সক্রেটিস এবং অচিন বীজ
শতাব্দীর পর শতাব্দী সৌরলোক ঘুরছে কক্ষপথে,
সন্ত সক্রেটিস আপনি আছেন স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত।
আপনি জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত ধরণীতে,
লক্ষ লক্ষ পায়রা উড়ে দিবানিশি আপনার সমাধিতে।
যদিও আমি জানি না আপনাকে তৎকালে স-সম্মানে,
সমাধিস্থ করা আদৌ হয়েছিল কি’না নিজ পূণ্যভূমিতে।
সমাধিস্থ হয়েছিলেন কি’না তাতে কীই-বা আসে যায়?
আপনার নামের উপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল গান হয়ে।
আপনি রয়েছেন বুকের তলায় হৃৎপিণ্ডের খুব গভীরে—
মুক্তচিন্তার অক্ষয় পাতায়-সত্য দর্শনের মূল চেতনায়।
হীরা জহরত এবং বহুবিধ অতুল্য রত্নভাণ্ডার আপনি,
রেখে গেছেন আপনার গ্রন্থের কালো অক্ষরে অক্ষরে।
আপনার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো মানব চেতনার গান,
যে গানে মোহাবিষ্ট হতো অজস্র গ্রিক যুবক যুবতী।
এই ব্যতিক্রমী গানের সুর সহ্য হয়নি গ্রিক নরপতির,
দাঁতাল অমানবিকতায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কারাগারে।
সন্ত সক্রেটিস আপনি বহু শতাব্দীপূর্বে কারাগারে,
নিজ হাতে হেমলকের বোতল করেছিলেন সাবাড়,
আপনার মৃত্যু-মহাকালের জীবন এবং মৃত্যু সমতুল্য।
মৃত্যুর আগে আপনার বুকের তলায় কি হিমশীতল,
হাওয়া বয়ে গিয়েছিল? কিংবা আপনার সুস্থ
হৃৎপিণ্ড কি ভীষণ শিরশিরিয়ে উঠেছিল ক্ষণকাল?
আত্মরক্ষা আপনার জন্য সহজ ছিল-যদি সত্যনিষ্ঠ—
অমিয় বাণী নির্বাসনে পাঠাতেন কুসীদজীবীর ধরনে।
কিয়ৎকাল ধরনীর নির্মল হাওয়ায় নিতে পারতেন শ্বাস,
অধিবাস্তবের প্রহেলিকায় পড়ত আপনার পদচ্ছাপ।
আপনি সত্যকে মিথ্যার সাথে যুগপৎ গুলিয়ে ফেলেননি
সত্যকে বন্ধক রেখে মজেননি ফটকাবাজ তৈলমর্দিনে।
এজন্যই আপনার আত্মাহুতি চিরঞ্জীব বিশ্ব-চরাচরে,
আপনি আলোর দিশারী এবং ভাবলোকে রাজাধিরাজ।
মৃত্যু আপনার নশ্বর জীবনকে করেছে অবিনশ্বর,
ইতিহাস জ্যোতির্বলয়ের মতো ঘুরছে আপনাকে ঘিরে।
পরাক্রমশালী কবন্ধ গ্রিক প্রভুদের ইতিহাস দেয়নি ঠাঁই,
ইতিহাস সোনালী হরফে আপনাকে দিয়েছে অমরতা।
আপনি যে সত্যাভিসারী দৃষ্টিপাত বপন করে গেছেন,
আমরা সেই মহাসত্যেরই এক একটি অচিন বীজ।
নিয়তি যখন প্রতিপক্ষ
এখন তোমাকে বলি,
অনেক তো হলো, এবার ক্ষ্যান্ত দাও।
নীরস সংলাপে প্রেমকথা,
ইয়ার বন্ধুদের সাথে সান্ধ্য আড্ডা শেষে গলির মোড়ে,
উপেক্ষিত প্রেমিকের মতো অকারণে চেয়ে থাকা আর নয়।
এখন তোমাকে বলি,
অবহেলার দৃষ্টি-সীমায় হামাগুড়ি দিয়ে মিথ্যা আশ্বাসে,
ধুঁকে ধুঁকে বঞ্চনার অনল বুকে নিয়ে উপহাসের ক্রুর-হাসি দেখে দেখে
তুমি দাঁড়িয়েছো সন্ধ্যার দুয়ারে।এখন তোমাকে বলি,
সত্য খান খান হয়ে গেছে-কুমোরের ভাঙা পাত্রের মতোন,
পিছনে আর তাকিয়ো না-ফলের গাছগুলো ভরে গেছে, মাকাল ফলে,
ঝলসে যাওয়া ঘাসের ডগায় শুকিয়ে-গেছে মমতোা;
প্রেম বলে আর বিলাপ কেন?
নিদ্রাহীন রাতে বড় একা?
এখন তোমাকে বলি,
অনেক স্বপ্ন শিরোনামহীন কবিতার মতো রয়ে যায়,
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো কেন ঝরাও দু’চোখে অশ্রু
নিভৃতে-নিরালা ফুটপাতে-কিংবা নিদ্রাহীন আহত বালিশে-?
এখন তোমাকে বলি,
যন্ত্রণার দাগ আর কতো বইবে?বিপুল নৈরাশে,
পাশব নিবাসকে তুড়ি মেরে এক লহমায় পান করে
নাও অমৃত সুধা-যেনো কস্মিনকালে মমতোার তটরেখায়,
আর কোনোদিন জাগতে না হয়।
বিদায়ের ক্ষণে শিয়রে নান্দীপাঠ হলো কি হলো না তাতে কি আসে যায়?
এখন তোমাকে বলি,
অনেক তো হলো এবার ক্ষ্যান্ত দাও,
ঘুমাও চির শান্তি সুখের শয়ানে।
নিষ্পিষ্ট তানপুরা…
বহু শতাব্দী পুরনো কবিতার দেয়ালে ঠেস
দিয়ে বসে থাকি একাকীত্বের শাল মুড়ি দিয়ে।
বুকের গহীন থেকে একটি নির্জন দীর্ঘশ্বাস,
বেরিয়ে আসে আশ্রয়হীন গুলিবিদ্ধ পাখির মতো।
নিভাঁজ চোখ দুটোয় ভীষণ জ্বালা ধরে,
নিশীথকে আরও বেশি নিশীথ মনে হয়।
ব্যর্থ মানুষের মতো চেয়ে থাকি নক্ষত্র পাড়ায়-
অ্যাশট্রে ভর্তি হয় মৃত সিগারেটের উৎকট গন্ধে।
মগজের কোষে ফনিমনসার ঝোপঝাড় বাড়ে,
সারারাত কাটে নির্ঘুম; স্মৃতিগুলো টোকা দেয়।
স্বপ্নের চিতায় দাঁড়িয়ে পান করি কোমল অনল,
যন্ত্রণাকে ছুটি দেই ঝিলের টোল খাওয়া জলে।
আপন হৃৎপিণ্ডে খুন হয়ে যায় ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে,
ইচ্ছে গুলো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে অকস্মাৎ।
হৃদয়ের নিঝুম চাতালে একটি স্বপ্নের অস্তরাগ,
কবির সত্তার অন্তর্গত দহন কেউই পায় না টের।
কফি হাউজ…
এই মুহূর্তে আমি ভাবছি,
সৌরভময় কিছু গোলাপের কথা,
ভাবছি গীতনিষ্ঠ কিছু পাখির কথা।
দেখতে পাচ্ছি একগুচ্ছ ডাগর গোলাপ,
হীরের টুকরোর মতো অগুনতি মেধাবী মুখ,
সরোদের তান, স্মৃতিনিষ্ঠ শ্যাওলার জামা পরা হারানো, ছমছমে জ্যোৎস্না।
টেবিলে কয়েকটি কফির মগ,
শীতলপাটির মতো পরিপাটি সাজানো-উড়ছে ধোঁয়া,
এই গৃহে এমন উচ্ছলতা আগে আমার জানা ছিল না।
তাজ্জব ব্যাপার এতদিনেও এই বুড়ো ঘরে,
কোলাহলের সামান্য কমতি নেই-বেড়েছে উজ্জ্বলতা-
এখানে কেউ সেলফিতে ব্যস্ত, কেউ সাহিত্য আড্ডায়,
কেউ প্রেমে মশগুল, কেউ বসে আছে কোমল ঠোঁটে-
ঠোঁট চুবিয়ে, কেউ ব্যবসা কিংবা রাজনীতির নতুন ছক-
আঁটছে টলটলে টেকো মাথায়, কেউ যাচ্ছে উদাসীন,
আপন খেয়ালে নিকোটিনের গলগলে ধোঁয়া উড়িয়ে।
শতাব্দী পেরিয়েছে কতো কালবৈশাখী গ্যাছে,
তবু মটকে দিতে পারেনি কেউ-এই বুড়ো ঘরের ঘাড়,
লাগাতার বৃষ্টির ঝাপসায় হয়নি আজও কুপোকাৎ,
দিব্যি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিজস্ব গৌরবে।
নিখিলেশ মইদুল সুজাতা আজ নেই,
বুড়ো ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে অমর শিল্পী,
মান্না দে’র অবিশ্বাস্য সুর-তান-লয় আর চারিদিকে-
বইয়ের সুমিষ্ট ঘ্রাণ-যা এক লহমায় স্মৃতি রোমন্থনে,
আমার হৃদয় হুড়মুড়িয়ে পড়েছিল কিয়ৎকালের জন্য।
বুড়ো ঘরে অজ¯্র কোলাহলের মাঝে,
আমার মনের গহীনে নেমে এলো একটি নিঝুম ছায়া,
আপনজনের বিয়োগে যেমন কেউ কেউ হয় মুহ্যমান,
তেমনই পুঞ্জ পুঞ্জ শোকের মাতম বেজে উঠলো আমার,
মগজের কোষে শরীরের শিরায় শিরায়।
অন্তঃচক্ষু দিয়ে দেখলাম,
ঘরের সাদা দেয়ালে দরজা জানালা টেবিলে গরম-
কফির মগে, সাহিত্যপ্রেমী আড্ডাবাজ-প্রেমিক যুগলের,
উষ্ণ ঠোঁটে, ভবঘুরের উসকো-খুসকো চুলে এবং-
মহাকালের দিকে ছুড়ে দেয়া কোনো চিন্তাশীল কবির,
সিগারেটের গলগলে ধোঁয়ায় মোহন সুরে বেজে চলেছে,
কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…
জুঁই মল্লিকা এবং চন্দন…
তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি ভরা সন্ধ্যায়,
যে যার মতো ঘুমুচ্ছো তোমরা নিরালা বিছানায়।
কেউ প্রিয়তমের শিশ্নে রেখে হাত-কেউ সোহাগী-
স্ত্রীর সুডৌল স্তন মুঠোয় নিয়ে মাতালের ধরনে।
আমার সত্তায় বেজে চলেছে অনাগত সময়ের ধ্বনি,
নিঃস্ব কবি হেঁটে চলেছে একাকী নিয়তির সমুখে।
মনের খুব গহীনে নৈঃশব্দের গান বেজে চলেছে,
গৌরি নিঃস্বতাই মস্তিষ্কে অপরূপ স্মৃতির ভুষণ।
স্মৃতিগুলোর বর্ননা কি করে আরজ করি তোমাদের?
আমি তো চিত্রকর নই, যে ছবি আঁকবো স্মৃতিগুলোর।
ইচ্ছে করে পিকাসো মাতিঁসের অন্তরাত্মা ধারণ করে,
পুরাতন ফর্ম ভেঙে নব্য ফর্মে স্মৃতিগুলোর অমরতা,
দেই-যা দেখে স্বয়ং ঈশ্বর নিভাঁজ চোখে দেয় দীর্ঘ শিস।
আমার স্বপ্নের সবুজ উপত্যকায় তোমাদের উপস্থিতি,
আড্ডা কোলাহল শত নীলকন্ঠী পাখির গান-সুর-লয়।
আমার শার্টের অন্তরালে বুকের তলায় হৃৎপিণ্ডের,
জায়মান আনাচে-কানাচে বেদনার ঢেউ বয়ে যায়।
তিনটি শ্বেতপদ্ম জ্বলে উঠে বুকের গহীনে নির্নিমেষে,
গহন অন্তস্তলে বিসমিল্লাহ খাঁর করুণ সানাইয়ের সুরে।
তোমাদের ভালোবাসার কি নাম দেবো-সে ভাষা এখনো,
ভূমিষ্ঠ হয়নি এই ধরায়।
শুধু বলবো আমার হৃদয়-তোমাদের কাছেই খোঁজে তার নিজস্ব আশ্রয়।
ঈশ্বর টাইপ রাইটারে আঙুল ঠুকে লিখে রেখেছেন,
যে নিয়তি-আমার নিয়তির সেই অন্ধকার কুঠুরিতে
তলিয়ে যাবার আগে-পৃথিবীর নিসর্গ সৌন্দর্যের কিঞ্চিৎ
জয়গান গেয়ে যেতে চাই, এ-ই আমার বিদায়ী প্রার্থনা।