সকল গাছই কবি
গাছেরা কবিতা লেখে—জন্মগতভাবেই তারা কবি
জ্বলজ্বলে অক্ষরে অক্ষরে শব্দে-বর্ণে সাজানো সব কবিতা।
সকলেই সেসব কবিতা দেখে না
কেউ কেউ দেখে।
অতি শীতে গাছেরা অভিমান করে; তখন
তারা কোনো কবিতা লেখে না। বরং তাদের সঞ্চিত
কবিতার পাতাগুলো মাটিকে উপহার দেয়
মাটিও বোঝে সেই কবিতার কথা
কেননা মাটি যে গাছেদের মাতা।
বসন্তই তাদের কবিতা লেখার শ্রেষ্ঠ সময়
তখন কোকিলেরা কবিতায় ছন্দ বোনে
আর নানা রঙের পাখিরা
কবিতা পড়তে আসে গাছেদের বাড়ি
বৃষ্টির রিমঝিমে কবিতারা গান বাধে
সে গানে সকলেই সুরলিত হয়—মানুষ বাদে!
মানুষ তো হত্যা করে—কবিরা কি পারে?
সন্ধ্যা তবু প্রেমময়
সন্ধ্যা এক নিয়ত আশ্চর্য!
সে যে কোন পক্ষের, কখনো জবাব পাইনি।
না রাতের, না দিনের।
দিনের কার্যবিলাস অথবা ক্লান্তি সন্ধ্যাকে হাতছানি দেয়।
আবার রাত এলে পিছে ফিরে চলে যায় অবলা কথায়।
ধরে নেই সন্ধ্যা এক ভাষাহীন রমণী।
ক্লান্তি জুড়াতে প্রশস্ত বুক আছে তার,
রমণ ক্রিয়ায় ভীষণ শৈল্পিক ও আবেদনময়ী।
এ ক্ষেত্রে সন্ধ্যা হচ্ছে, প্রেম ও মিলনের অমোঘ বন্ধন।
হতে পারে সন্ধ্যা শুয়ে থাকা সাগরের মতো,
বুকে তার অবিরত ঢেউ।
আমি তো এই সন্ধ্যার অপেক্ষায় ক্লান্তি ছিঁড়ে ফেলে
ছুটে যাই দৃষ্টির অনন্তে…
আমি তো দিনের এক ক্লান্ত প্রেমিক।
দেখি, প্রসারিত বুকে বিগলিত সন্ধ্যার রঙের ঝলক!
সন্ধ্যা তাকিয়ে থাকে আকাশের পানে, কত রঙে প্রেম প্রলোভনে।
কিন্তু সন্ধ্যা তো রমণী নয়!
ছুঁতে ছুঁতে রাত থেকে রাতে গভীর রহস্য মায়ায়
কোথা যেন চলে যায় নটিনী তরঙ্গে।
আমি তার পক্ষ চিনি না। জানি না রহস্য কোনো।
তবে সন্ধ্যা রমণী নয়, আশ্চর্য রমণীর মতো!
না দিনের, না প্রেমিকের।
রাতেরও নয়, তবু সন্ধ্যা প্রেমময়।
কন্যা, তীর্থ সমাধিতে
গল্পের সিঁড়ি টপকে টপকে কন্যা যাচ্ছে তীর্থভূমে
আঠারো বছরের গল্প জমা আছে ওর ভেতরে
গল্পগুলোকে আরও আরও গল্প বানিয়েছে ভেতরে ভেতরে
দীর্ঘপথ তাকে কোনো ক্লান্তি পরাজিত করে না
একটা একটা করে সিঁড়ি টপকাচ্ছে সে
একটু একটু করে স্বপ্নের বরপূত্র তার নিকটবর্তী হচ্ছে!
আমি কন্যার মুখের দিকে তাকাই আড়ালে আবডালে
বুঝে নেই, ওর গল্পগুলো ডানা মেলতে শুরু করেছে
গল্পগুলো সবুজ ধানের অফুরান মাঠের মতো
গল্পগুলো দূর গায়ের শ্যামলিমা তরুর মতো
সিঁড়িগুলো একটা একটা নদীর সেতুর মতো
সিঁড়িগুলো একটা একটা কাল আর মহাকালের মতো
কন্যা মধুমতির বাতাসের আর্দ্রতা অনুভব করলো।
কন্যার বয়স তখন অনেকগুলো আঠারোর সমান হয়ে গেলো
ওর ভেতরের গল্পগুলো ভ্রমণরেখার বাঁক-প্রান্তরে মিলিয়ে নিলো।
সমস্ত সিঁড়ি পেরিয়ে কাল মহাকালের এক সন্ন্যাস বুকে নিয়ে
টুঙ্গিপাড়ার তীর্থ সমাধিতে প্রবেশ করলো কন্যা।
তার বুকে জমানো সমস্ত গল্প মহাগ্রন্থ হয়ে এক হয়ে গেলো
তার মৌনতার শ্রদ্ধার্ঘে আমিও তার সাথে দু’হাত তুলে দাঁড়ালাম
কন্যার মুখের মহাগ্রন্থের মলাটে দেখি,
জ্বলজ্বলে এক নাম, শেখ মুজিবুর রহমান।
কে জানতো…
কোনো কিছু না ভেবেই ধরেছিলাম, হাত দুটি যার
কে জানতো, বর্ষাতে এমন স্পন্দন জাগে ভৈরবী মায়ার!
কে জানতো, বর্ষার কদম জোর করে ধরবার নয়?
কেই বা জানতো, আষাঢ় শেষে কদম আর বৃক্ষে থাকে না…
কদম কি বারবার একই ডালে হেসে হেসে ফোটে?
কোন কিছু না ভেবেই ফুল ভাবি যারে
কে জানতো, বৃক্ষের বল্কল ভাষায় বয়স চেনাবে তারে!
কে জানতো, বল্কল শরীরে কখনোই ফোটে না ফুল?
কেই বা জানতো, ফুল আর বল্কলে কখনো হয় না মিলন…
একই ফুল বারবার দেবতার অর্ঘ্যে কী জোটে?
কোন কিছু না ভেবেই দিয়েছিলাম মনটাকে যে হাতে তুলে
কে জানতো, বর্ষা পেরিয়ে আসে পৌষ, আবারো বর্ষা, ফের ভুলে!
কে জানতো, দ্রবীভূত মেঘ উড়ে যায় অশ্রু ঢেলে, পাহাড়ী মায়ায়?
কেই বা জানতো, পাহাড়কে ছুঁতে হলে কত বেশি প্রেম লাগে…
বারবার একই মেঘ ভালোবেসে, কতবার নিতে পারে লুটে?
আমার আছে বৈশাখী ঝড়
কেমন করে পাহাড় চূড়ায় বাতাস বহে—সাগর তীরে ঢেউয়ের সাথে
গাঙচিলেদের কথকতা—শুনতে তুমি, দেখতে তুমি পাও কি?
সাগর নোনা জলের মাঝে জলকেলি মাছের খেলা
ফসফরাসের ফেনার ভেলা—হাত দিয়ে ঠিক ছোঁয় কি?
তোমার মাঝে সাগর আছে; ঢেউয়ের মাঝে ঢেউ রচে যাও,
পাহাড় আছে সূর্য ধরো—তুমি বিশাল, তুমি বৃহৎ তাদের চেয়ে কম কি?
সাম্পান নাও আমায় ভাসায়—তোমার বুকে; দিকহারা এক
পাগল আমি, নেশায় নেশায়—ভরা নদীর সুখ যে আমার, জানো কি?
কোমল সুরে, বনে বনে হৃদয় ছিঁড়ে, কোকিল কেমন গান গেয়ে যায়—
ডাক দিয়ে যায়, ভর দুপুরে। বলো, তখন তোমার হৃদয়বীণা বাজে কি?
আমার আছে বৈশাখী ঝড়, নীল আকাশে শালিক ওড়া
সবুজ বাতাস ঢেউ খেলা গান; এসব তোমার সবই জানা—
নদীর চরে বালির খেলা, সূর্য-বালির রোমন্থনে—জলের শব্দ কলতানে
ভর দুপুরে উদাস ভবে, এক হয়ে যাই সুতার টানে—সেটাই বলো কম কি!
সুন্দর পাপ
আমার সুন্দর পাপগুলো কখনোই হাপ ধরেনি
তোমাকে দেখতে দেখতে
জলে নামি, ধেয়ে আসা জলের নহরে—তুমি;
আকাশেও উড়ি, পাখির পাখায়—তুমি;
মৃত্যুকে ভাঙি কক্ষরেখায়, সেখানেও তুমি! আর
তোমাকেই দেখি; দেখে দেখে নিরন্তর পাপ করি।
এই কুসুমিত পাপ, পল্লবিত পাপ
বাগানের ঈর্ষার গোলাপ হয়—সুন্দর সাহসে।
কখনো তোমার নির্জন উপস্থিতির ভাঁজ খুলে খুলে
পাপ বাগানের সিক্ত পাপড়ির গালিচায়
রাম-সীতার বাসর হয়!
আর তোমার নির্মীলিত চোখ থেকে ঈশ্বরের
গাঢ়পুণ্যি রঙ নিয়ে পাপেদের ঘরের দেয়াল গড়ি।
আমার সুন্দর পাপগুলো সেই পুণ্যির দেয়ালে
বন্দি করে আবারও পাপের সেই সুন্দর সাহসে
ঈশ্বরের ইচ্ছায় ইচ্ছায় পল্লবিত করি।
ঈশ্বর! কেন এত সুন্দর পাপ দিলে!
না, কোনো সহজ কথা না
না, আর কোনো সহজ কথা না
দীপ্যমান অহংকারের কথাও নয়;
নয় বিবর্তনবাদের কথাও
কোনো স্মৃতির বেগবান অতীতও নয়;
নয় কোনো বীভৎস শোক ও কান্না
আমাদের মাঠগুলো সবুজ জমিন
কোল ঘেঁষে যার নদী খাল জলাশয়
আমাদের মাঠগুলো পিতার পৌরুষ কর্ষণে
শস্যে শস্যে ভরিয়ে দেয়
সেই পিতারা সুলতানের তুলিতে
বীর্যবান অহংকার হয়ে ফুটে ওঠে।
আমাদের মাতারা নদী জলের মতো প্রাণসঞ্চারী
আমাদের মাতারা বুকের উলানে রাখে
খাদ্যের সম্ভার, প্রেরণার প্রেমময় আধার।
সেই মাতারা কামরুলের তুলিতে
কত না রূপকথার রঙিন ভাস্বর!
এ সবই জীবন্তু কিংবদন্তী!
এ সব কথা না—না, কোনো সহজ কথা না।
আমাদের শব্দরা, চর্যার নদীতে সাঁতার কেটে
আমাদের ইতিহাস, রক্তের নদীতে সাঁতার কেটে
বিক্ষুব্ধ ঢেউ পেরিয়ে কুলে এসে উড়িয়েছিল জয়ের নিশান।
চর্যার ঢেউ ভেঙে ডিঙ্গিকে সম্বল করে
এসেছেন কত কাপালিক-আচার্য!
হালধরা মাঝি সরহ পা, লুই পা, কাহ্নু পা, ভুসুক পা
পাল তুলেছিলেন পরম্পরায় হরপ্রসাদ, সুনীতি, শহীদুল্লাহ।
না, এসব আর কোনো সহজ কথা না।
আমাদের ইতিহাসের মাঝিরা কাপালিক ছিলেন;
আমাদের মাঝিরা কাপালিক থেকে আচার্য হয়েছেন;
আচার্য হয়ে মানুষ হয়েছেন—হয়েছেন
ক্ষুদিরাম, সুভাস, রফিক, জব্বার, শফিক, আসাদ।
সেই মানব থেকে মহামানব হয়েছেন—হয়েছেন
রবীন্দ্র, লালন, নজরুল, জীবনানন্দ, শেখ মুজিব।
জয়নুলের তুলিতে, আব্বাসের কণ্ঠে কিংবদন্তী হয়েছে
আমাদের প্রেমের শিল্পাবাস ও মরমী সুর।
না, এসব আর কোনো সহজ কথা না।
তারপর আমরা বিবর্তিত হয়েছি
ঘনকালো আঁধারকে আলোকিত করেছি
সমস্ত সৃষ্টির রহস্যকে মুঠোবন্দি করেছি
সেও কোনো কথা না।
আমাদের বহতা নদী শুকিয়ে বন্ধ্যাচর,
মায়েদের উলান শূন্য! তাঁদের
কৌমুদী মুখগুলো শতচিরে বিভক্ত আজ!
আমাদের কুলীন পিতারা সূর্যের আগুনে পুড়ে
সাষ্টাঙ্গ শুয়ে শস্যের জন্য করছে হাহাকার
এসব সহজ কথা প্রতিপদের আঁধার থেকে ধেয়ে এসে
অঙ্কুশ আঘাতে রক্তাক্ত করে যাচ্ছে নিয়ত!
আমরা হারিয়েছি মরমী ও প্রেমের শিল্পাবাস
মানব, মহামানব ছেড়ে কঠিন ও জটিল ভাষায়
পোড়া জমিনে করেছি মিথ্যার বিষাক্ত আবাদ, গড়েছি আবাস
এখন সহজ করে নিঃশ্বাস নেই দীর্ঘশ্বাসের মতো!
দৃশ্যের মাঝে অদৃশ্যের ফারাক
একটা নদীর এপার ওপার দুইটি তীর
মানুষের কি তেমনই?
এই যে আমি হাসছি যেমন
ভাবছি যেমন, দেখছি যেমন
মাঝখানে এক নদীর মতোই ঠিক ব্যবধান
কিংবা কোনো জোড়লাগা এক চিহ্নচিড়!
একটা নদীর এপার ওপার দুইটি তীর
একটা পাখি এক জীবনে এক থাকে না
সঙ্গি থাকে, জীবন যাপন চেনা জগত,
প্রেমপার্বণ—কী থাকে না? সুখ শ্রাবণের মেঘ আকাশে
উড়াল ডানার দখল নিয়ে পাখিরাই তো ভাসতে থাকে
তবু কিন্তু হয় না মিলন ডানায় ডানায়, কী ব্যবধান!
স্বপ্নপাখির সুরগুলো তাই এক থাকে না
একটা পাখি এক জীবনে এক থাকে না।
সূর্য আমার একুশ নামে
সেই তো ছিল তোমার কথা জাজ্বল্যমান আজও
বিশ্ব কেমন বাসলো ভালো, কাঁদলো আরও শোকে মুহ্যমানও
তোমার কথা, আমার কথা, সবার কথা,
কাঠবেড়ালি-টিয়ের কথা, ঘাস ফড়িং আর
জোনাক পাখি—আলোর কথা
আমার ব্যথা, তোমার ব্যথা, সবার ব্যথা,
রাজপথ আর নদীর ব্যথা, শূন্য বুকে বৈচালী দ্বীপ—
নিঃসঙ্গ বনের ব্যথা
এত কথার এত ব্যথার জমাট বেঁধে
বাঘের পিঠে মঞ্চ করে উড়িয়ে ছিলাম
হাওয়ার স্রোতে, ঝড়ের বেগে, তরঙ্গিনী নদীর স্রোতে।
গীতাঞ্জলীর বর্ণগুলো বন্দি থেকে
রেরিয়ে এসে জোর কদমে এগিয়ে ছিল বাউল পায়ে!
বলো, এমনতরো প্রকৃতিরে কে পেরেছে বশ মানাতে,
এমন কোনো হাজতখানা থাকতে পারে—কে রুধিবে?
তাই, তোমার ব্যথা, আমার ব্যথা—
তোমার কথা আমার কথা এক হয়ে যায়
নদীর জলে, বাতাস বাঁশির সুরের মায়ায়,
ভরসার ঐ মায়ের আঁচল, শক্তি হাওয়ায়
তখন কোকিল যদি ডাক দিয়ে যায়,
কে বাধা দেয়? কোন সাহসে!
এখন কার আছে আজ সাহস বলো, বন্দি করে—আমার বর্ণমালা?
যখন একুশ আমার ভূবন জুড়ে বুক উঁচিয়ে ভালোবাসার ডালা?
আজ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে মিনার তুমি, মিনার তো নও,
তুমি আমার পূর্ব পুরুষ স্বপ্নে দেখা আলোর ভূবন
সেই ভূবনে আমি আমার স্রোতের ধারায়, আসি ফিরে বারে বারে,
শোককে কঠিন শক্ত করে, একুশ নামের জ্বলজ্বলে এক সূর্য ধরে।
শ্যামলকান্তি
গলার শক্তি বরাবরই ভীষণ কড়া, ভীষণ চড়া
এটা আমার দোষ নাকি গুণ, যেটাই বলো!
ছোট্ট বেলায় এক অসুখে পা টা আমার লুলা হলো,
সেই থেকে যে ভুত তাড়াবো, চোর-বদমাশ
সব তাড়াবো—তা পারিনি, এমন কপাল সঙ্গী হলো!
কী আর করা? হাতের ওপর ভরসা কই?
হাতটা নাকি আদর সোহাগ ভালোবাসবার,
কাব্য কথার প্রেম পত্রে, প্রেম জানাবার,
পথ হারাদের পথ দেখাবার,
এই হাত কি চোর মারবার?
কিংবা আমি শিক্ষাদানে শ্যামল কান্তি, সংখ্যালঘু!
হাতটা কি তাই কানটি ধরে উঠ-বসবার!
কিংবা কোনো গুণ্ডা সেলিম, মৃত পিতার
কুলাঙ্গার এক! তার হুকুমে হাতটাকে তাই
চড়িয়ে দিব দুই কানেতে?
আহা! কী আব্দার! কী আব্দার!
আমার যে হাত, আমার যে পা যেমন আছে তেমনই থাক
শুধু গলার শক্তি বাড়বে আরও ভূত তাড়াতে, চোর তাড়াতে
সেলিম নামের গুণ্ডাটাকে কাঠগড়াতে দাঁড় করাতে।
রক্তে লেখা দেশটা আমার, তোমার কাছে এই চাওয়া কি খুব আব্দার?
বলো, খুব আব্দার?