে আছ তো বেশ
দাঁতে দাঁত চেপে, থাকে কি তার বলো বাকি বত্রিশ?
প্রতিবাদে ফাটি হয় না বমন, গিলি পক্ক কেশ
গলা ডোবার নেই আর বাকি নয়-ছয় ছত্রিশ
দাও ভালবাসা সম্প্রীতি, সূর্যমুখি ফুলের ধীর
নিজ কাথা নিজ গায়ে তুলো-ফের আশপাশ ভুলে!
বর্ণভেদ খুলে মানুষ ভজো, জড়াজড়ি হও বীর
দলা মেঘের ছদ্মবেশ খুলে, নাও বিনয় তুলে
ধর্মের লেবাসে হিংস্রতা নিন্দনীয় ॥ রানা জামান
যেকেনো বিদ্বেষ মানুষের চরিত্রের পরিপন্থী
বিচারিক বিশ্লেষণে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বে আসীন
স্বীয় গুণাবলি ভুলে মানুষ হিংস্রত্বে পশুর অধম
খুনোখুনি মারামারি আর জ্বালাওপোড়াও সুযোগ পেলেই
ধর্মের লেবাসে হিংস্রতা অনেক নিন্দনীয়
সকল ধর্মই শান্তির বাণীর মৃদুমন্দ বায়ু
নিজ নিজ ধর্ম পালনে হিংস্রতা বাড়ায় না পূণ্য
মানুষ সৃষ্টির পর হতে আত্মীয় স্বরূপ-
আকারে আচারে খাদ্যে বাসস্থানে
মিলেমিশে সহাবস্থান-ই মানবতা
সরেন ডেভিড জসিম-কেবল নামেই ভিন্নতা
পরস্পরকে রক্ষা করা বিশাল মানব ধর্ম
অথচ ক্রমশঃ মানুষ পশুত্বে করে নিচ্ছে স্থান
পশু-পাখি হাসে নিশ্চয়ই মানুষের অধপাতে
মানুষ মানুষে থেকে মনুষ্যত্বে থাকো অনিবার
হিংস্রতা বিস্তার ঘটায়নি কখনো কোনো ধর্মের
বকধার্মিক চিহ্নিত করে ঠেলে দেই আস্তাকুঁড়ে
মানবধর্ম মেনে নিজ ধর্ম পালনে প্রশান্তি অনাবিল!
ধর্ম যখন হাতিয়ার ও অন্যান্য ॥ মো. আরিফুল হাসান
ধর্ম যখন হাতিয়ার
যন্ত্রপাতি, খুচরো কেনাবেচা, এসব এখন মানুষের দামে চলে
ভালোবাসা অথবা ঘৃণা বয়ে চলে মসনদের চোরাকারবারে।
তুমি বললে—ভালোবাসা, উফ্!
সম্পর্ক ও সন্ধিপত্র এখন লেখা হয় বালির হরফে অস্পষ্ট
বিশ্বাস, সমুচ্চারণ, সম্প্রীতি নিতান্তই পয়সা দিয়ে কেনা খেলনা
তুমি বললে—ওহ্ ঘৃণা, উফ্!
রাষ্ট্র কতগুলো নিরেট অক্ষরের সমাহার, জনতা শব্দের
ভাষাগুলো একেকটা সেলাই করা মুখ, মুখগুলো অজস্র মুখোশ।
পরাজিত রক্তের ইঙ্গিত
এ কোন আগুনের খেলা খেললে পিচাশ
মানচিত্র পুড়ে গেলো, ভাই হলো লাশ।
এ কোন বর্বরতা দেখালে আবার
একাত্তরের পর পুনরায় এ কোন আঁধার
ছড়িয়ে দিয়েছ ভোরে, লাল সূর্যপুরে
থমথমে রাত নামে, বাংলার ঘরে ঘরে।
যদি মানুষ হও, হও মৃত্যুগত প্রাণ
সংখ্যালঘু নির্যাতন রুখে বাঁচাও সম্মান।
মানুষের আসল ছদ্মবেশ
দাঙ্গার বছর, আমি তখন জন্মাইনি
তখন দুয়েকটি ইঁদুর যব ক্ষেতে
প্রহরা বসায় সমঅধিকারের।
সে বছর দাঙ্গা, আমি তখন জন্মিনি
তখন দুয়েকটি শয়তান ধর্মালয়ে বসে
ছুড়ে দিচ্ছে অধর্মের প্রথম পাঠ।
যখন আমি জন্মালাম, তখনও দাঙ্গা
একদল সভ্য মানুষের মুখোশে
কি করে শেয়াল কুকুর ঢুকে গেলো!
তুমিও তাবৎ রংধনু
কী করবে? যুদ্ধ? তুমিও তাবৎ রংধনু
বয়স্কে যে বাতায়ন ধরা থাকে
সেখানে দেখেছো আগুনের স্বরলিপি।
অদৃশ্য আগুন থাকে ভেতরে। হে জন্ম,
মানুষের কোলাহল ভুলে
আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
দাও নিষিদ্ধ নগরে এক গ্লাস জল
পান করে হেমলক ভেবে শুয়ে থাকি
কী করবে? যুদ্ধ? তুমিও তেমন রংধনু।
ভুলে গেছে শেষ গোলাপ
একটি গ্রাম ছিলো, সুন্দর।
উত্তর দিক থেকে বাতাস আসলে
লোকেরা বুঝতো শীত আসছে
দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস আসলে
লোকেরা মেনে নিতো গ্রীষ্ম অাসবে
আর এলোমেলো বাতাস বইলে
মানুষেরা মনে করতো বসন্ত আসন্ন।
মানুষগুলো অনেকদিন বসন্ত দেখে না
তারা ভুলে গেছে শেষ গোলাপ
কবে ফুটেছিলো, শেষ কোকিল
কখন ডেকেছিলো আর মানুষগুলো
এখন শীত ও গ্রীষ্মের প্রভেদ বুঝে না।
গ্রামটি শহর হয়ে গেলো, সেই সাথে
অসংখ্য বন্ধন পড়ে থাকলো
বালি ভরাটের ফাঁকা প্লটে
আর মানুষগুলো উড়তে লাগলো
আকাশ হয়ে, পাখি হয়ে
ধূমকেতু হয়ে, নক্ষত্র হয়ে; ছাঁই হয়ে।
ভালোবাসায় বাঁচব ॥ স্বপন শর্মা
মৌলবাদী রক্ত শিরায় চলছে অক্সিজেনের মতো
গোঁড়ামি তার আষ্টে পৃষ্ঠে যাচ্ছে ঢেকে অবিরত।
কুমিল্লা আর রংপুরে তা কাল অশনি যাচ্ছে দেখা
রাজনীতিতে হচ্ছে গ্রাস অসাম্প্রদায়িক ভাবনা রেখা।
তোমার ঈদে আমার পুজোয় উৎসবে হয় মহামিলন
কেউ কখনো দেখেনি তো ভাবেনি যে হবে এমন।
মনের ভেতর মৌলবাদী করছ লালন জনম ধরে
সুযোগ পেয়ে দিচ্ছ আগুন অসহায়ের বসত ঘরে।
হিন্দু, মুসলিম নয় পরিচয় মানুষ যদি হতে পারো
প্রতিবাদের স্লোগান মুখে প্রতিরোধে জাগো আরও।
হৃদয় পুরে ময়দান জুড়ে অসম্প্রদায় রোপণ করো
আপন ভেবে অন্যের বাহু শক্ত করে আবার ধরো।
তোমার আমার বন্ধুত্ব হোক দাঙ্গা-বিবাদ যাক সে দূরে
আবার আমরা বাঁচতে যে চাই ভালোবাসার নতুন সুরে।